ঝাড়গ্রাম জেলা

পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা

ঝাড়গ্রাম জেলা হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মেদিনীপুর বিভাগের অন্তর্গত একটি জেলা। এটি বনপাহাড়ির বনভূমির সৌন্দর্য এবং বেলপাহাড়ী পাহাড়ের জন্য বিখ্যাত। জেলার উত্তরে কাকরাঝোড় এবং দক্ষিণে সুবর্ণরেখা নদী। এটি বন্যপ্রাণীদের জন্য ভালো বাসস্থান এবং পর্যটকদের জন্য একটি প্রিয় গন্তব্য। প্রাচীন মন্দির, রাজপ্রাসাদ এবং লোক সুরগুলি এই এলাকাটিকে আকর্ষণীয় করে তোলে। [] ২০১৭ সালের ৪ এপ্রিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম মহকুমাটিকে নিয়ে এই জেলাটি গঠিত হয়। এটি পশ্চিমবঙ্গের ২২তম জেলা।[] ঝাড়গ্রাম জেলার জেলাসদর হল ঝাড়গ্রাম শহর।

ঝাড়গ্রাম জেলা
পশ্চিমবঙ্গের জেলা
পশ্চিমবঙ্গে ঝাড়গ্রামের অবস্থান
পশ্চিমবঙ্গে ঝাড়গ্রামের অবস্থান
দেশভারত
রাজ্যপশ্চিমবঙ্গ
প্রশাসনিক বিভাগমেদিনীপুর
সদরদপ্তরঝাড়গ্রাম
সরকার
 • লোকসভা কেন্দ্রঝাড়গ্রাম
 • বিধানসভা আসনঝাড়গ্রাম, গোপীবল্লভপুর, নয়াগ্রাম, বিনপুর
আয়তন
 • মোট৩,০২৪.৩৮ বর্গকিমি (১,১৬৭.৭২ বর্গমাইল)
জনসংখ্যা (২০১১)
 • মোট১১,৩৭,১৬৩[]
 • পৌর এলাকা৬১,৭১২
জনতাত্ত্বিক
 • সাক্ষরতা৭০.৯২%
প্রধান মহাসড়ক৬ নং জাতীয় সড়ক, ৫ নং রাজ্য সড়ক, ৯ নং রাজ্য সড়ক
ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি
সেবায়তন সৎসঙ্গ মিশন, ঝাড়গ্রাম

ভূপ্রকৃতি

সম্পাদনা

ছোট নাগপুর মালভূমি ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে সমভূমির সঙ্গে মিলিত হওয়া সময় ল্যাটেরাইট শিলা/মাটির সাথে একটি ক্ষেত্র তৈরি করে। এই সমগ্র এলাকাটি বিশেষভাবে খরা প্রবণ। []

ঝাড়গ্রাম জেলা ৩,০৩৭.৬৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী জেলাটির মোট জনসংখ্যা ১১,৩৬,৫৪৮ জন। মোট জনসংখ্যার ৯৬.৫২% ছিল গ্রামের এবং ৩.৪৮% শহুরে জনসংখ্যা। মোট জনসংখ্যার ২০.১১% তপশীলি সম্প্রদায়ের অন্তর্গত এবং ২৯.৩৭% তপশীলি উপজাতি জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত। []

উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে

সম্পাদনা

জেলাটির ভূমি-ভাগ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে মৃদু ঢালু। জেলার উত্তর-পশ্চিম অংশে পাহাড়ী ভূখণ্ড দেখা যায়। ঝাড়গ্রাম জেলার কাঁকড়াঝোর এলাকাটি প্রায় ৩০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এবং এখানকার আমলাশোল - আমঝর্নায় অবস্থিত এই জেলার সর্বোচ্চ পাহাড়, নাম ' বড় পাহাড় ' যার উচ্চতা ৩৭০ মিটার। গোপিবল্লভপুরের উচ্চতা প্রায় ৬৫ মিটার ঝাড়গ্রাম শহরের উচ্চতা প্রায় ৮০ মিটার। জেলার মধ্যে জমির ঢালের মধ্যে স্থানীয় বৈচিত্র আছে। এটি ছোটনাগরপুর মাল ভূমির পশ্চিম অংশে অবস্থিত।

