ছায়াপথ স্তবক
ছায়াপথ স্তবক (ইংরেজি: Galaxy cluster) হচ্ছে মহাবিশ্বের সর্ববৃহৎ স্থায়ী কাঠামো। ১০০ থেকে শুরু করে কয়েক হাজার ছায়াপথের সমন্বয়ে একটি ছায়াপথ স্তবক গঠিত হতে পারে। অনেক দূরের স্তবকও পর্যবেক্ষণ করা যায় বলে এরা বিশ্বতাত্ত্বিক গবেষণায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং বিশ্বতত্ত্বের বেশ কিছু বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা অর্জনে এসব স্তবক ভূমিকা রেখেছে:
- গুপ্ত পদার্থের অস্তিত্বের প্রথম প্রমাণ ছায়াপথ স্তবকেই পাওয়া গিয়েছিল।
- ছায়াপথ স্তবকে প্রচণ্ড উত্তপ্ত গ্যাস থাকে, তাপমাত্রা প্রায় কেলভিন। এ কারণে এক্স রশ্মিতে এরা খুব উজ্জ্বল।
- মহাকর্ষীয় অস্থিতিশীলতা বিষয়ক তত্ত্ব প্রথম তৈরি করা হয়েছিল ছায়াপথ স্তবক ব্যাখ্যার জন্য। আর মহাবিশ্বের সকল কাঠামোর সৃষ্টি এই তত্ত্বের মাধ্যমেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
- স্তবকে বিভিন্ন ধরনের এবং আকারের ছায়াপথ থাকে। সবচেয়ে বড় এবং প্রাচীন ছায়াপথ, যেগুলো বিশ্বতত্ত্বের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, এখানেই পাওয়া যায়।[১]
আবিষ্কারের ইতিহাস
সম্পাদনাঊনবিংশ শতকে সকল নীহারিকার তালিকা করার জন্য যেসব জরিপ চালানো হয়েছে তাতেই প্রথম বারের মত ছায়াপথ স্তবক ধরা পড়েছিল। উত্তর আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল স্তবক দুটি হচ্ছে ভিরগো এবং কোমা স্তবক। আকাশগঙ্গা থেকে ২০ মেগাপারসেক দূরে অবস্থিত ভিরগো স্তবক আমাদের স্থানীয় মহাস্তবকের কেন্দ্র বলে বিবেচিত হতে পারে। আর কোমা স্তবকের দূরত্ব ৯৯ মেগাপারসেক। দুটি স্তবকের অবস্থানই উত্তর ছায়াপথীয় মেরুর কাছাকাছি। তবে উত্তর বহিঃছায়াপথীয় আকাশে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী কাঠামোগুলোর একটি হচ্ছে কোমা স্তবক।
ঊনবিংশ শতকে যখন প্রথম ছায়াপথ স্তবক আবিষ্কৃত হতে শুরু করে তখন আমরা নিজেদের ছায়াপথের গঠন সম্পর্কেই বেশি কিছু জানতাম না, এর বাইরেও যে অনেক ছায়াপথ রয়েছে তা জানার তো প্রশ্নই উঠে না। তখন তারা নয় এমন সকল কাঠামোর নাম দেয়া হতো নীহারিকা বা নেবুলা। আমাদের আকাশগঙ্গার অভ্যন্তরে এমন অনেক নীহারিকা আছে যারা হয় তারার সূতিকাগার, গ্রহীয় নীহারিকা নয়তো কোন অতিনবতারার অবশিষ্টাংশ। আর আকাশগঙ্গার বাইরে যেসব কাঠামোকে তখন নীহারিকা বলা হতো তার সবগুলোই প্রকৃতপক্ষে ছায়াপথ যার কোন কোনটি আকাশগঙ্গার চেয়েও অনেক বড়।
১৯২০-এর দশকে এডুইন হাবল প্রথমবারের মত অনেক দূরের বহিঃছায়াপথীয় বস্তুর দূরত্ব এবং গতিবেগ নির্ণয় করে দেখেন, মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। তিনিই প্রথম বুঝতে পারেন দূরের নীহারিকাগুলো প্রকৃতপক্ষে আমাদের আকাশগঙ্গার বাইরে অন্যান্য ছায়াপথ এবং এরা একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, আমাদের থেকে যার দূরত্ব যত বেশি তার পশ্চাদপসরণ বেগও তত বেশি। এই আবিষ্কার ছিল যুগান্তকারী, এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের বিশালতা প্রথমবারের মত আমাদের চোখে ধরা দেয়। এর মধ্যে সুইজ-মার্কিন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিৎস জুইকি কোমা স্তবকের অনেকগুলো ছায়াপথের দূরত্ব নির্ণয় করেন। নিশ্চিত না হলেও তিনি ধরে নেন, এই ছায়াপথগুলো একটি মহাকর্ষীয়ভাবে আবদ্ধ সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত, এই