বরেন্দ্র বিদ্রোহ
বরেন্দ্র বিদ্রোহ হল কৈবর্ত সামন্ত রাজা দিব্যের নেতৃত্বে শুরু হওয়া তাদের তৎকালীন পাল রাজা দ্বিতীয় মহীপালের (১০৭০-১০৭৫) পাল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সংগঠিত একটি বিপ্লব। দশম-একাদশ শতকে বরেন্দ্রে মাৎস্যন্যায় প্রকট হয়ে উঠলে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই চরম অরাজকতা থেকে মুক্তি পাবার জন্য তৎকালীন বরেন্দ্রর সমস্ত সামন্ত শক্তি সম্মিলিত হয়েছিল। বিদ্রোহটি বাংলার উত্তরাংশে সংঘটিত হয়েছিল। এই বিদ্রোহের মাধ্যমে সামন্ত রাজা দিব্যক বরেন্দ্র ভূমিতে নিজের সার্বভৌম রাজ্য গড়তে সক্ষম হয়েছিলেন।[১][২]
কৈবর্ত বিদ্রোহ | |||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
| |||||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||||
|
প্রেক্ষাপট
সম্পাদনাপাল রাজারা বৌদ্ধ ছিল কিন্তু শেষের দিকের রাজারা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে প্রাধান্য দিতে থাকে, এবং ব্রাহ্মণ্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কৈবর্তসহ অন্যান্য অনন্ত সামন্তচক্রের ক্ষমতা ও অধিকার খর্ব করতে থাকে।[৩] উদ্ধন্নকৈবর্তবৃত্তিবহিকল ও ওসিন্নকৈবর্তবৃত্তি নামক অঞ্চলের সামন্ত ছিলেন বিদ্রোহী সামন্ত নেতা।[৪] রমেশচন্দ্র মজুমদার এটি সামন্ত বিদ্রোহ ও রোমিলা থাপর মতে, এটি মূলত কৃষক বিদ্রোহ; অনন্ত সামন্ত চক্র কৃষকদের বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত করেন।[৫] ঐতিহাসিক বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তী ও এইচএস কোটিয়াল এর মতে পাল রাজারা ও বিদ্রোহী সামন্ত নেতা উভয়েই কৈবর্ত বা মাহিষ্য ছিলেন।[৬][৭] সিংহাসন আরোহণের সময় পাল রাজা দ্বিতীয় মহীপাল তার দুই ভাই দ্বিতীয় শুরপাল ও দ্বিতীয় রামপালকে বন্দী করেন। ফলে বন্দী দুই ভাইয়ের কিছু স্থানীয় সামন্তও তার বিরুদ্ধে মহীপালের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।[১][৮]
পাল শাসনকে সাধারণত “স্বর্ণযুগ” বলে অভিহিত করা হয়। দেবপাল, ধর্মপালের শাসনের স্বর্ণযুগ পেরিয়ে যখন পাল শেষ দিকে আসতে থাকে তারা তাদের পুরনো গৌরব হারিয়ে ফেলে। ধীরে তাদের শাসন দুর্বল হতে থাকে ও অরাজকতা সৃষ্টি হতে থাকে। তাদের এই অরাজকতা থেকে রক্ষা পাওয়াই ছিল কৈবর্ত বিদ্রোহের প্রধান উদ্দেশ্য।[৯]
বিপ্লব
সম্পাদনাপাল আমলের সামন্ত রাজা দিব্য অনন্ত সামন্তচক্রের উদ্দেশ্যে বিদ্রোহের ডাক দেন। তারা এতে সাড়া দেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রাজ্যের বরেন্দ্রী অংশ অধীনে আনতে সক্ষম হয়। রাজা দ্বিতীয় মহীপাল আক্রমণ করতে গিয়ে যুদ্ধে নিহত হয় এবং এর ফলে পাল সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। স্বীয় ক্ষমতাবলে দিব্য বাংলাদেশের শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে বাংলায় একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। দিব্যর মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন তার ছোট ভাই রুদোক ও তারপরে রুদোক পুত্র ভীম(বরেন্দ্র রাজা)। ভীম নিজেকে একজন দক্ষ ও জনপ্রিয় শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন এবং ৩০ বছর বরেন্দ্র শাসন করেন। তিনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত বরেন্দ্রীকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। তাছাড়া ভীম সুবিধাভোগী ব্রাহ্মণদের থেকে কর আদায় করে সাধারণ প্রজার উন্নতিতে মন দেন।