জ্যামিতিক পরিমাপে, দৈর্ঘ্য হল একটি বস্তুর সর্বশেষ বর্ধিত মাত্রা।[] আন্তর্জাতিক পরিমাপ ব্যবস্থা অনুসারে দৈর্ঘ্য হল সেই পরিমাণ যা মাত্রার দূরত্বকে প্রকাশ করে। অন্যভাবে বলতে গেলে "দৈর্ঘ্য" হল, একটি বস্তুর মাত্রার পরিমাপক। উদাহরণস্বরূপ, একটি তারকে এর দৈর্ঘ্য বরাবর এমনভাবে কাটা যেতে পারে যাতে এটি এর পুরুত্বের চেয়ে ছোট হয়।

চিত্রঃ উদাহারণস্বরুপ আয়তাকার বস্তুটির ক্ষেত্রে X - অক্ষ বরাবর পরিমাপকে বলে দৈর্ঘ্য, Y - অক্ষ বরাবর পরিমাপকে বলে প্রস্থ এবং Z - বরাবর পরিমাপকে বলা হয় উচ্চতা

দৈর্ঘ্যকে অবশ্যই আলাদা চিন্তা করতে হবে উচ্চতা থেকে, যা উল্লম্ব দিকে পরিমাপ ব্যবস্থা এবং প্রস্থ বা প্রসার থেকে, যেটি দূরত্বের পরিমাপ প্রকাশ করে পাশাপাশি দুটি প্রান্তের মধ্যে যা বস্তুর দৈর্ঘ্যের সাথে সমকোণে থাকে। দৈর্ঘ্য হল শুধুমাত্র একটি মাত্রার পরিমাপক, অপরদিকে ক্ষেত্রফল হল দুইটি মাত্রার পরিমাপ (দৈর্ঘ্যের বর্গগুণ) এবং আয়তন হল তিনটি মাত্রার পরিমাপ (দৈর্ঘ্যের ঘনফল)। অধিকাংশ পরিমাপ ব্যবস্থায়, দৈর্ঘ্যের এককটি হল ভিত্তি একক, যেটি থেকে অন্যান্য এককের সংজ্ঞায়ন করা হয়।

মেট্রিক পরিমাপের এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ইম্পেরিয়াল পরিমাপের ০.৬২১৩৭ মাইলের সমান।

ইতিহাস

সম্পাদনা

পরিমাপ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন থেকে মানুষের যাযাবর জীবনযাপন থেকে বসতি স্থাপন শুরু করে এবং নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার শুরু করে, জমির মালিকানার নিয়ম তৈরি হয় ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে। যেহেতু সমাজ আরও প্রযুক্তিমূখী হয়ে উঠছে, তাই বহুমুখী কাজের ক্ষেত্রগুলোতে আরও সূক্ষ্ম পরিমাপ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে, যার রেঞ্জ মাইক্রো - ইলেকট্রনিক্স থেকে অন্তরীক্ষ পর্যন্ত।[]

দৈর্ঘ্য পরিমাপে ব্যবহৃত প্রাচীনতম এককটি প্রাচীন বিশ্বে পরিচিত ছিল "এক হাত" পরিমাপ হিসাবে যার পরিমাণ ছিল বাহুর কনুই থেকে আঙুলের ডগা পর্যন্ত। এই পরিমাপকে এরপর আরও ভেঙ্গে ছোট মাপ যেমন ফুটে পরিণত করা হত, হাত (৪ ইঞ্চির হাত আজও ঘোড়ার উচ্চতা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহার করা হয়) বা আঙ্গুল কিংবা দুটি একই সাথে দীর্ঘ দূরত্ব মাপার একক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। মানুষের বিভিন্ন মাপের হাতের কারণে এই দীর্ঘ দূরত্বের মাপ যথেষ্ট পরিবর্তন হতে পারে।

আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশিত হবার পর থেকে দৈর্ঘ্যকে সকল রেফারেন্স তলে আর পরম ভাবা হয় না। এ কারণে কোন একটি রেফারেন্স তলে থাকা এক মিটার লম্বা স্কেল অপর একটি রেফারেন্স তলে সমান হয় না যদি সেটি প্রথম তলের সাথে আপেক্ষিক বেগে চলতে থাকে। এর মানে হল একটি বস্তুর দৈর্ঘ্য পরিবর্তনশীল হতে পারে পর্যবেক্ষকের অবস্থানের উপর নির্ভর করে।

গণিতে ব্যবহার

সম্পাদনা

ইউক্লিডীয় জ্যামিতি

সম্পাদনা

ইউক্লিডীয় জ্যামিতিতে, দৈর্ঘ্য সাধারণত সরলরেখা বরাবর পরিমাপ করা হয় যদি না অন্যভাবে উল্লেখ করা হয়। সমকোণী ত্রিভুজের বাহুগুলোর দৈর্ঘ্যের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাকারী পিথাগোরাসের উপপাদ্যটি ইউক্লিডীয় জ্যামিতিতে একটি বহুল ব্যবহৃত উপপাদ্য। দৈর্ঘ্য বিভিন্ন ধরনের বক্ররেখা বরাবরও পরিমাপ করা যেতে পারে এবং একে চাপদৈর্ঘ্য (arclength) বলা হয়।

ত্রিভুজে, একটি কোণ (শীর্ষবিন্দু) থেকে এর বিপরীত বাহুর (যাকে ত্রিভুজের ভিত্তি/ভূমি বলা হয়) উপর অঙ্কিত লম্বের দৈর্ঘ্যকে ত্রিভুজটির উচ্চতা বলে।

একটি আয়তক্ষেত্রের ক্ষেত্রফলকে এর দৈর্ঘ্য × প্রস্থ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।  যদি একটি লম্বা ও সরু আয়তক্ষেত্রকে তার ছোট বাহুর উপর দাঁড় করানো হয় তবে এর ক্ষেত্রফলকে এর উচ্চতা × প্রস্থ হিসাবেও বর্ণনা করা যেতে পারে। 

একটি কঠিন আয়তাকার বাক্সের আয়তন (যেমন একটি কাঠের তক্তা ) প্রায়শই দৈর্ঘ্য × উচ্চতা × গভীরতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

কোনো বহুভুজের পরিসীমা হল এর সবগুলো বাহুর দৈর্ঘ্যের সমষ্টি।

একটি বৃত্তাকার চাকতির পরিধি হল সেই চাকতির সীমানা (বৃত্ত ) এর দৈর্ঘ্য।

অন্যান্য জ্যামিতি

সম্পাদনা

অন্যান্য জ্যামিতিতে দৈর্ঘ্য প্রায়ই বাঁকানো পথ বরাবর পরিমাপ করা হয়, বাঁকানো পথ বরাবর দুটি বিন্দুর মধ্যে সর্বনিম্ন দূরত্বকে জিওডেসিক বলে। সাধারণ আপেক্ষিকতায় ব্যবহৃত রিম্যানিয় জ্যামিতি এই ধরনের জ্যামিতির একটি উদাহরণ। গোলকীয় জ্যামিতিতে, দৈর্ঘ্য গোলকের মহাবৃত্ত বরাবর পরিমাপ করা হয় এবং কোনো গোলকের উপর দুটি বিন্দুর মধ্যকার দূরত্ব হল সেই বিন্দু দুটিকে যোগ করার জন্য আঁকা মহাবৃত্তের উপর সর্বনিম্ন দূরত্বটি। আর এই দূরত্ব ওই দুই বিন্দুর মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত সমতল ও গোলকের কেন্দ্র দ্বারা নির্ধারিত হয়।

 
মহাবৃত্ত বরাবর লাল পথটি হচ্ছে P ও Q বিন্দু দুটির মধ্যকার সর্বনিম্ন দূরত্ব।

ব্যবহারিক বিজ্ঞান এবং ইঞ্জিনিয়ারিং এর ক্ষেত্রে, যখন একজন "দৈর্ঘ্যের একক" এর কথা বলে, তখন "দৈর্ঘ্য" শব্দ দ্বারা "দূরত্ব" কে বুঝানো হয়। দৈর্ঘ্য পরিমাপে ব্যবহার করা হয় এমন বেশ কিছু একক রয়েছে। অতীতে, দৈর্ঘ্যের এককের মাপ বের করা হত মানব দেহের অংশের দৈর্ঘ্যের পরিমাপ থেকে, দূরত্ব অতিক্রম করতে কত কদম ফেলতে হয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান বা জায়গাগুলি মধ্যে দূরত্ব, বা ইচ্ছামত কিছু সুনির্দিষ্ট বস্তুর দৈর্ঘ্যের উপর।

আন্তর্জাতিক একক পদ্ধতি (এসআই) অনুসারে, দৈর্ঘ্যের মৌলিক একক হল মিটার এবং যা এখন আলোর গতি পরিপ্রেক্ষিতে সংজ্ঞায়িত করা হয়। সেন্টিমিটার এবং কিলোমিটার, মিটার থেকে উদ্ভূত করা হয়, এগুলোও সর্বজনীনভাবে ব্যবহৃত একক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত একক, ইংরেজি বা ইম্পেরিয়াল একক ব্যবস্থার সাধারণভাবে ব্যবহৃত দৈর্ঘ্যের একক হল ইঞ্চি, ফুট, গজ এবং মাইল

মহাশূন্যের বিশালতা মধ্যে দূরত্ব বোঝাতে, জ্যোতির্বিদ্যায় সাধারণত পৃথিবীতে ব্যবহৃত এককের তুলনায় অনেক বড় একক ব্যবহার করা হয় এবং জ্যোতির্বিদ্যার এককের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আলোকবর্ষ এবং পারসেক

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Princeton.edu
  2. History of Length Measurement, National Physical Laboratory