বৃষ্টিপাত

সম্পাদনা

ঝাড়গ্রামের গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত (ঝাড়গ্রাম বন বিভাগ) প্রায় ১,৪০০ মিমি। বর্ষাকালে জুন থেকে সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বর্ষণ হয় এবং জুলাই ও আগস্ট মাসে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টিপাত অক্টোবর এবং শুষ্ক শীতকালের শেষ থেকে হ্রাস শুরু হয়। শুষ্ক ঋতু মে পর্যন্ত স্থায়ী হয়। যাইহোক, এই সময় এই বিভাগ কিছু বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি পায়।

ভারতের ঝাড়গ্রাম জেলা-এর আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য
মাস জানু ফেব্রু মার্চ এপ্রিল মে জুন জুলাই আগস্ট সেপ্টে অক্টো নভে ডিসে বছর
সর্বোচ্চ গড় °সে (°ফা) ১৬
(৬১)
২১
(৭০)
৩২
(৯০)
৩৮
(১০০)
৩৯
(১০২)
৩৬
(৯৭)
৩০
(৮৬)
৩০
(৮৬)
৩০
(৮৬)
৩১
(৮৮)
১৯
(৬৬)
১৭
(৬৩)
৩০
(৮৬)
সর্বনিম্ন গড় °সে (°ফা)
(৪১)
১০
(৫০)
২১
(৭০)
২৫
(৭৭)
২৭
(৮১)
২৭
(৮১)
২৩
(৭৩)
২৩
(৭৩)
২২
(৭২)
২১
(৭০)

(৪৫)

(৪৩)
২২
(৭২)
অধঃক্ষেপণের গড় মিমি (ইঞ্চি) ৯.৮
(০.৩৯)
৮.৩
(০.৩৩)
১৯.৪
(০.৭৬)
৫৭.৭
(২.২৭)
৭৪.৯
(২.৯৫)
১৭২.৮
(৬.৮০)
৩৩৪.৯
(১৩.১৯)
৩৩২.৭
(১৩.১০)
১৮৫.৮
(৭.৩১)
১০৪.৫
(৪.১১)
৮.৭
(০.৩৪)
৫.৯
(০.২৩)
১,০০৭.৪
(৩৯.৬৬)
উৎস: Weatherbase[]

প্রশাসনিক বিভাগ

সম্পাদনা
 
ঝাড়গ্রাম জেলার সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক

ঝাড়গ্রাম জেলা ১০টি থানা, ৮টি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, ৮টি পঞ্চায়েত সমিতি, ৭৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ২,৯৯৬টি মৌজা, ২৫১৩টি গ্রাম, ১টিপৌরসভা ও ১টি জনগণনা নগর নিয়ে গঠিত। এই জেলার একমাত্র পুরসভাটি হল জেলাসদর ঝাড়গ্রাম এবং একমাত্র জনগণনা নগরটি হল শিলদা[][]

ঝাড়গ্রাম জেলার ভাষা (২০১১) [][১০]

  বাংলা (৭৮.২৮%)
  সাঁওতালি (১৮.৯০%)
  কুড়মালি (১.২৫%)
  মুন্ডারি (১.৪৬%)
  অন্যান্য (০.১১%)

অর্থনীতি

সম্পাদনা
 
ঝাড়গ্রাম ডিয়ার পার্ক

বর্তমানে এই এলাকার অর্থনীতির প্রধান উৎস পর্যটন। সঙ্গে আছে ব্যবসা, চাষ বাস ও ক্ষুদ্র মাঝারি ধরনের শিল্প। কিছু লোক সরকারি কর্মচারী, স্কুল শিক্ষক এবং অন্যান্য বেসরকারী খাতে চাকরি করে।পর্যটন কে কেন্দ্র করে হস্তশিল্প যেমন বাবুই ঘাস, পাথর শিল্প নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। জেলার বিস্তীর্ণ অরণ্যে পাওয়া যায় শালপাতা, বিড়ির পাতা, ধুপ ধুনো, বন ঔষধ, শালফল, কুসুমফল, কুরকুট যা বহু মানুষের জীবন ও জীবিকার মূল উৎস।

সংস্কৃতি

সম্পাদনা

ঝাড়গ্রাম উপজাতীয় নৃত্যের স্বর্ণ কোষাগার। বলা যায় এই জেলাতে রয়েছে, এই বাংলার সকল প্রাচীনতম নৃত্য ও সংগীত এর ধারা।এই উপজাতি নৃত্যের কিছু কিছু বিলুপ্তির পথে। তবুও ভুয়াং, চ্যাং, ছৌ, লাঙরে, ঝুমুর, পাতা, দং,পরব প্রভৃতি নৃত্য এই অঞ্চলের নৃত্য কে সমৃদ্ধ করেছে। সারুল গান, টুসু গান, ভাদু গান, ঝুমুর গান সমগ্র বাংলা সঙ্গীতকেই সমৃদ্ধ করেছে। এই জেলার অন্যতম প্রাচীন একটি উৎসব পাহাড় পুজো, মকর পরব, করম উৎসব। গাঢ়রাসিনি পাহাড় পুজো ( আষাঢ় মাসের দ্বিতীয় শনিবার) ও কানাইসর পাহাড় পুজো (আষাঢ় মাসের তৃতীয় শনিবার ) অন্যতম দুই পাহাড় পুজো। শিলদা অঞ্চলে অবস্থিত পাটাবিন্ধা মেলা পূর্ব ভারতের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহত্তম আদিবাসী মেলা। প্রতি বছর বিজয়া দশমীর পরের দিন বসে এই মেলা। এই জেলার অপর আরো একটি প্রধান উৎসব বাদনা পরব।এই সময়ে হয় গরু খুটান ও কারা খুটান।

উপজাতীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি নিয়মিত বাঙালির উৎসব যেমন দুর্গা পূজা, সরস্বতী পূজা এবং কালী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া শীতলা, মনসা, দোলযাত্রা, রাস যাত্রা, জন্মাষ্টমি, ভীম পূজা, জগন্নাথের রথযাত্রা প্রভৃতি পূজায় সাথে অন্যান্য সাধারণ পূজাও সংঘটিত হয়।

ঝাড়গ্রামে অনেক মেলা এবং শোভাযাত্রা স্থান পায়। ঝাড়গ্রামের বিখ্যাত মেলা হল- জঙ্গলমহল উৎসব, ঝাড়গ্রাম মেলা ও যুব উৎসব, রঙ্গ মাটি মনুষ, শ্রাবনী মেলা, বৈশাখী মেলা, মিলন মেলা।

পর্যটন

সম্পাদনা
 
রামেশ্বর মন্দির, ঝাড়গ্রাম
 
জঙ্গলমহলে হরিণরূপী গাছ

ঝাড়গ্রামকে বলা হয়, অরণ্য সুন্দরী। বর্তমানে দক্ষিণ বঙ্গের একটি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। সুন্দরবন, দীঘা, পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া জেলার পর্যটন কেন্দ্রের মতোই বর্তমানে সাপ্তাহিক ছুটি কাটানোর অন্যতম কেন্দ্র এই ঝাড়গ্রাম। অরণ্য, নদী, পাহাড়, জলপ্রপাত, নীল কুঠি, লেক, রাজবাড়ি, শিল্পী গ্রাম ইত্যাদি সব কিছুরই অবস্থান রয়েছে এই জেলায়। দক্ষিণের গোপীবল্লভ পুর থেকে শুরু করে উত্তরের বেলপাহাড়ী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ জঙ্গল পাহাড় ঘেরা অঞ্চলে রয়েছে হাতি বাড়ি, ঝিল্লি পাখিরালয়, রামেশ্বর মন্দির, চোরচিতার চোরেশ্বর জিউর মন্দির, সুবর্ণরেখা নদী, কৃষগার্ডেন, চিলকিগড় রাজবাড়ি, কনক দুর্গা মন্দির, সাবিত্রী মন্দির, ট্রাইবাল মিউজিয়াম, ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি, ঝাড়গ্রাম মিনি জু, খোয়াব গা, ঘাগরা জলপ্রপাত, হুদহুদ জলপ্রপাত, শিলদা রাজবাড়ি, লাল জল প্রগ ঐতিহাসিক গুহা, গাঢ়রাসিনী পাহাড়, লকাই সিনি পাহাড়, খাঁদারানী জলাধার, কেটকি ঝর্না, কাকড়াঝোর, মাকুরভুলা জলপ্রপাত, শ্বেত পাথরের পাহাড়, লাট্টু পাহাড়, চাতন পাহাড়, পলাশ বন, তুলসীবনী সরোবর, রঙিন পাহাড়, ডাকাই উপত্যকা ইত্যাদি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।