[১০] বাংলাদেশের নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার দিবর ইউনিয়নে দিবর দিঘী ও দিব্যা বিজয় স্তম্ভ আজও এই রাজবংশের স্মৃতিস্বরূপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। বর্তমান মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘিতেও একটি বিজয়স্তম্ভ ছিল বীর দিব্যক ভীমের কৈবর্ত বিদ্রোহের স্মৃতিস্বরূপ। তা পাল রাজ্য পুনরুদ্ধারের পর ভেঙ্গে ফেলা হয়।[১১] রাজা ভীমের শত শত কীর্তির মধ্যে ভীমের সাগর, ভীমের জাঙ্গাল, ভীমের ডাইং, ভীমের পান্টি প্রভৃতি দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া জেলার নানা স্থানে আজও বিদ্যমান থেকে তাঁর অস্লান কীর্তির সাক্ষ্য বহন করছে।[১১][১২][১৩][১৪]
বরেন্দ্রকে পুনরুদ্ধার
সম্পাদনারামপাল সিংহাসন লাভের পর ভীমের জনপ্রিয়তা, দক্ষতা, উদারতা দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হন। রামপালের অভিষেককালে পাল রাজাদের অধিকার সম্ভবত ভাগীরথী ও পদ্মার মধ্যবর্তী বদ্বীপ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু পরম পরাক্রমশালী রাজা ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সাহস রামপালের ছিলনা। আরও ভূমি হারানোর ভয়ে প্রতিবেশী ও সামান্তরাজাদেরকে অপরিমিত অর্থ ও ভূমি দান করেন এবং যুদ্ধের জন্য তারা সহযোগিতা করতে রাজি হয়। ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রামপালের সহায়ক ছিলেন তার মাতুল রাষ্ট্রকূট বংশীয় সামন্ত মথনদেব এবং তার দুই পুত্র ও এক ভ্রাতুষ্পুত্র । অন্যান্য চোদ্দ জন রাজা ও সামন্তরা যারা ছিলেন তাঁরা হলেন[১৫]-
- পীঠি ও মগধরাজ ভীমযশ
- কোটাটবীর রাজা বীরগুণ (বর্তমানে বিষ্ণুপুরের পূর্বে কোটেশ্বর)
- দণ্ডভুক্তির রাজা জয়সিংহ
- বাল-বলভীর অধিপতি বিক্রমরাজ (সম্ভবত মেদিনীপুরের পশ্চিম-দক্ষিণ সীমান্ত)
- অপার-মান্দারের অধিপতি লক্ষ্মীশুর (মন্দারন সরকারের পশ্চিমাংশ, বর্তমানে হুগলি জেলায়)
- কুজবটিরাজ শূরপাল (সাঁওতাল পরগনায়, নয়া দুমকর)
- তৈলকম্পপতি রুদ্রশেখর (বর্তমানে তেলকুপি, মানভূম জেলা)
- উচ্ছলাধিপতি ভাস্কর বা ময়গলসিংহ (বর্তমানে বীরভূমের উঝিয়াল পরগনা)
- কজঙ্গল মন্ডলাধিপতি নরসিংহার্জুন
- সংকট গ্রামীয় চন্ডার্জুন (সম্ভবত বর্তমান হুগলি জেলায়)
- ঢেক্কীয়রাজ প্রতাপসিংহ (কাটোয়া মহাকুমার ঢেকরি)
- নিদ্রাবলীর বিজয়রাজ
- কৌশম্বিপতি গোবর্ধন (রাজশাহী বা বগুড়ার কুসুম্বা বা কুসুম্বি পরগনা)
- পদুবন্বার সোম (বর্তমান পৌনান পরগনা)
