প্রথম আবদুল্লাহ, জর্ডানের রাজা
আবদুল্লাহ বিন আল-হুসাইন (ফেব্রুয়ারি ১৮৮২ – ২০ জুলাই ১৯৫১) (আরবি : عبد الله الأول بن الحسين) মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হুসাইন বিন আলী ও তার প্রথম স্ত্রী আবদিয়া বিনতে আবদুল্লাহর দ্বিতীয় পুত্র। তিনি ইস্তানবুল, তুরস্ক ও হেজাজে শিক্ষালাভ করেন। আবদুল্লাহ ১৯০৯ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত মক্কার প্রতিনিধি হিসেবে উসমানীয় সংসদের দায়িত্ব পালন করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটিশদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। ১৯১৬ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত তিনি ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তা টি ই লরেন্সের সাথে তিনি কাজ করেন।[১] উসমানীয়দের বিরুদ্ধে সংঘটিত আরব বিদ্রোহে তিনি অন্যতম স্থপতি ও পরিকল্পক। ১৯২১ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি ট্রান্সজর্ডানের শাসক ছিলেন যা থেকে পরবর্তীতে জর্ডানের জন্ম হয়।[২] ১৯২১ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি ব্রিটিশ মেন্ডেটের অধীনে আমির হন। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫১ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি জর্ডানের স্বাধীন বাদশাহ হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
প্রথম আবদুল্লাহ | |
---|---|
ট্রান্সজর্ডান আমিরাত | |
রাজত্ব | ১ এপ্রিল ১৯২১ - ২৫ মে ১৯৪৬ (২৫ বছর, ৫৪ দিন) |
পূর্বসূরি | নেই |
উত্তরসূরি | জর্ডানের বাদশাহ হিসেবে নিজে |
জর্ডানের বাদশাহ | |
রাজত্ব | ২৫ মে ১৯৪৬ - ২০ জুলাই ১৯৫১ (৫ বছর, ৫৬ দিন) |
পূর্বসূরি | ট্রান্সজর্ডানের আমির হিসেবে নিজে |
উত্তরসূরি | তালাল বিন আবদুল্লাহ |
জন্ম | ফেব্রুয়ারি ১৮৮২ মক্কা, উসমানীয় সাম্রাজ্য |
মৃত্যু | ২০ জুলাই ১৯৫১ (বয়স ৬৯) আল-আকসা মসজিদ জেরুজালেম |
সমাধি | |
অন্যান্য স্ত্রীগণ | মুসবাহ বিনতে নাসের সুজদিল খানুম নাহতা বিনতে উমান |
বংশধর | প্রিন্সেস হায়া প্রথম তালাল প্রিন্স নায়েফ প্রিন্সেস মুনিরা প্রিন্সেস মাকবুলা |
প্রাসাদ | আল-হাশিম |
পিতা | হুসাইন বিন আলী, মক্কার শরীফ |
মাতা | আবদিয়া বিনতে আবদুল্লাহ |
ধর্ম | সুন্নি ইসলাম |
প্রাথমিক রাজনৈতিক জীবন
সম্পাদনা১৯১০ সালে তার পিতা আবদুল্লাহকে মক্কার শরিফ হিসেবে অধিষ্ঠিত হতে প্ররোচিত করেন। এই পদের কারণেই হুসাইন ব্রিটিশদের সমর্থন লাভ করেন। একই বছরে তিনি তরুণ তুর্কিদের প্রতিষ্ঠিত সংসদে মক্কার প্রতিনিধি হন।[৩] ১৯১৪ সালে ব্রিটিশদের সমর্থন লাভের তিনি কায়রোতে লর্ড কিচনারের কাছে গোপন প্রতিনিধি পাঠান। আরবে তার পিতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য এ প্রতিনিধি পাঠানো হয়।[৪]
