পশ্চিমবঙ্গের সংগীত
পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গীত-এর মধ্যে রয়েছে একাধিক আদি গানের ধরন রয়েছে, যেমন বাউল, বিষ্ণুপুর ঘরানা, কিশান, শ্যামা সঙ্গীত, অষ্টক গান, লালনগীতি রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, অতুলপ্রসাদী, দ্বিজেন্দ্রগীতি, প্রভাত সঙ্গীত, কীর্তন, কান্তগীতি, গণসভয়েট, আধিকিক গান, বাঙালি রক ইত্যাদি।
পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গীত | |
---|---|
ধারা | |
| |
নির্দিষ্ট ফর্ম | |
ধর্মীয় সঙ্গীত | |
জাতিগত সঙ্গীত | |
ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত | |
গণমাধ্যম ও অনুষ্ঠান | |
সঙ্গীত মাধ্যম | বেতার
টেলিভিশন ইন্টারনেট |
অঞ্চলিক সঙ্গীত | |
সম্পর্কিত এলাকা | |
অন্যান্য অঞ্চল | |
বিষ্ণুপুর ঘরানা
সম্পাদনাবিষ্ণুপুর ঘরানা বাংলার একমাত্র শাস্ত্রীয় (ধ্রুপদ) ঘরানা। এটি মল্ল রাজাদের রাজত্বকালে অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর শহরে উৎপত্তিলাভ করে।[১] দিল্লির বাহাদুর খান (যিনি তানসেনের বংশধর) হলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার উদ্ভাবক। বাহাদুর খানকে মল্লরাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের আমলে বিষ্ণুপুরে আনা হয়েছিল।
লোকসঙ্গীত
সম্পাদনাবাউল
সম্পাদনাবাউল গায়করা বাউল গান এবং বাদ্যযন্ত্রের এক রহস্যময় দল, গ্রামাঞ্চলে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তারা একটি খমক, একতারা এবং দোতারা ব্যবহার করে বাউল গান সঞ্চালন করে থাকে।
পটুয়া সঙ্গীত
সম্পাদনাপটুয়া সঙ্গীত পশ্চিমবঙ্গের এক প্রাচীন লোকসঙ্গীতের ধারা। পটচিত্রকর তথা পটুয়ারা লৌকিক ও পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বন করে বিভিন্ন ধরনের পটচিত্র অঙ্কন করেন এবং পটের কাহিনিকে ঘিরে সঙ্গীত রচনা করেন। এই সকল গান তাঁরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে পট প্রদর্শনের সঙ্গে পরিবেশন করেন। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ ও অন্যান্য পল্লী অঞ্চলগুলিতে পটুয়া সঙ্গীতের প্রচলন দেখা যায়।[২]
যদিও পৌরাণিক দেব-দেবীই পটের বিষয়বস্তু তবুও গান সহযোগে বর্ণনার সময় দেব-দেবীর লোকিক রূপই প্রাধান্য পেয়ে থাকে৷ দীঘল পটের প্রথম ছবির বর্ণনা সম্পন্ন হলে প্রথম ছবি জড়িয়ে নিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় ছবির বর্ণনা, তারপর দ্বিতীয় ছবিটিও জড়িয়ে নিয়ে শুরু হয় তৃতীয় ছবির বর্ণনা; এভাবেই এগিয়ে চলতে থাকে পটুয়া সঙ্গীত৷[৩]
একটি পটুয়া সঙ্গীতের নমুনা-
(ছবিতে দেখা যাচ্ছে জটায়ু পাখির গলায় রাজা দশরথ তাঁর নিজের গলার মালা পরিয়ে দিচ্ছেন৷ এক্ষেত্রে নীচের পটুয়া গানটি গীত হতে পারে৷)
“ | কোথায় ছিল জটায়ু পক্ষী রথ ধরে নামছিল জটায়ুর সাথে তবে রাজা মিত্রতা পাতাইল আমি বনের পাখি বনজন্তু রাজা মিত্রতার কি জানি অন্তিমকালে দিও তোমার রাঙা চরণ দুখানি নিজের গলার মালা খুলে রাজা (আজ) জটার গলায় দিল জটার সাথে জনম জনম রাজা মিত্রতা পাতাইল৷ এইখানে থাকো জটা মিত্র পাখী রথখানি আগুলে৷ আমি চলিলাম গহন কাননে মৃগ শিকার করিগে৷[৩] |
” |
লেটো গান
সম্পাদনালেটো হল পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের, বিশেষ করে উত্তর রাঢ় অঞ্চলের এক ধরনের খুব জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত৷ অনেকের মতে, "লেটো" শব্দটি এসেছে রাঢ় অঞ্চলে "নাট্য" শব্দের প্রচলিত অপভ্রংশ "লাট্য" থেকে৷ সাধারণতঃ রাঢ় অঞ্চলের মুসলমান সমাজের মানুষজনই লেটো গানের দল গঠন করে৷ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই রাঢ়বাংলারই মানুষ ছিলেন এবং তিনি নিজেও একসময় রাঢ়ের লেটো দলের সাথে যুক্ত ছিলেন৷
