সবকিছুর তত্ত্ব

পদার্থবিদ্যার উপপ্রমেয়মূলক তত্ত্ব, যার দ্বারা সকল পদার্থবিদ্যার সূত্র ব্যাখ্যা করা সম্ভব

সবকিছুর তত্ত্ব হল সর্বশেষ তত্ত্ব, চূড়ান্ত তত্ত্ব বা মূল তত্ত্ব যা পদার্থবিদ্যার উপপ্রমেয়মূলক (অর্থঃ যা এখনো চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়নি) একক কাঠামো / তত্ত্ব, যেটি দ্বারা পদার্থবিদ্যার সব সূত্র সুন্দর-সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রতিপাদন করা যাবে। এর দ্বারা মহাবিশ্বের সকল উপাদান / পারস্পরিক ক্রিয়াকে (পদার্থ, শক্তি, মাত্রা বা অন্যান্য কিছু) পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত করা যাবে ও ব্যাখ্যা করা যাবে। 'সবকিছুর তত্ত্ব' সমস্যাটি হল পদার্থবিদ্যার সমাধান না হওয়া বড় সমস্যাগুলোর একটি। গত বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে দুটি তাত্ত্বিক কাঠামো (মোটামুটি পূর্ণ তত্ত্ব) আবিষ্কার করা হয়েছে যা মোটামুটিভাবে 'সবকিছুর তত্ত্ব' এর প্রায় অনুরূপ। এ দু'টি তত্ত্ব হল সাধারণ আপেক্ষিকতাকোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব, যেগুলোর উপর ভিত্তি করে সম্পূর্ণ আধুনিক পদার্থবিদ্যা প্রতিষ্ঠিত। সাধারণ আপেক্ষিকতা হল এমন একটি তাত্ত্বিক কাঠামো যা কেবল মহাকর্ষ বলের উপর ভিত্তি করে মহাকাশকে (বৃহৎ আকারের ও অনেক ভরের বস্তুক্ষেত্র, যেমনঃ তারা, ছায়াপথ, ছায়াপথগুচ্ছ ইত্যাদি) বুঝতে সাহায্য করে। অপরপক্ষে, কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব হল এমন একটি তাত্ত্বিক কাঠামো যা মহাকর্ষ বলটি বাদে অন্যান্য বলসমূহের (সবলদুর্বল নিউক্লিয় বল এবং তড়িৎচুম্বকীয় বল) উপর ভিত্তি করে মহাকাশকে (ক্ষুদ্র আকারের ও অতি অল্প ভরের বস্তুক্ষেত্র, যেমনঃ অতিপারমানবিক কণা, পরমাণু, অণু ইত্যাদি) বুঝতে সাহায্য করে।  কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব সফলভাবে আদর্শ মডেল (প্রমিত মডেল) কে প্রমাণ করেছে এবং তিনটি বলের আন্তঃক্রিয়া (পারস্পরিক ক্রিয়া) কে (যেগুলো হল, সবল ও দুর্বল নিউক্লিয় বল এবং তড়িৎচুম্বকীয় বল) একত্রিত করেছে (যেটিকে মহা একত্রীকরণ তত্ত্ব বলে)।

সিএমএস ডিটেক্টরে প্রকাশিত হিগস বোসন কণা।

অনেক বছরের গবেষণার মাধ্যমে পদার্থবিদেরা তাত্ত্বিকভাবে এই দুই তত্ত্বের দেয়া প্রতিটি তাত্ত্বিক পূর্বাভাষের শতভাগ নিশ্চিত (যা আশাতীত) প্রমাণ পেয়েছেন (যখন তাদেরকে ঐ সঠিক ক্ষেত্রে সব শর্ত পূরণ করে পরীক্ষা করা হয়)। এগুলোর পাশাপাশি বিজ্ঞানীরা আরো জানতে পেরেছেন যে সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব তত্ত্ব দুটি বর্তমানে যেভাবে আছে তা পরস্পর সংগতিহীন – তারা উভয়ই সঠিক হতে পারে না। যেহেতু সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব সাধারণ প্রয়োগক্ষেত্র অনেক ভিন্ন (যথাক্রমে অতি বৃহৎ ও অতি ক্ষুদ্র ক্ষেত্র), সেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তত্ত্ব দুটির যেকোন একটি কোন এক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় (দুটিই উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় না)। ফলে পরিষ্কারভাবেই বুঝা যায় যে, সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বের এই অসামঞ্জস্যতা অতি ক্ষুদ্র আকারের কিন্তু বিশাল ভরের ক্ষেত্র (যেমন ব্ল্যাক হোল (কৃষ্ণ বিবর) এর অভ্যন্তর বা মহাবিশ্ব শুরুর সময়কাল (যেমন মহাবিস্ফোরণের ঠিক পরের মুহুর্ত)) এর ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা। এই অসামঞ্জস্যতা সমাধানে, এমন একটি তাত্ত্বিক কাঠামো দরকার যা বাস্তবতার আরো গভীরে গিয়ে সেখানে যা আছে তা প্রকাশ করবে। তাছাড়া মহাকর্ষ বলকে অন্য তিন বলের সাথে একত্রিত করতে হবে এবং সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব এর ক্ষেত্রকে একসূতায় সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বাঁধতে পারে এমন কিছু আবিষ্কার করতে হবে। মোটকথা, এমন একটি তত্ত্ব যা পদার্থবিদ্যার সকল ঘটনা ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। এই কাজ সমাধানের লক্ষ্যে, 'কোয়ান্টাম মহাকর্ষ' দারুণ কাজে আসছে।