রাস্তা

সম্পাদনা

ঝাড়গ্রাম খুব ভালোভাবে মহাসড়কগুলির সাথে যুক্ত। এই জেলায় এএইচ ৪৬ অবস্থিত। এটি এশিয়ান হাইওয়ের অন্তর্গত। অন্যান শহর যেমন মেদিনীপুর (খড়গপুর-মেদিনীপুর রোডে ৪০ কিলোমিটার), খড়গপুর (এনএইচ ৪৯ তে ৪৬ কিলোমিটার), দুর্গাপুর (১৫৬ কিলোমিটার এসএইচ -৯), আসানসোল (এনএইচ -১৪ ও এসএইচ-৯ হয়ে ১৮১ কিলোমিটার), বাঁকুড়া (এসএইচ-৯ ও ৫ হয়ে ১১৪ কিলোমিটার), পুরুলিয়া (এসএইচ -৫ হয়ে ১৪২ কিলোমিটার), হলদিয়া (১০ কিলোমিটারের বেশি। এসএইচ -৫ হয়ে ১১৪ কিলোমিটার), দীঘা (১৬৫ কি.মি. এনএইচ -৪৯, ১১৬ ও ১১৬বি হয়ে ), কলকাতা/হাওড়া (১৬৯ কি.মি. এএইচ ৪৬ হয়ে), টাটানগর (১১৪ কিলোমিটারের এনএইচ-৩৩ হয়ে), বারিপদা (৯৯ কিলোমিটার এএইচ ৪৬ এবং এনএইচ-৪৯ হয়ে) -এর সঙ্গে সড়ক পথে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে।

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. নতুন পথে যাত্রা শুরু ঝাড়গ্রামের (৪ এপ্রিল, ২০১৭)
  2. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ এপ্রিল ২০১৮ 
  3. "Jhargram to be state's 22nd district on April 4"। Millennium Post। সংগ্রহের তারিখ ৪ এপ্রিল ২০১৭ 
  4. "District Human Development Report: Paschim Medinipur" (পিডিএফ)page 4 (About Paschim Medinipur), page 26 (Predominant Soil), pages 265- 268 (Identification of Flood prone areas, Names of drought prone blocks)। Development and Planning Department, Government of West Bengal, 2011। ২৯ মার্চ ২০১৭ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ জানুয়ারি ২০১৭ 
  5. "District Statistical Handbook 2014 Paschim Medinipur"Table 2.2, 2.2(b), 2.9। Department of Statistics and Programme Implementation, Government of West Bengal। ২৯ জুলাই ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ 
  6. "Weatherbase: Historical Weather for Jhargram, India"। Weatherbase। ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ এপ্রিল ২০১০ 
  7. "District Statistical Handbook 2014 Paschim Medinipur"Table 2.1। Department of Statistics and Programme Implementation, Government of West Bengal। ২৯ জুলাই ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ অক্টোবর ২০১৬ 
  8. "Directory of District, Sub division, Panchayat Samiti/ Block and Gram Panchayats in West Bengal, March 2008"West Bengal। National Informatics Centre, India। ২০০৮-০৩-১৯। ২০০৯-০২-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ অক্টোবর ২০১৬ 
  9. http://www.censusindia.gov.in/2011census/C-16.html
  10. "DISTRIBUTION OF THE 22 SCHEDULED LANGUAGES-INDIA/STATES/UNION TERRITORIES - 2011 CENSUS" (পিডিএফ)। সংগ্রহের তারিখ ২৯ মার্চ ২০১৬