লেটো দলের অভিনেতারা সাজসজ্জা পরে অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন৷ এতে পালাগান ও তর্জাগানের প্রভাব দেখা যায়৷ কখনও যাত্রাদলের মতো পুরো একটি পালাগান গীত হয়, কখনও গান বন্ধ হয়ে গিয়ে দুই পক্ষের মাঝে ছড়া কাটাকাটি বা সংলাপ চলতে থাকে৷ সাথে চলে নাচ৷ গান শুরু হওয়ার আগে এককন্ঠে বা যৌথকন্ঠে আসর বন্দনা হয়-
“ | পহেলা বিসমিল্লা আল্লার নাম লেহে জোবানে৷ যার কুদরতে আসমান খাড়া গো রাখলে বিনা যতুনে৷ |
” |
লেটো গানের মধ্যে কখনও কখনও দেহতত্ত্ব, আবার কখনও বা মায়াবাদ শোনা যায়-
“ | এই দুনিয়া কেবল বালির বাঁধ কোন দিনেতে যাবে জান্৷ এই দুনিয়া কেবল বালির বাঁধ৷ |
” |
যখন দুই দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় তখন আত্মপ্রশস্তি ও প্রতিপক্ষকে নিন্দাবাদের মাধ্যমে আসর জমে ওঠে৷ মাঝে মাঝে অশ্লীল প্রসঙ্গও চলে আসে৷ কিশোর অভিনেতা কিশোরীবেশে চটুল নৃত্য পরিবেশন করে৷ দুইপক্ষ কখনও মা-বাবা, কখনও সোনা-লোহা, কখনও বা নামাজ-ইমান ইত্যাদি ভূমিকাতে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামে৷ দ্বন্দ্বযুদ্ধের চরম পর্যায়ে ব্যক্তিগত আক্রমণও চলে৷[৪]
লালনগীতি
সম্পাদনালালন ফকিরের বাউল গানগুলো লালনগীতি নামে পরিচিত। তাঁর গানের মাধ্যমেই উনিশ শতকে বাউল গান বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
রবীন্দ্র সঙ্গীত
সম্পাদনারবীন্দ্র সঙ্গীতের (বাংলা: [ɾobind̪ɾo ʃoŋɡit̪]), এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা ও রচনা।[৫] রবীন্দ্র সঙ্গীত, ভারতে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীতের মধ্যে জনপ্রিয়তাগুলির মধ্যে বিশেষ একটি।[৬][৭]
রবীন্দ্র সঙ্গীত শতকেরও বেশি সময় ধরে বাংলার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।[৭][৮] ভারতীয় সমাজ সংস্কারক স্বামী বিবেকানন্দ রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন তার যুবক কালে। তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত শৈলীতে সঙ্গীত রচনা করেন, উদাহরণস্বরূপ রাগজাজিভান্তিতে গগনের থালে।[৭]
শ্যামা সঙ্গীত
সম্পাদনাশ্যামাসংগীত কালী-বিষয়ক বাংলা ভক্তিগীতির একটি জনপ্রিয় ধারা। এই শ্রেণির সঙ্গীত শাক্তপদাবলির একটি বিশিষ্ট পর্যায়। শাক্তকবিরা প্রধানত তন্ত্রাশ্রয়ী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন বলে শ্যামাসঙ্গীতে তন্ত্রদর্শন নানাভাবে দ্যোতিত। শ্যামাসঙ্গীতের পদগুলিতে কালী বা শ্যামা মাতৃরূপে ও ভক্ত সাধক সন্তানরূপে কল্পিত। ভক্তের প্রাণের আবেগ, আকুতি, আবদার, অনুযোগ, অভিযোগ, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার নিবেদন ছন্দোবদ্ধ হয়ে গীতধারায় প্রকাশিত হয়েছে এই পর্যায়ে।
শ্যামাসঙ্গীতের ধারাটি বিকাশলাভ করে খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। এই সময় বঙ্গদেশে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে এক রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটকালে বৈষ্ণব ধর্মানুশীলনের পরিবর্তে শাক্তদর্শন ও শক্তিপূজা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। শ্যামাসঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ কবি রামপ্রসাদ সেন এবং শাক্তপদাবলির জগতে তার পরেই স্থান কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের। এই দুই দিকপাল শ্যামাসঙ্গীতকার ছাড়াও অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট পদকর্তা এই ধারায় সঙ্গীতরচনা করে শাক্তসাহিত্য ও সর্বোপরি শাক্তসাধনাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – কৃষ্ণচন্দ্র রায়, শম্ভুচন্দ্র রায়, নরচন্দ্র রায়, রামনিধি গুপ্ত ওরফে নিধুবাবু, দশরথি রায় ওরফে দাশুরায় প্রমুখ।
নজরুলগীতি
সম্পাদনানজরুলগীতি বা নজরুল সঙ্গীত বাংলাভাষার অন্যতম প্রধান কবি ও সংগীতজ্ঞ কাজী নজরুল ইসলাম লিখিত গান। তার সীমিত কর্মজীবনে তিনি ৩০০০-এরও বেশি গান রচনা করেছেন। তার কিছু গান জীবদ্দশায় গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়েছিল যার মধ্যে রয়েছে গানের মালা, গুল বাগিচা, গীতি শতদল, বুলবুল ইত্যাদি। পরবর্তীকালে আরো গান সংগ্রন্থিত হয়েছে।
দ্বিজেন্দ্রগীতি
সম্পাদনাদ্বিজেন্দ্রগীতি হল বিশিষ্ট বাঙালি নাট্যকার-সঙ্গীতস্রষ্টা দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচিত ও সুরারোপিত গান। এই গানগুলি বাংলা সংগীতের জগতে এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। তার বিখ্যাত গান "ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা", "বঙ্গ আমার! জননী আমার! ধাত্রী আমার! আমার দেশ", "যেদিন সুনীল জলধি হইতে উঠিলে জননী ভারতবর্ষ", "ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে" ইত্যাদি আজও সমান জনপ্রিয়।
প্রভাত সঙ্গীত
সম্পাদনাপ্রভাত সঙ্গীত হল প্রভাতরঞ্জন সরকার রচিত গান সংগ্রহ, যা একটি নতুন ভোর বা প্রভাত-এর গান হিসাবে পরিচিত। প্রভাতরঞ্জন সরকার ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯০ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত মোট আট বছরে গান ও সুরসহ ৫,০১৮ টি গান রচনা করেন। যদিও বেশিরভাগ গান বাংলা ভাষায় রয়েছে, কিছু হিন্দি, ইংরেজি, সংস্কৃত, উর্দু, মগাহি, মৈথিলি এবং অঙ্গিকা ভাষায় লেখা হয়েছে।
কান্তগীতি
সম্পাদনাকান্তগীতি হল কবি ও সঙ্গীত রচয়িতা রজনীকান্ত সেন কর্তৃক বাংলা ভাষায় রচিত ও সুরারোপিত গান। তাঁর রচিত গানগুলোকে (২৯০টি, তবে প্রকৃত সংখ্যা অজানা) বিষয়বস্তু অনুযায়ী চারটি ভাগে বিভাজিত করা হয়েছে – দেশাত্মবোধক গান, ভক্তিমূলক গান, প্রীতিমূলক গান ও হাস্যরসের গান।
অতুলপ্রসাদী
সম্পাদনাঅতুলপ্রসাদী বা অতুলপ্রসাদ সেনের গান (১৮৭১-১৯৩৪), আধুনিক যুগে প্রধান লিখিত গীতিকার ও সুরকারদের মধ্যে একজন ছিলেন এবং পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক জনপ্রিয়।[৯] বাংলা সঙ্গীতে থুমরী শৈলী প্রবর্তনের জন্য আতুল প্রসাদকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়।[৯] তার গানগুলি তিনটি বিস্তৃত বিষয়-দেশপ্রেম, নিষ্ঠা ও প্রেমের উপর নিবদ্ধ ছিল।[৯]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "Culture of Bishnupur"। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭।
- ↑ শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য। বঙ্গীয় লোক-সঙ্গীত রত্নাকর। কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ লোক সংস্কৃতি গবেষণা পরিষদ। পৃষ্ঠা ১০৪১।
- ↑ ক খ মুখোপাধ্যায়, দিলীপ (১৯৫৯)। উত্তর-রাঢ়ের লোকসঙ্গীত। কলকাতা: কল্যাণী প্রকাশন। পৃষ্ঠা ২৫।
- ↑ মুখোপাধ্যায়, দিলীপ (১৯৫৯)। উত্তর-রাঢ়ের লোকসঙ্গীত। কলকাতা: কল্যাণী প্রকাশন। পৃষ্ঠা ৯৩–৯৭।
- ↑ Sigi 2006, পৃ. 90
- ↑ Tagore 2007, পৃ. xii
- ↑ ক খ গ "Magic of Rabindra Sangeet"। Deccan Herald। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ জুলাই ২০১৩।
- ↑ Dasgupta ও Guha 2013, পৃ. 252
- ↑ ক খ গ Arnold, Alison (২০০০)। The Garland Encyclopedia of World Music। Taylor & Francis। পৃষ্ঠা 851। আইএসবিএন 0-8240-4946-2।