ভেবে নিয়ে তিনি সমগ্র স্তবকটির ভরও নির্ণয় করেন। তখনই আশ্চর্যজনক ফলাফলটি দেখা দেয়। এই স্তবকের ভর-প্রভা অনুপাত তথা মাস টু লাইট রেশিও দাড়ায় ২০০। অর্থাৎ ভরকে মোট উজ্জ্বলতা বা প্রভা দিয়ে ভাগ করলে ফলাফল পাওয়া যায় ২০০ (বর্তমানের হাবল ধ্রুবক দিয়ে আবার নির্ণয় করা মান এটি)। আমাদের সূর্যের ভর-প্রভা অনুপাত ১ এবং একটি সাধারণ ছায়াপথের ভর-প্রভা অনুপাত বিভিন্ন হাবল ধরনের উপর ভিত্তি করে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত হতে পারে। জুইকি এ থেকে সিদ্ধান্ত টানেন, স্তবকটিতে এমন অনেক ভর আছে যারা কোন প্রভা বিকিরণ করে না, এমনকি যাদের শনাক্ত করাও সম্ভব না। ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত এই ধারণা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কারণ তখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ কত ভরের বস্তু একসাথে মিলে একটি মহাকর্ষীয়ভাবে আবদ্ধ সিস্টেম তৈরি করতে পারে সে নিয়ে কোন নির্ভরযোগ্য তত্ত্ব ছিল না, তাই স্তবকের গতীয় অবস্থঅ ঠিকভাবে বোঝা যাচ্ছিল না।
১৯৭০ সালে কানাডীয়-মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী এবং বিশ্বতত্ত্ববিদ জিম পিবলস প্রথম একটি এন-বডি সিম্যুলেশনের মাধ্যমে দেখান কীভাবে সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র ঘনত্ব ব্যত্যয় (ডেনসিটি ফ্লাকচুয়েশন) থেকে ছায়াপথ স্তবকের জন্ম হতে পারে। এরপর মহাকাশে এক্স-রশ্মি পর্যবেক্ষণের উপযোগী দুরবীন স্থাপনের পর নিশ্চিতভাবে জানা যায় ছায়াপথ স্তবকের অন্তঃস্তবকীয় মাধ্যমে প্রচণ্ড উত্তপ্ত ( কেলভিন) গ্যাস আছে যারা এক্স রশ্মি বিকিরণ করে। আর এতো উত্তপ্ত গ্যাস থাকার অর্থ হচ্ছে সেখানে অনেক বড় এবং গভীর একটি বিভবীয় কুয়ো তথা পটেনশিয়াল ওয়েল আছে যেখানে গ্যাস স্থায়ীভাবে থাকতে পারে। এক্স বিকিরণকারী গ্যাসই ছিল স্তবক আবিষ্কার এবং সেখানে গুপ্ত পদার্থের বিস্তৃতির মানচিত্র তৈরি করার প্রথম কার্যকরী হাতিয়ার।[১]
ছায়াপথ পুঞ্জ ও ছায়াপথ স্তবক
সম্পাদনাছায়াপথ স্তবকের ছোট সংস্করণ হচ্ছে ছায়াপথ পুঞ্জ বা গ্রুপ (Galaxy group)। এ দুয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা টানা কষ্টকর, কেবল বলা যায় অপেক্ষাকৃত ছোট স্তবকই পুঞ্জ। দুটির মধ্যে পার্থক্যগুলো এমন:[২]
বিষয় | ছায়াপথ স্তবক | ছায়াপথ পুঞ্জ |
---|---|---|
ছায়াপথ সংখ্যা | অনেক (কয়েক শত থেকে কয়েক হাজার) | ১০০-র চেয়ে কম |
ছায়াপথগুলোর বিচ্ছুরণ বেগ | ১০০০ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড | কয়েক শত কিমি প্রতি সেকেন্ড |
আকার | কয়েক মেগাপারসেক (১ পারসেক = ৩.০৬×১০১৬ মিটার) | ০.১ থেকে ১ মেগাপারসেক |
তাপমাত্রা | অন্তঃস্তবকীয় মাধ্যমে (আইসিএম) ৩-১০ কিলো ইলেকট্রন ভোল্ট ( ) বা ৩×১০৭ - ১০৮ কেলভিন | আন্তঃছায়াপথীয় মাধ্যমে (আইজিএম) ~ ১ কিলো ইভি বা ১০৭ কেলভিন |
ধাতবতা | ০.২ - ০.৪ সৌর ধাতবতা (সৌর = ০.০১২২) | প্রায় ০.২ সৌর ধাতবতা |
এক্স-রশ্মি প্রভা | ১০৪৩ - ৪৫ আর্গ প্রতি সেকেন্ড | ১০৪২ - ৪৩ আর্গ প্রতি সেকেন্ড |
যেমন আমরা তথা আমাদের ছায়াপথ, আকাশগঙ্গা, কোন স্তবকের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং আমাদের ছায়াপথ, অ্যান্ড্রোমিডা এবং আরও বেশ কিছু ছায়াপথ ও উপছায়াপথ মিলে একটি ছায়াপথ পুঞ্জ গঠন করেছে যার নাম স্থানীয় পুঞ্জ তথা লোকাল গ্রুপ।