কালীপূজা
কালীপূজা বা শ্যামাপূজা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে উদ্ভূত একটি উৎসব, যা হিন্দু দেবী কালীকে উৎসর্গ করা হয়। এটি হিন্দু পঞ্জিকার অশ্বযুজা মাসের বা কার্তিক মাসের দীপান্বিতা অমাবস্যা পালিত হয়।[১] উৎসবটি বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, মিথিলা, বিহার, ওড়িশা, আসাম এবং ত্রিপুরার মতো অন্যান্য স্থানের পাশাপাশি বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয় ।
কালীপূজা | |
---|---|
অন্য নাম | শ্যামা পূজা, মহানীষা পূজা |
পালনকারী | হিন্দু |
ধরন | ধর্মীয় সাংস্কৃতিক |
উদযাপন | পূজার্চনা, আলোকসজ্জা ও আতসবাজি |
তারিখ | ৩১ অক্টোবর ২০২৪ |
সংঘটন | বার্ষিক |
সম্পর্কিত | দীপাবলি |
এ দিন দীপাবলি উৎসব পালিত হয়। এটি দীপাবলি, দীপান্বিতা, দীপালিকা, সুখরাত্রি, সুখসুপ্তিকা এবং যক্ষরাত্রি নামেও অভিহিত হয়।[২] সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এই দিন লক্ষ্মীপূজা অনুষ্ঠিত হলেও বাঙালি, অসমীয়া ও ওড়িয়ারা এই দিন কালীপূজা করে থাকেন।[৩] এছাড়া মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে রটন্তী এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথিতে ফলহারিণী কালীপূজাও যথেষ্ট জনপ্রিয়।[৪]
ইতিহাস
সম্পাদনাচামুণ্ডাচর্চিকা কালীর পূজা বাংলা ও বহির্বঙ্গে প্রাচীন উৎসব হলেও বর্তমান আকারে কালীপূজা আধুনিক কালের।[৫] ষোড়শ শতাব্দীতে নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ স্মার্ত পণ্ডিত তথা নব্যস্মৃতির স্রষ্টা রঘুনন্দন দীপান্বিতা অমাবস্যায় লক্ষ্মীপূজার বিধান দিলেও, কালীপূজার উল্লেখ করেননি।[৫] ১৭৬৮ সালে রচিত কাশীনাথের কালী সপর্যাসবিধি গ্রন্থে দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপূজার বিধান পাওয়া যায়। ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্তের মতে, “কাশীনাথ এই গ্রন্থে কালীপূজার পক্ষে যে ভাবে যুক্তিতর্কের অবতারণা করিয়াছেন, তাহা দেখিলেই মনে হয়, কালীপূজা তখনও পর্যন্ত বাঙলা দেশে সুগৃহীত ছিল না।”[৬] তবে খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলায় কালীপূজার প্রচলনের কিছু কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।[৫]
সপ্তদশ শতকের নবদ্বীপের প্রথিতযশা তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপূজার প্রবর্তক মনে করা হয়।[৫][৭] তাঁর পূর্বে কালী উপাসকগণ তাম্রটাটে ইষ্টদেবীর যন্ত্র এঁকে বা খোদাই করে পূজা করতেন।[৫] পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বয়ং কালীমূর্তি গড়িয়া পূজা করিতেন। আগমবাগীশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া বাংলার সাধক সমাজ অনেকদিন চলেন নাই; লোকে ‘আগমবাগিশী’ কাণ্ড বলিয়া তাঁহার পদ্ধতিকে উপেক্ষা করিত।”[৮] অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন।[৩] এই সময় রামপ্রসাদ সেনও আগমবাগীশের পদ্ধতি অনুসারে কালীপূজা করতেন।[৫] ঊনবিংশ শতাব্দীতে কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র ও বাংলার ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপূজা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।[৯] বর্তমানে কালীপূজা বাংলায় দুর্গাপূজার মতোই এক বিরাট উৎসব।[১০]মহিষাসুর মর্দিনীর প্রানপুরুষ স্বর্গীয় বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের আদি নিবাস বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার উথালী গ্রামে কালী পুজার কিছু প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায়।এখানে শত শত বছর ধরে কালী পুজা ঘট স্থাপনের মাধ্যমে করা হয়। এ কালী পুজা যখন শুরু হয় তখন সম্ভবত মুর্তি পুজা সেভাবে বাংলায় প্রচলন ছিলো না বলে ধারণা গবেষকদের।কবে থেকে এ পুজা শুরু হয় তার সঠিক ধারণা নেই।তবে সপ্তম শতকে ভদ্রবংসীয় মহাসামন্তদের হাত ধরে এ কালী পুজা শুরু হয় বলে ধারণা।
পূজা
সম্পাদনাদুর্গাপূজার মতো কালীপূজাতেও গৃহে বা মণ্ডপে মৃন্ময়ী প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করা হয়। মন্দিরে বা গৃহে প্রতিষ্ঠিত প্রস্তরময়ী বা ধাতুপ্রতিমাতেও কালীপূজা করা হয়। মধ্যরাত্রে তান্ত্রিক পদ্ধতিতে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। দেবীকে ছিন্নমস্তক সহ বলির পশুর রক্ত, মিষ্টান্ন, অন্ন বা লুচি, মাছ ও মাংস উৎসর্গ করা হয়।[১১] গৃহস্থবাড়িতে সাধারণত অতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যমতে আদ্যাশক্তি কালীর রূপে কালীর পূজা হয়।[১২] দেবীর পূজায় ছাগ মেষ বা মহিষ বলির প্রথা রয়েছে।[৩] সুদূর অতীতে নরবলি দিয়েও কালীপূজা হত।[৪] লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কালী শ্মশানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। এই কারণে কলকাতা সহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে শ্মশানে মহাধুমধামসহ শ্মশানকালী পূজা অনুষ্ঠিত হয়।[১৩]
কোনো কোনো মণ্ডপে কালী ও শিবের মূর্তির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার দুই বিখ্যাত কালীসাধক রামকৃষ্ণ পরমহংস ও বামাখ্যাপার মূর্তিও পূজিত হয়। কোথাও কোথাও কালীর সঙ্গে সঙ্গে দশমহাবিদ্যাও পূজিত হন।[১৪] দর্শনার্থীরা সারারাত ধরে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে কালীপ্রতিমা দর্শন করেন। কালীপূজার রাতে গৃহে আলোকসজ্জা সাজানো হয় এবং আতসবাজি পোড়ানো হয়।[১২]
কলকাতার কালীঘাট মন্দিরে এই দিন দেবী কালীকে লক্ষ্মীরূপে পূজা করা হয়। হাজার হাজার ভক্ত এই দিন কালীঘাট মন্দিরে ভিড় করেন এবং দেবীর উদ্দেশ্যে বলি উৎসর্গ করেন।[৩][১৩] কলকাতার অপর বিখ্যাত কালীমন্দির দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতেও কালীপূজা উপলক্ষে মহাসমারোহ হয়। এইখানেই অতীতে রামকৃষ্ণ পরমহংস কালী আরাধনা করেছিলেন। সেই কারণে এই মন্দিরে কালীপূজা দেখতে প্রচুর পুণ্যার্থী এখানে ভিড় জমান।[১৫]
পূজার তাৎপর্য
সম্পাদনাকালীপূজার মাধ্যমে সমাজে সংঘটিত অন্যায়ের প্রতিবাদ করার প্রেরণা পাওয়া যায়।এ পূজার মাধ্যমে সামাজিক বন্ধনও স্থাপিত হয়।কালীপূজার মাধ্যমে গুরুজনদের সম্মান করার আদর্শ স্থাপিত হয়।কালীদেবীর মূর্তি জ্ঞান, কর্ম,কর্মফল ও ত্যাগের তাৎপর্য তুলে ধরে।কালীপূজার মাধ্যমে মোক্ষলাভও হয়।কালীদেবীর কোমরের হাতগুলো কর্মের তাৎপর্য তুলে ধরে ও শ্মশানবাস জীবনের শেষ পরিণতিকে নির্দেশ করে।এছাড়া মুন্ডগুলো জ্ঞানের ধারক।এছাড়াও কালীপূজার বহু তাৎপর্য আছে যা তাঁর রূপের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়।
পাদটীকা
সম্পাদনা- ↑ McDermott and Kripal p.72
- ↑ "দেওয়ালি - বাংলাপিডিয়া"। bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-২১।
- ↑ ক খ গ ঘ McDermott and Kripal p.72
- ↑ ক খ শক্তিরঙ্গ বঙ্গভূমি, সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ১১৪-১৫
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ হিন্দুদের দেবদেবী: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ, তৃতীয় খণ্ড, হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, ফার্মা কেএলএম প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ২০০৭, পৃ. ২৮৫-৮৭
- ↑ ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, শশীভূষণ দাশগুপ্ত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, প্রথম সংস্করণ, পৃ. ৭৫
- ↑ পিনাকী বিশ্বাস (২০২০)। বাংলার ডাকাতকালী, মিথ ও ইতিহাস। কলকাতা: খড়ি প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ২৮। আইএসবিএন 978-81-942305-5-7।
- ↑ "শ্রীশ্রীকালীপূজা", পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঙ্গালীর পূজাপার্বণ, অমরেন্দ্রনাথ রায় সম্পাদিত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ১৩৫৬ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৫৭
- ↑ McDermott p. 173
- ↑ McDaniel p. 223
- ↑ McDaniel p. 234
- ↑ ক খ McDaniel pp. 249-50, 54
- ↑ ক খ Fuller p. 86
- ↑ Kinsley p.18
- ↑ See Harding pp. 125-6 for a detailed account of the rituals in Dakshineshwar
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- [১] Encountering Kālī: in the margins, at the center, in the West By Rachel Fell McDermott, Jeffrey John Kripal
- Offering flowers, feeding skulls: popular goddess worship in West Bengal By June McDaniel [২]
- Kali: the black goddess of Dakshineswar By Elizabeth U. Harding [৩]
- Mother of my heart, daughter of my dreams By Rachel Fell McDermott [৪]
- Tantric visions of the divine feminine: the ten mahāvidyās By David R. Kinsley [৫]
- The camphor flame: popular Hinduism and society in India By Christopher John Fuller [৬]