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে তিনি ব্রিটিশদের সাথে যোগাযোগ বহাল রাখেন। তুর্কিদের থেকে আরবদের স্বাধীনতার জন্য স্যার হেনরি ম্যাকমাহনের সাথে যোগাযোগের জন্য তিনি ১৯১৫ সালে তার পিতাকে উৎসাহিত করেন।[৩] ১৯১৬-১৯১৮ সালে আরব বিদ্রোহের সময় তিনি আরব পূর্বাঞ্চলীয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন।[৪] ১৯১৬ সালের ১০ জুন তাইফের উসমানীয় গেরিসন আক্রমণের মাধ্যমে তিনি আরব বিদ্রোহে তার কর্মকাণ্ড শুরু করেন।[৫] এই গেরিসনে ৩০০০ জন মানুষ ও দশটি ৭৫-মিমি. ক্রুপ কামান ছিল। আবদুল্লাহ ৫০০০ জনের একটি দলকে নেতৃত্ব দেন। তবে তারা আক্রমণের জন্য অস্ত্র বা নিয়মানুবর্তিতা কোনো দিক থেকেই প্রস্তুত ছিল না। এর পরিবর্তে তিনি শহর অবরোধ করেন। জুলাইয়ে তিনি মিশর থেকে সাহায্য হিসেবে হাউইটজার লাভ করেন। এগুলো মিশরীয়রা পরিচালনা করত। ১৬ জুলাই তার গোলন্দাজ বাহিনী গোলাবর্ষণ শুরু করে। ২২ সেপ্টেম্বর গেরিসন আত্মসমর্পণ করে।[৬] এরপর ৪০০০ জনের বাহিনী নিয়ে তিনি মদিনা অবরোধে নেতৃত্ব দেন। শহরের পূর্ব ও উত্তরপূর্বে তিনি দায়িত্বপালন করেন।[৭] ১৯১৭ সালে তিনি মরুভূমিতে একটি উসমানীয় গাড়িবহরকে আক্রমণ করেন এবং ২০০০০ পাউন্ড মূল্যের স্বর্ণমুদ্রা উদ্ধার করেন। এগুলো সুলতানের প্রতি অনুগত থাকার জন্য বেদুইনদেরকে ঘুষ হিসেবে দেয়ার জন্য নেয়া হচ্ছিল।[৮] ১৯১৭ সালের আগস্টে হেজাজ রেলওয়ের ধ্বংসের জন্য ফরাসি ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আউল্ড আলী রাহোর সাথে তিনি কাজ করেন।[৯] ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন টি ই লরেন্সের সাথে আবদুল্লাহর সম্পর্ক ভাল ছিল না। ফলশ্রুতিতে লরেন্স তার বেশীরভাগ সময় আবদুল্লাহর ভাই ফয়সালের সাথে আরব উত্তরাঞ্চলীয় সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দানের মাধ্যমে অতিবাহিত করেন।[৪]
ট্রান্সজর্ডান আমিরাত প্রতিষ্ঠা
সম্পাদনামায়সালুনের যুদ্ধে ফরাসিরা দামেস্ক দখল করে নেয়ার পর তার ভাই ফয়সালকে বহিস্কার করা হয়। আবদুল্লাহ দামেস্ক উদ্ধারের জন্য তার বাহিনী নিয়ে ট্রান্সজর্ডান যান।[৩] আবদুল্লাহর পরিকল্পনা শুনে উইনস্টন চার্চিল তাকে কায়রো সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানান। তিনি আবদুল্লাহকে ফিরে যেতে রাজি করানোয় সক্ষম হন। তিনি আবদুল্লাহকে বলেন যে ফরাসিরা তার চেয়ে শক্তিতে অগ্রগামী এবং ব্রিটিশরাও ফরাসিদের সাথে কোনো সমস্যায় যেতে চায় না। আবদুল্লাহ তার কথা মেনে নেন। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা তাকে প্রটেক্টোরেট প্রদানের মাধ্যমে তাকে পুরস্কৃত করে। এই প্রটেক্টোরেট পরবর্তীকালে ট্রান্সজর্ডান নামক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। স্বাধীনতার জন্য তিনি ব্রিটিশদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যান। ফলশ্রুতিতে ১৯৪৬ সালের ২৫ মে ট্রান্সজর্ডান আমিরাত (১৯৪৯ সালে জর্ডান নামে নামকরণ করা হয়) স্বাধীনতা লাভ করে। এটি জর্ডানের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা দিবস। তার ভাই ফয়সাল ইরাকের বাদশাহ হন।