পরিশেষে 'স্ট্রিং তত্ত্ব' নামের একটি একক ব্যাখ্যা প্রদানকারী কাঠামো প্রকাশিত হল যাকে বলা চলে মহাবিশ্বের চূড়ান্ত তত্ত্ব। স্ট্রিং তত্ত্ব বলে যে, মহাবিশ্বের শুরুতে (মহাবিস্ফোরণের পর ১০^-৪৩ সেকেন্ড পর্যন্ত) চার মৌলিক বল ছিল একটি একক মূল বল। স্ট্রিং তত্ত্ব মতে, মহাবিশ্বের সকল কণা সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম অবস্থায় (প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্যে) কম্পনের নির্দিষ্ট ধরনে কম্পিত স্ট্রিঙের বিভিন্ন বিন্যাসের দ্বারা গঠিত। স্ট্রিং তত্ত্ব আরো বলে যে, সুনির্দিষ্ট ভরের এবং বল-চার্জের কণা তৈরি হয় কোন স্ট্রিঙের নির্দিষ্ট ধরনের কম্পনের মাধ্যমে (তাতে করে বলতে হয়,ইলেকট্রন হল এক প্রকারের স্ট্রিং যা একটি সুনির্দিষ্টভাবে কাঁপে, যেখানে আপ কোয়ার্ক হল অপর একটি স্ট্রিং যা কাঁপে অন্য সুনির্দিষ্টভাবে ইত্যাদি।)

প্রথমদিকে, 'সবকিছুর তত্ত্ব' শব্দটিকে ব্যবহার করা হত বিভিন্ন অতিসাধারণীকৃত তত্ত্বকে শ্লেষ করার জন্যে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬০ এর দশকে স্টানিস্ল লেম (Stanisław Lem) এর সায়েন্স ফিকশন ধারাবাহিক গল্পের একটি চরিত্র- 'Ijon Tichy' এর দাদা 'সবকিছুর সাধারণ তত্ত্ব' এর উপর কাজ করেছিলেন বলে জানা যায়। পদার্থবিদ জন এলিস ১৯৮৬ সালে নেচার সাময়িকীর এক নিবন্ধে দাবি করেন যে তিনিই সর্বপ্রথম প্রযুক্তি বিষয়ক সাহিত্যে এই শব্দটি আনেন। সময়ের সাথে সাথে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা গবেষণায় এই শব্দটি ব্যাপক জনপ্রিয় হতে শুরু করে।

প্রাচীন গ্রিসে, সক্রেটিসের পূর্বকার দার্শনিকরা লক্ষ্য করেন যে, দৃশ্যমান ঘটনাসমূহের (বিক্রিয়া/অন্যান্য ঘটনা) স্পষ্ট বৈচিত্র্য এক ছোট ধরনের আন্তক্রিয়ার ফলে হচ্ছে, আর তাদের নাম হল গতি আর সংঘর্ষ। 'পরমাণু'র (যা ডেমোক্রিটাস প্রদত্ত নাম) ধারণাটা ছিল প্রকৃতিতে দৃশ্যমান সকল ঘটনাকে একীভূত করার প্রথমদিককার এক দার্শনিক প্রচেষ্টা।

আর্কিমিডিস সম্ভবত প্রথম বিজ্ঞানী যিনি প্রকৃতিকে 'স্বতঃসিদ্ধ উক্তি' (axiom = যা যুক্তি ও প্রমাণ ব্যতিরেকে সত্য বলে গৃহীত উক্তি) বা মূলনীতি দ্বারা ব্যাখ্যা করেন আর সেগুলো হতে নতুন ফলাফল (বা, নীতি) প্রতিপাদন করেন। এভাবে তিনি কিছুসংখ্যক 'স্বতঃসিদ্ধ উক্তি' দ্বারা 'সবকিছু' ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেন। যেকোন ধরনের 'সবকিছুর তত্ত্ব' এর মত তত্ত্ব 'স্বতঃসিদ্ধ উক্তি'র উপর ভিত্তি করে দেয়া হয় বলে আশা করা যায় আর সেটা হতে সকল দৃশ্যমান ঘটনা প্রতিপাদন করার চেষ্টা করা হয়।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা