ধর্মীয় শিল্পকলায় পবিত্র পদ্ম
পদ্ম, নেলুম্বো নুসিফেরা, একটি জলজ উদ্ভিদ যা ভারতীয় ধর্ম যেমন, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধ, জৈন ধর্ম ও শিখ ধর্মের মতো ধর্মগুলোর কেন্দ্রীয় শিল্পের ভূমিকা পালন করে।
এশিয়ান শিল্পে, পদ্মাসন হল একটি শৈলীযুক্ত পদ্ম ফুল যা একটি আসন বা ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি বৌদ্ধ শিল্প এবং হিন্দু শিল্পে ঐশ্বরিক প্রতিমাগুলির জন্য সাধারণ ভিত্তি এবং প্রায়শ জৈন শিল্পেও দেখা যায়। ভারতীয় শিল্পে উদ্ভূত হলেও, এটি বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ার ভারতীয় ধর্মগুলো অনুসরণ করে।
হিন্দুধর্ম
সম্পাদনামূল নিবন্ধ: পদ্ম (হিন্দু দর্শন)
হিন্দু দেবতাদের উদাহরণ (শীর্ষস্থান থেকে): বিষ্ণু, গণেশ, শিব, দুর্গা, কালী এবং সরস্বতী । হিন্দুরা বিষ্ণু এবং লক্ষ্মীর প্রতিমাকে প্রায়শই গোলাপী পদ্মের উপর চিত্রিত দেবতারূপে শ্রদ্ধা করে; ঐতিহাসিকভাবে, ব্রহ্মা, সরস্বতী, লক্ষ্মী, কুবের নামে অনেক দেবতা সাধারণত একটি শৈলীযুক্ত পদ্মাসনে বসেন। পদ্মনাভ (পদ্মের নাভি) রূপে বিষ্ণুর প্রতিনিধিত্বে, ব্রহ্মার সাথে তার নাভি থেকে একটি পদ্ম বের হয়। দেবী সরস্বতীকে একটি সাদা পদ্মের উপর চিত্রিত করা হয়েছে। মানবতার মধ্যে কি ঐশ্বরিক বা অমর, পদ্ম হচ্ছে তারই প্রতীক, এবং ঐশ্বরিক পরিপূর্ণতারও প্রতীক। পদ্ম হল সূর্য ও অগ্নি দেবতার বিশেষণ। এটি অভ্যন্তরীণ শক্তির উপলব্ধির প্রতীক, এবং তান্ত্রিক এবং যোগীক ঐতিহ্য, এটি চক্রগুলির মধ্য দিয়ে চলা শক্তির প্রবাহকে (প্রায়শ চাকা-সদৃশ পদ্ম হিসাবে চিত্রিত করা হয়) জ্ঞানের হাজার পাপড়িযুক্ত পদ্ম হিসাবে ফুল ফোঁটানোর জন্য মাথার খুলির শীর্ষে একজন ব্যক্তির সম্ভাব্যতার প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়।[১]
বিষ্ণুকে প্রায়শই "পদ্ম-চোখের এক" (পুণ্ডরীকাক্ষ) হিসাবে বর্ণনা করা হয়।[২] পদ্মের উদ্ভাসিত পাপড়িগুলি আত্মার প্রসারণের ইঙ্গিত দেয়। কাঁদা থেকে উৎপত্তি হয়ে, এর বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের বৃদ্ধি একটি সৌম্য আধ্যাত্মিক প্রতিশ্রুতি রাখে। হিন্দু মূর্তিবিদ্যায়, অন্যান্য দেবতাকে যেমন, গঙ্গা এবং গণেশকে প্রায়শই পদ্ম ফুল দিয়ে তাদের আসন চিত্রিত করা হয়।
পদ্মকে পুরাণ এবং বৈদিক সাহিত্যে ব্যাপকভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে, উদাহরণস্বরূপ:
যিনি কোনও আসক্তি ছাড়াই তাঁর কর্তব্য সম্পাদন করে, পরমেশ্বর ভগবানের কাছে ফলাফল সমর্পণ করেণ, তিনি পাপ কর্ম দ্বারা প্রভাবিত হন না; যেমন পদ্ম জল দ্বারা অস্পর্শিত।
— ভগবত গীতা ৫.১০:
বৌদ্ধধর্ম
সম্পাদনাঅংগুত্তার নিকায়, বুদ্ধ নিজেকে একটি পদ্মের সাথে তুলনা করেছেন (সংস্কৃতে পদ্ম, পালিতে পদুমা),[৩] বলেছেন যে- পদ্মফুল কাঁদাবিহীন জল থেকে উদিত হয়, যখন তিনি এই পৃথিবী থেকে উত্থিত হন, শেখানো নির্দিষ্ট গুণে (সুতা/সূত্র) কলুষ থেকে মুক্ত হন।[৪][৫]
বৌদ্ধ প্রতীকবাদে, পদ্ম শরীর, কথা এবং মনের বিশুদ্ধতার প্রতিনিধিত্ব করে, যেন বস্তুগত আসক্তি এবং শারীরিক কামনার ঘোলা জলের উপ ভাসছে। ঐতিহ্যগত জীবনী অনুসারে, গৌতম বুদ্ধের প্রথম সাতটি ধাপে (পা ফেলা) পদ্মফুল ফুঁটেছিল।[৬] পদ্মাসন হলো বৌদ্ধ শিল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আকার এবং প্রায়শই অন্যান্য ভারতীয় ধর্মের সাধারণ স্তম্ভমূল ।
তিব্বতে, পদ্মসম্ভব-কে, পদ্ম-জন্ম, দ্বিতীয় বুদ্ধ হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যিনি স্থানীয় দেবতাদের জয় বা ধর্মান্তরিত করে সেই দেশে বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে এসেছিলেন; তাকে সাধারণত একটি ফুল ধরে চিত্রিত করা হয়।[৭]তাঁর জন্মের একটি বিবরণ হল যে, তিনি একটি পদ্ম ফুলের ভিতর আবির্ভূত হন।
কনফুসিয়ানিজম
সম্পাদনাচীনা সংস্কৃতিতে, কনফুসিয়ান পণ্ডিত ঝাউ দুনি (১০১৭-১০৭৩) লিখেছেন (গৌতম বুদ্ধের বিখ্যাত উপমা থেকে নেয়া):
আমি পদ্মকে ভালোবাসি কারণ কাঁদা থেকে বেড়ে ওঠলেও এটি দাগহীন।
পদ্ম হল ম্যাকাও-এর প্রতীক এবং এর পতাকায়ও প্রদর্শিত হয়। [৯]
জৈন ধর্ম
সম্পাদনাজৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাদের (তীর্থঙ্কর) পদ্মাসনে উপবিষ্ট বা দাঁড় করিয়ে চিত্রিত করা হয়েছে। [১০] তাঁর নাম অনুসারে, জৈন তীর্থঙ্কর পদ্মপ্রভাকেও পদ্মের প্রতীক দ্বারা প্রতিনিধিত্ব করা হয়। পদ্মপ্রভার অর্থ সংস্কৃতিতে 'লাল পদ্মের মতো উজ্জ্বল'। শ্বেতাম্বর সূত্রে বলা হয়েছে যে, যখন তিনি তাঁর মায়ের গর্ভে ছিলেন তখন লাল পদ্মের একটি পালঙ্ক-পদ্ম-এর প্রতি তাঁর শখ ছিলো। [১১]
ম্যানিচেইজম
সম্পাদনাচাইনিজ ম্যানিচেইজম চীনা বৌদ্ধধর্মের মূর্তি ধার করেছে, প্রায়শই মানিচেইজমের ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে তাদের ধর্মীয় শিল্পে পদ্মাসনে উপবিষ্ট হিসেবে চিত্রিত করে।
খ্রিস্টধর্ম
সম্পাদনাভারতে, খ্রিস্টান ধর্মের প্রবর্তনের পর থেকে, সেন্ট থমাস খ্রিস্টানদের মূর্তি চিত্রিত হয়েছে সেন্ট থমাস খ্রিস্টান ক্রস, যাকে পারস্য ক্রসও বলা হয়, একটি পদ্ম সিংহাসনে বিশ্রাম নিচ্ছে, একটি স্টাইলাইজড পদ্ম ফুলে। এইভাবে, চার্চ অফ দ্য ইস্ট দ্বারা চীনে খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তনের পরে, চীনা খ্রিস্টান প্রতিমাশিল্পে নেস্টোরিয়ান ক্রসকে প্রায়শ একটি পদ্ম ফুলের উপর চিত্রিত করা হয়েছে।
-
সেন্ট থমাস মাউন্টে পদ্মের উপর পারসিয়ান ক্রশ, চেন্নাই, তামিল নাড়ু, ভারত
-
চীনের বেইজিং থেকে প্রায় ৩০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে, ফ্যাং-শান জেলার ক্রুশের মন্দিরে একটি নেস্টোরিয়ান ক্রশ ছাপ
বাহাই ধর্ম
সম্পাদনাআন্তর্জাতিক বাহাই ধর্ম সম্প্রদায় ভারতের নয়াদিল্লিতে লোটাস টেম্পলের নকশায় পদ্ম প্রতীকী রূপ ব্যবহার করেছে।[১২]
সাংস্কৃতিক
সম্পাদনাএশীয় সংস্কৃতির অনেক শাস্ত্রীয় লিখিত এবং মৌখিক সাহিত্যে পদ্ম রূপক আকারে উপস্থিত রয়েছে; যা কমনীয়তা, সৌন্দর্য, পরিপূর্ণতা, বিশুদ্ধতা এবং করুণার প্রতিনিধিত্ব করে; প্রায়শ কবিতা এবং গানে আদর্শ নারী বৈশিষ্ট্যের রূপক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সংস্কৃতে পদ্ম (পদ্ম) শব্দের অনেক সমার্থক শব্দ রয়েছে: যেহেতু পদ্ম জলের উপর ফুলে ওঠে, তাই পদ্মের প্রতিশব্দ তৈরি করার জন্য জল শব্দের সাথে জা (জন্ম নির্দেশ করে) যোগ করা হয়, যেমন রাজীব, অম্বুজ ( অম্বু (জল)+জা (এর জন্ম)), নীরজা (নীরা (জল)+জা (এর জন্ম), পঙ্কজ, পঙ্কজা (পঙ্কা (কাদা)+জা ( এর জন্ম)), কমল, কমলা, কুনালা, অরবিন্দ, অরবিন্দ, নলিন, নলিনী এবং সরোজা এবং পদ্মাবতী (পদ্মের অধিকারী) বা পদ্মিনী (পদ্মে পূর্ণ)-এর মতো নাম পদ্ম থেকে উদ্ভূত। এই নামগুলি এবং প্রাপ্ত সংস্করণগুলি প্রায়শই দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে মেয়েদের এবং অল্প পরিমাণে ছেলেদের নামের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।[১৩][১৪]
পদ্ম ফুল, কর্ণাটক, হরিয়ানা এবং অন্ধ্র প্রদেশসহ ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ফুল। [১৫] পদ্ম ফুল হল, ভারতের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির নির্বাচনী প্রতীক।[১৬]
-
বিষ্ণু সর্প অনন্তে’র উপর বিশ্রাম করেন যখন ব্রহ্মা একটি পদ্ম সিংহাসনে বসে থাকেন, উদ্ভিদটি বিষ্ণুর নাভি থেকে নির্গত হয়।
-
সেইকেই জুসেটসু-এর আঁকা লিডেন ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি, এসইআর. ১০৪২
প্রতীকবাদ
সম্পাদনাএটাকে মনে করা হয়, সৌন্দর্য, পরম বিশুদ্ধতা, সততা, পুনর্জন্ম, আত্ম-পুনরুত্থান, জ্ঞানার্জনের প্রতীক হিসাবে। জল-পৃষ্ঠের নীচে এবং উপরে তার বিকল্প অস্তিত্ব থাকার সময় সুগন্ধী রূপান্তরকারী ঘ্রাণের জন্য এটিকে মিশরীয়রা সর্বোচ্চ উদ্ভিদ হিসাবে বিবেচনা করেছিলো। মিশরীয়রা এটাকে আত্মজ্ঞানের পরিবর্তিত অবস্থা এবং অন্যান্য রাজ্যের সাথে যোগাযোগ করার একটি উপায় হিসাবেও ব্যবহার করতো। নীল পদ্মকে রাত হতে উদিত হওয়া সূর্যের প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা হত।
হিন্দু দর্শনে পদ্মকে বিবেচনা করা হয়, সৃষ্টির প্রথম জন্ম এবং মহাবিশ্ব এবং দেবতাদের জন্য একটি ইন্দ্র-গর্ভ হিসাবে। দীর্ঘায়ু, উর্বরতা, সম্পদ এবং জ্ঞানের জন্যও এর সৃষ্টি করা হয়েছে।
এটাকে বৌদ্ধ ঐতিহ্যে, বস্তুগত সংযুক্তি থেকে মুক্তির প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যখন মন, কথা ও কর্মের স্তরে বিশুদ্ধতা আনয়ন করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। এছাড়াও সংযুক্ত: • নীল পদ্মের সাথে বুদ্ধি, জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার উপর আত্মার বিজয়ের প্রতীক। • "সাদা পদ্ম" বোধি জাগ্রত হওয়ার প্রতীক, মানসিক বিশুদ্ধতা এবং আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতার দিকে আরোহণ। এটি আধ্যাত্মিক পরিপক্কতার একটি অবস্থাকে বোঝায় যা একজনের প্রকৃতির প্রশান্তির সাথে সংযুক্ত। •"গোলাপী পদ্ম" বুদ্ধের সত্যিকারের পদ্ম এবং সবগুলোর মধ্যে সর্বোতকৃষ্ট হিসাবে বিবেচিত হয়। [১৭]
আরও দেখুন
সম্পাদনা- পদ্মের অবস্থান
- অষ্টমঙ্গলা (আটটি শুভ চিহ্ন)
- ওম মানি পদ্মে হুম - "পদ্মে রত্ন"
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Tresidder, Jack (১৯৯৭)। The Hutchinson Dictionary of Symbols। Duncan Baird Publishers। পৃষ্ঠা 126। আইএসবিএন 978-1-85986-059-5।
- ↑ "Lotus-eyed One"। The Hindu। ১২ জুলাই ২০১৩।
- ↑ Wisdom Library -Paduma
- ↑ AN 10.81, '"Bāhuna suttaṃ".
- ↑ AN 4.36, "Doṇa suttaṃ".
- ↑ Getty, 15
- ↑ "The Second Buddha: Master of Time"। Frances Young Tang Teaching Museum and Art Gallery। ২০১৯।
- ↑ "周敦颐:《爱莲说》"। Book.qq.com। ২০১২-০৪-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-১১-১৪।
- ↑ Lao-Phillips, Jenny (৮ জুন ২০১৭)। "Lotus Flower: luck, purity or a flash in the pan"। Macau Daily Times।
- ↑ "The Sacred Lotus Symbol | Mahavidya"। ২২ এপ্রিল ২০১৬।
- ↑ Balbir, Nalini। "Padmaprabha"। JainPedia। সংগ্রহের তারিখ ২৯ নভেম্বর ২০১৯।
- ↑ "Architecture of the Baháʼí House of Worship"। National Spiritual Assembly of the Baháʼís of India। ২০১২। ১৮ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ নভেম্বর ২০১৯।
- ↑ "Indian baby names"। Pitarau। ২ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ "Sanskrit-based names"। Behind the Name।
- ↑ State Flower of Haryana, Karnataka ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১০ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে
- ↑ "Bharatiya Janata Party (BJP)"। Elections.in। সংগ্রহের তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯।
- ↑ "Pink Lotus"।
আরও পড়ার জন্য
সম্পাদনা- Dallapiccola, Anna L. (২০০২)। Dictionary of Hindu Lore and Legend। Thames & Hudson। আইএসবিএন 0-500-51088-1।
- Lawlor, Robert (১৯৯১)। Voices Of The First Day: Awakening in the Aboriginal Dreamtime। Inner Traditions। আইএসবিএন 0-89281-355-5।
- Shakti, M. Gupta (১৯৭১)। Plant Myths and Traditions in India। Brill Publishers। পৃষ্ঠা 65–67।
বহি:সংযোগ
সম্পাদনা- উইকিমিডিয়া কমন্সে ধর্মীয় শিল্পকলায় পবিত্র পদ্ম সম্পর্কিত মিডিয়া দেখুন।