লেফটেন্যান্ট-কর্নেল ফ্রেডরিক পিকের নেতৃত্বাধীন রিজার্ভ বাহিনীর সাহায্যে ট্রান্সজর্ডানকে গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন।[৩] এই বাহিনীকে ১৯২৩ সালে আরব লিজিওন নাম দেয়া হয়। গ্লাব পাশা ১৯৩০ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত এই বাহিনীকে নেতৃত্ব দেন।[৩]
১৯২৮ সালে আবদুল্লাহ একটি সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এর ক্ষমতা শুধুমাত্র উপদেষ্টার পর্যায়ে সীমিত ছিল।
২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় আবদুল্লাহ ব্রিটিশদের সাথে মিত্রতা বজায় রাখেন। তিনি ট্রান্সজর্ডানে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখেন। ইরাকে অক্ষশক্তির পক্ষের শক্তিকে দমন করতে সাহায্য করেন।
আবদুল্লাহর অধীনে প্রধানমন্ত্রীরা আমিরাতের ২৩ বছরে ১৮টি সরকার গঠন করেন।
আগ্রাসনবাদী আকাঙ্খা
সম্পাদনাপাশ্চাত্যে আবদুল্লাহ তার প্রজন্মের অন্যান্য আরব নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে উদার বলে বিবেচিত হন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] তিনি ইসরায়েলের সাথে একটি পৃথক শান্তিচুক্তি করতে চেয়েছিলেন কিন্তু আরব লীগের বিরোধিতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। দামেস্কের হাশেমী রাজত্বের অধীনে ট্রান্সজর্ডান, সিরিয়া, লেবানন ও মেন্ডেটরি প্যালেস্টাইন নিয়ে বৃহত্তর সিরিয়া গড়ার ইচ্ছার কারণে অনেক দেশ আবদুল্লাহকে অবিশ্বাস করতে থাকে এবং তাকে তাদের দেশের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি স্বরূপ বিবেচনা করে। ফলশ্রুতিতে আবদুল্লাহও অন্যান্য আরব নেতাদের অবিশ্বাস করতে শুরু করেন।[১০][১১][১২]
আবদুল্লাহ ১৯৩৭ সালে পেল কমিশনকে সমর্থন করেন। এই কমিশন ফিলিস্তিনকে ক্ষুদ্র একটি ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ভাগ করার ব্যাপারে প্রস্তাব করে (ব্রিটিশ মেন্ডেটধারী ফিলিস্তিনের ২০ শতাংশ) এবং বাকি অংশগুলো ট্রান্সজর্ডানের সাথে একীভূত হওয়ার বিষয়ে মত দেয়। ফিলিস্তিনের আরব ও অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলো পেল কমিশনের বিরোধিতা করে। ইহুদিরা অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও তা গ্রহণ করে।[১৩] শেষপর্যন্ত পেল কমিশনের প্রস্তাব গৃহীত হয়নি।
১৯৪৬-১৯৪৮ সালে আবদুল্লাহ ভাগকে মেনে নেন এই উদ্দেশ্যে যে ব্রিটিশ মেন্ডেটধারী ফিলিস্তিনের আরব অধ্যুষিত এলাকাগুলো ট্রান্সজর্ডানের সাথে একীভূত হবে। আবদুল্লাহ অনেক দূর এগিয়ে যান এমনকি ইহুদি এজেন্সির সাথে গোপন বৈঠক করেন। ভবিষ্যৎ ইসরায়েলী প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারও এই বৈঠকের প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন। বৈঠকে নভেম্বর ১৯৪৭ এর জাতিসংঘের বিভাগ পরিকল্পনা মেনে নেয়ার ব্যাপারে পারস্পরিক সমঝোতা হয়।[১৪][১৫] ১৯৪৮ সালের ১৭ নভেম্বর গোল্ডা মেয়ারের সাথে এক গোপন বৈঠকে আবদুল্লাহ বলেন যে তিনি আরব অংশগুলোকে সর্বনিম্নভাবে একীভূত করতে চান সেই সাথে ফিলিস্তিনের পুরোটাও একীভূত করতে চান।[১৬] ১৯৪৭ সালের জায়নিস্ট-হাশেমী গোপন আলোচনা নিউ হিস্টোরিয়ান আভি শ্লাইম তার বই Collusion Across The Jordan: King Abdullah, the Zionist Movement, and the Partition of Palestine এ উল্লেখ করেন। বিভাগ পরিকল্পনা ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্নেস্ট বেভিন সমর্থন করেন। জেরুজালেমের মুফতি মুহাম্মদ আমিন আল-হুসাইনির নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পরিবর্তে আবদুল্লাহর অধীন একীভূত ফিলিস্তিনকে তিনি অধিক নিরাপদ মনে করতেন।[৩][১৭]
১৯৪৮ সালের ৪ মে ফিলিস্তিনের যতটুকু সম্ভব দখল করার অংশ হিসেবে আবদুল্লাহ ইসরায়েলী বসতির ইটজিওন ব্লকে হামলার জন্য আরব লিজিওনকে পাঠান।[১৬] ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েলী যুদ্ধের এক সপ্তাহেরও কম সময় আগে ১১ মে আবদুল্লাহ মেয়ারের সাথে সাক্ষাৎ করেন।[১৬] আবদুল্লাহ মেয়ারকে বলেন, “রাষ্ট্র অর্জনের জন্য আপনারা এত তাড়াহুড়ো কেন করছেন? কয়েক বছর অপেক্ষা করছেন না কেন? আমি সমগ্র দেশ অধিকার করব এবং আপনি আমার সংসদের প্রতিনিধি হবেন। আমি আপনার সাথে খুবই ভাল ব্যবহার করব এবং কোন যুদ্ধ হবে না।”[১৬] মেয়ারকে আবদুল্লাহ হাশেমী রাজতন্ত্রের অধীনে একটি স্বায়ত্বশাসিত ইহুদি ক্যান্টন দান করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু মেয়ার নভেম্বরে জানান যে তারা একটি ইহুদি রাষ্ট্রের ব্যাপারে একমত হয়েছেন।[১৫] যুদ্ধ এড়ানো যাবে না এমতাবস্থায় একটি ইহুদি এজেন্সি লিখে, “[আবদুল্লাহ] ২৯ নভেম্বরের [জাতিসংঘের ভাগ করা] সীমানা মেনে নেবেন না, কিন্তু তিনি আমাদের পুরো রাষ্ট্র দখল করার চেষ্টা করবেন।”[১৮] যুদ্ধ দুর্ভাগ্যজনক তা আবদুল্লাহও অংশত বুঝতে পারেন, কারণ তিনি চাইতেন যেন ইহুদি রাষ্ট্রটি মুফতি শাসিত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হয় [জর্ডানের প্রতিবেশী হিসেবে]।[১৫]
ফিলিস্তিনি আরব, প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলো, সীমানা বৃদ্ধি ও চূড়ান্তভাবে জেরুজালেম অধিকার করার ব্যাপারে করা ওয়াদা আবদুল্লাহকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সম্মিলিত আরব সামরিক অভিযানে যোগ দিতে প্ররোচিত করে। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে তিনি এতে যোগ দেন। আরব বিশ্বে নিজের সম্মান রক্ষার্থে তিনি এতে যোগ দেন। পাশ্চাত্য ও ইহুদি নেতৃবৃন্দের সাথে তার তুলনামূলক ভাল সম্পর্কের কারণে আরব বিশ্বে তার অবস্থান সন্দেহজনক হয়ে উঠছিল।[১৫][১৯] মক্কার অভিভাবকত্ব হারানোর ক্ষতিপূরণ হিসেবে জেরুজালেম অধিকার করা আবদুল্লাহর ইচ্ছা ছিল। ১৯২৫ সালে ইবনে সৌদ হেজাজ অবরোধের আগ পর্যন্ত প্রথাগতভাবে হাশেমীরা মক্কার তত্ত্বাবধান করত।[২০] যুদ্ধে আবদুল্লাহর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আরব নেতাদের তিনি অবিশ্বাস করতেন। তিনি ভাবতেন যে তাদের সামরিক বাহিনী দুর্বল। অন্য আরবরাও পাল্টাভাবে তাকে অবিশ্বাস করে।[২১][২২] তিনি নিজেকে আরব বাহিনীর সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে ভাবতেন এবং তাকে এই পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য আরব লীগকে চাপ দেন।[২৩] ব্রিটিশ অধিনায়ক অধীনস্থ তার বাহিনী নতুন প্রতিষ্ঠিত ইসরায়েলের এলাকার কাছে পৌছতে পারেনি। তবে জেরুজালেমের কাছে ইশুভ বাহিনীর সাথে তাদের সংঘর্ষ হয় যা একটি আন্তর্জাতিক এলাকা হিসেবে ছিল। আবদুল্লাহ এল-তেলের মতে, আবদুল্লাহর কারণেই আরব লিজিওনকে গ্লাব পাশার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জেরুজালেমের পুরনো শহরে ঢুকতে হয়।
যুদ্ধ শেষে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম অধিকার করার পর আবদুল্লাহ ফিলিস্তিনি আরব জাতীয় পরিচয় দমন করতে চেষ্টা করেন। অধিকৃত ফিলিস্তিনি এলাকাকে তিনি একীভূত করেন এবং ফিলিস্তিনি আরবদেরকে জর্ডানি নাগরিকত্ব দান করেন।[২৪] ১৯৪৯ সালে তিনি ইসরায়েলের সাথে গোপন শান্তি বৈঠকে তিনি মিলিত হন। এদের মধ্যে অন্যান্য উচ্চপদস্থ ইসরায়েলীর সাথে পশ্চিম জেরুজালেমের সামরিক গভর্নর মোশে দায়ানও ছিলেন।[২৫] আলোচনার খবর আরব রাষ্ট্রগুলোতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পশ্চিম তীরকে জর্ডানের সাথে একীভূতকরণের স্বীকৃতির বদলে আবদুল্লাহ বৈঠক অসমাপ্ত অবস্থায় ত্যাগ করতে রাজি হন।[২৬]
হত্যা
সম্পাদনা১৯৫১ সালের ২০ জুলাই জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ পরিদর্শনের সময় হুসাইনি গোত্রের এক ফিলিস্তিনির গুলিতে নিহত হন।[১৯] ১৬ জুলাই লেবাননের এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আম্মানে আততায়ীর গুলিতে নিহতে হন। সেখানে গুজব ছড়িয়েছিল যে লেবানন ও জর্ডান ইসরায়েলের সাথে পৃথক শান্তি আলোচনা চালাচ্ছে। কঠোর নিরাপত্তা সত্ত্বেও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। শেষকৃত্যানুষ্ঠানে বক্তব্য দেয়ার জন্য ও রিউভেন শিলোহ ও মোশে সেসনের সাথে পূর্ব নির্ধারিত বৈঠকের উদ্দেশ্যে তিনি জেরুজালেম যান।[২৭] আল-আকসা মসজিদে জুমার নামায আদায় করার সময় তাকে গুলি করা হয়। এ সময় তার সাথে নাতি যুবরাজ হুসাইনও ছিলেন। আবদুল্লাহ ইসরায়েলের সাথে পৃথকভাবে শান্তি স্থাপন করবে এই ভয়ে হত্যাকারী তাকে গুলি করে। তার বুকে ও মাথায় তিনটি গুলি করা হয়। পাশে থাকা তার নাতি হুসাইনও আহত হন। তার বুকে ঝুলে থাকা একটি মেডেলের কারণে গুলিটি হুসাইনের ক্ষতি করতে পারেনি।[২৮] বলা হয় যে, বাদশাহ হওয়ার পর হুসাইন তার দাদার মৃত্যুর ঘটনার কারণে ছয় দিনের যুদ্ধের পর একই ভাগ্য এড়ানোর জন্য ইসরায়েলের সাথে শান্তি আলোচনায় বসেননি।[২৯]
হত্যাকারী ছিল ২১ বছর বয়সী মোস্তফা আশু নামক এক ব্যক্তি।[৩০] অ্যালেক কির্কব্রিডের মতে হত্যাকারী ছিল জাকারিয়া অক্কেহ, পেশায় গবাদিপশুর বিক্রেতা ও কসাই।[৩১] দশজন পরিকল্পনাকারী এর সাথে জড়িত ছিল। তাদেরকে আম্মানে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। বাদীপক্ষ জেরুজালেমের প্রাক্তন সামরিক গভর্নর কর্নেল আবদুল্লাহ এল-তেল ও ড. মুসা আবদুল্লাহ হুসাইনিকে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে।[৩২] জর্ডানি প্রোসিকিউটর উল্লেখ করেন যে কর্নেল তেল হত্যাকারীকে নির্দেশনা দিয়েছেন। জেরুজালেমের সূত্রমতে কর্নেল তেলের সাথে জেরুজালেমের সাবেক গ্রান্ড মুফতি আমিন আল-হুসাইনি ও তার অনুসারীদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ ছিল। তেল ও ড. হুসাইনি এবং জেরুজালেমের আরো তিনজন সহযোগীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৫১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ড. মুসা আলি হুসাইনি, আবিদ ও জাকারিয়া উকাহ এবং আবদ-এল-কাদির ফারহাতকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।[৩৩]
আবদুল্লাহর পুত্র তালাল তার উত্তরাধীকারী হন। তালাল মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন বলে তার পুত্র যুবরাজ হুসাইন বাদশাহ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তার বয়স ছিল সতের বছর। ১৯৬৭ সালে আবদুল্লাহ এল-তেলকে বাদশাহ হুসাইন ক্ষমা ঘোষণা করেন।
বিয়ে ও সন্তান
সম্পাদনাআবদুল্লাহ সর্বমোট তিনবার বিয়ে করেন।[৩৪] ১৯০৪ সালে ইস্তানবুলের স্টিনিয়া প্রাসাদে তিনি তার প্রথম স্ত্রী মুসবাহ বিনতে নাসেরকে বিয়ে করেন। ইনি আমীর নাসের পাশা ও তার স্ত্রী দিলবার খানুমের কন্যা ছিলেন। এই দম্পতির তিন সন্তান ছিলঃ
- প্রিন্সেস হায়া (১৯০৭-১৯৯০)। তিনি আবদুল করিম জাফর জাইদ ধাওয়িকে বিয়ে করেন।
- তালাল বিন আবদুল্লাহ (২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯০৯ – ৭ জুলাই ১৯৭২)
- প্রিন্সেস মুনিরা (১৯১৫-১৯৮৭)
১৯১৩ সালে আবদুল্লাহ তার দ্বিতীয় স্ত্রী সুজদিল খানুমকে (মৃত্যুঃ ১৬ আগস্ট ১৯৬৮) বিয়ে করেন। তাদের সন্তানরা হলঃ
- প্রিন্স নায়েফ বিন আবদুল্লাহ বেইফেন্দি (তাইফ, ১৪ নভেম্বর ১৯১৪-আম্মান, ১২ অক্টোবর ১৯৮৩)।
- প্রিন্সেস বাকবুলা (৬ ফেব্রুয়ারি ১৯২১ – ১ জানুয়ারি ২০০১)।
১৯৪৯ সালে আবদুল্লাহ তার তৃতীয় স্ত্রী নাহদা বিনতে উমানকে বিয়ে করেন। তিনি সুদানের অধিবাসী ছিলেন। তাদের কোনো সন্তান ছিল না।
সম্মাননা
সম্পাদনা- Knight Grand Cross of the Order of the British Empire (GBE), 1920
- Grand Cordon of the Order of the Two Rivers of the Kingdom of Iraq, 1922
- Grand Order of the Hashemites, 1932
- Order of Faisal I, 1st Class, 1932
- Knight Grand Cross of the Order of St Michael and St George (GCMG), 1935 (KCMG-1927)
- King George V Silver Jubilee Medal, 1935
- King George VI Coronation Medal, 1937
- Collar of the Order of Muhammad Ali of the Kingdom of Egypt, 1948
- Grand Collar of the Order of Pahlavi of the Empire of Iran, 1949
- Grand Cross of the Order of Military Merit of Francoist Spain, 1949
- Grand Cordon of the Order of Oumayyad of Syria, 1950
ছবি গ্যালারি
সম্পাদনা-
কায়রো সম্মেলনে টি ই লরেন্স,স্যার হার্বার্ট স্যামুয়েল,হাই কমিশনার, জিওফ্রি সালমন্ড এবং স্যার উইন্ডহাম ডিডসের সাথে, মার্চ ১৯২১
-
জেরুজালেমে সরকারি অভ্যর্থনায়। পাশে স্যার হার্বার্ট স্যামুয়েল, উইনস্টন চার্চিল ও তার স্ত্রী, ২৮ মার্চ ১৯২১
-
জেরুজালেমের চার্চ অব হলি সেপালচার পরিদর্শন, ২৯ মে ১৯৪৮
-
হত্যার কয়েক সপ্তাহ পূর্বে আল-আকসা মসজিদে বাদশাহ আবদুল্লাহ (সাদা পোষাকে), জুলাই ১৯৫১
-
গ্লাব পাশার সাথে হত্যার আগের দিন বাদশাহ আবদুল্লাহ, ১৯ জুলাই ১৯৫১
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Avi Shlaim (2007) Lion of Jordan; The life of King Hussein in War and Peace Allen Lane আইএসবিএন ৯৭৮-০-৭১৩৯-৯৭৭৭-৪ p 3
- ↑ Chambers Biographical Dictionary, আইএসবিএন ০-৫৫০-১৮০২২-২, page 3
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ Michael T. Thornhill, ‘Abdullah ibn Hussein (1882–1951)’, Oxford Dictionary of National Biography, Oxford University Press, Sept 2004; online edn, Jan 2008 accessed 10 March 2009
- ↑ ক খ গ Murphy, David The Arab Revolt 1916–18, Osprey, London 2008, page 13
- ↑ Murphy, David The Arab Revolt 1916–18, Osprey, London 2008, page 34
- ↑ MacMunn, Lieut.-General Sir George (1928) Military Operations. Egypt and Palestine. From the outbreak of war with Germany to June 1917. HMSO. Pages 226,227.
- ↑ MacMunn. Page 228.
- ↑ Murphy, David The Arab Revolt 1916–18, Osprey, London 2008, page 38
- ↑ Murphy, David The Arab Revolt 1916–18, Osprey, London 2008, page 45
- ↑ Shlaim, 2001, 82.
- ↑ Tripp, 2001, 136.
- ↑ Landis, 2001, 179–184.
- ↑ Morris, 190
- ↑ Rogan, 2001, 109–110.
- ↑ ক খ গ ঘ Morris, 193–194
- ↑ ক খ গ ঘ Karsh, Efraim The Arab-Israeli Conflict, London: Osprey, 2002 page 51.
- ↑ "al-Husseini, Hajj (Muhammad) Amin." Sela. The Continuum Political Encyclopedia of the Middle East. 360–362. See p. 361.
- ↑ "Meeting of the Arab Section of the Political Department of the Jewish Agency," qtd. in Morris, 194
- ↑ ক খ Sela, 2002, 14.
- ↑ Karsh, Efraim The Arab-Israeli Conflict, London: Osprey, 2002 page 50.
- ↑ Morris, 189
- ↑ Bickerton, 103
- ↑ Tripp, 2001, 137.
- ↑ Karsh, Arafat's War, 43.
- ↑ Dayan, Moshe (1976) Moshe Dayan. Story of my Life, William Morrow. আইএসবিএন ০-৬৮৮-০৩০৭৬-৯. 16 and 30 Jan 1949 – page 135; 19 and 23 March – page 142; 17 December – page 144.
- ↑ Hiro, 4
- ↑ Avi Shlaim (2007) p 46
- ↑ Lunt, James. "Hussein of Jordan". First published Macmillan London Ltd, 1989. Fontana/Collins paperback edition 1990. Pages 7,8.
- ↑ Bickerton, 161
- ↑ Michael T. Thornhill, ‘Abdullah bin Hussein (1882–1951)’, Oxford Dictionary of National Biography, Oxford University Press, 2004, accessed 24 November 2006.
- ↑ Wilson, 1990, p. 211.
- ↑ http://www.palestinefacts.org/pf_1948to1967_abdulla.php ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৭ জুলাই ২০১৭ তারিখে Abdullah I's assasination
- ↑ Lunt, page 9. 'Abid Ukah a cattle broker, his brother Zakariyya a butcher, Farhat a cafe owner. Husseini "pleaded his innocence throughout."
- ↑ Christopher Buyers, "Al-Hashimi Dynasty Genealogy"
গ্রন্থপঞ্জি
সম্পাদনা- Bickerton, Ian J., and Carla L. Klausner. A Concise History of the Arab-Israeli Conflict. 4th ed. Upper Saddle River: Prentice Hall, 2002.
- Hiro, Dilip. "Abdullah ibn Hussein al Hashem." Dictionary of the Middle East. New York: St. Martin's Press, 1996. pp. 3–4.
- Karsh, Efraim. Arafat's War: The Man and His Battle for Israeli Conquest. New York: Grove Press, 2003.
- Landis, Joshua. "Syria and the Palestine War: fighting King 'Abdullah's 'Greater Syria plan.'" Rogan and Shlaim. The War for Palestine. 178–205.
- Morris, Benny. 1948: The History of the First Arab-Israeli War. New Haven: Yale University Press, 2008
- Michael Oren, আইএসবিএন ০-৩৪৫-৪৫৯১২-৪ {{আইএসবিএন}} এ প্যারামিটার ত্রুটি: চেকসামটেমপ্লেট:Please check ISBN pp. 5, 7.
- Rogan, Eugene L., ed., and Avi Shlaim, ed. The War for Palestine: Rewriting the History of 1948. Cambridge: Cambridge University Press, 2001.
- Rogan, Eugene L. "Jordan and 1948: the persistence of an official history." Rogan and Shlaim. The War for Palestine. 104–124.
- Sela, Avraham, ed. The Continuum Political Encyclopedia of the Middle East. New York: Continuum, 2002.
- Sela, Avraham. "Abdallah Ibn Hussein." Sela. The Continuum Political Encyclopedia of the Middle East. 13–14.
- Shlaim, Avi (1990). The Politics of Partition; King Abdullah, the Zionists and Palestine 1921–1951 . Columbia University Press. আইএসবিএন ০-২৩১-০৭৩৬৫-৮.
- Shlaim, Avi. "Israel and the Arab coalition in 1948." Rogan and Shlaim. The War for Palestine. 79–103.
- Shlaim, Avi (2007) Lion of Jordan; The life of King Hussein in War and Peace Allen Lane আইএসবিএন ৯৭৮-০-৭১৩৯-৯৭৭৭-৪
- Tripp, Charles. "Iraq and the 1948 War: mirror of Iraq's disorder." Rogan and Shlaim. The War for Palestine. 125–150.
- Wilson, Mary Chrstina (1990). King Abdullah, Britain and the Making of Jordan. Cambridge University Press. আইএসবিএন ০-৫২১-৩৯৯৮৭-৪.
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনাপূর্বসূরী নতুন পদ |
ব্রিটিশ মেন্ডেটের অধীনে ট্রান্সজর্ডানের আমির ১৯২১–১৯৪৬ |
উত্তরসূরী ট্রান্সজর্ডানের বাদশাহ |
পূর্বসূরী ট্রান্সজর্ডানের আমির হিসেবে |
জর্দানের বাদশাহ ১৯৪৬–১৯৫১ (ট্রান্সজর্ডানের বাদশাহ হিসাবে ১৯৪৬–১৯৪৯) |
উত্তরসূরী তালাল বিন আবদুল্লাহ |