ডি.সি. সরকারের মতে বিদ্রোহ দমনের জন্য রামপাল বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রায় দু-ডজন সামন্ত সংগ্রহ করেছিলেন। সম্মিলিত সৈন্যের সাথে ভীমের নবগঠিত রাষ্ট্রের পেরে ওঠা অনেকটা অসম্ভব ছিল। শাসক ও ভূস্বামীদের অত্যাচার ও অত্যধিক কর এর বিরুদ্ধে অনেক সাধারণ প্রজা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভীমের পক্ষে যোগ দিয়েছিল। গঙ্গার উত্তর তীরে যুদ্ধ করতে গিয়ে জীবিত অবস্থায় ভীম বন্দি হন। ভীমের অগণিত রাজকোষ পাল সেনারা লুণ্ঠন করে। কৈবর্ত বিদ্রোহ দমনে রামপাল অন্যান্য সামন্ত রাজাদের সাহায্য পেয়েছিলেন একথা সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতে উল্লেখ আছে।
ভীম বন্দী হওয়ার পর ভীমের অন্যতম সুহৃদ, বিশ্বস্ত হরি পরাজিত সৈনিকদের একত্রিত করেন এবং রামপালের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে লড়ার অঙ্গীকার করেন। হরির নেতৃত্বে যখন সেনারা যুদ্ধ জয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন রামপাল তার স্বর্ণকলস উজাড় করে দেয়ার মাধ্যমে তাদের বশীভূত করতে সক্ষম হন। এর মাধ্যমেই বরেন্দ্রীর স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার স্বপ্ন চিরতরের জন্য মৃত্যু লাভ করে এবং পুনরায় পাল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।[১]
বিদ্রোহীরা যেন আর কখনো রুখে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য তারা ভীমের কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। ভীমের পরিবারকে তার সামনে হত্যা করা হয় এবং ভীমকেও পরবর্তীকালে হত্যা করা হয়। পাল রাজারা এই বিদ্রোহ দমনে চরম নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছিলেন।[১১]
বিশ্লেষণ
সম্পাদনাদেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, কৈবর্ত বিদ্রোহের সাথে সিদ্ধ আন্দোলনের সম্পর্ক আছে। চুরাশি সিদ্ধের কাহিনী তাদের বিদ্রোহে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল।[১৬]
কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী লিখেছেন, কৈবর্তরা যদি পরাজিত না হতেন তাহলে নগর রচনা, জীবনবৃত্ত, শিল্প-সংস্কৃতি সবকিছুর একটি একান্ত দেশজ রূপ দেখা যেত...যে দেশজ রুপ ক্রমেই ব্যাপ্তভাবে বিকাশ হত, তা হত বাংলার মাটি থেকে জাত।[১৭]
ভীম ছিলেন শিব ও ভবানীর উপাসক। এর জন্য রামপাল বিদ্রোহীদের শান্ত করতে তার নতুন রাজধানীতে অনেক শিব মন্দির স্থাপন করেন।[১০]
ঐতিহাসিক রায়োসুকে ফুরুই উল্লেখ করেছেন[১৮]:
কৈবর্ত বিদ্রোহ ছিল বাংলার আদি মধ্যযুগের ইতিহাসে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটি সাময়িকভাবে পালদের তাদের পৈতৃক অঞ্চল বরেন্দ্র থেকে বিতাড়িত করে এবং অধস্তন শাসকদের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ চিরস্থায়ীভাবে দুর্বল করে দেয়। এর ফলে পরবর্তীতে পাল শক্তির পতন হয় এবং সেনদের উত্থানের পথ প্রশস্ত হয়।
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ রমেশচন্দ্র মজুমদার। "বাংলাদেশের ইতিহাস"।
- ↑ Thapar, Romila। Early India: From the Origins to AD 1300 (ইংরেজি ভাষায়)। University of California Press। আইএসবিএন 978-0-520-24225-8।
- ↑ Nath, R. M. (১৯৪৮)। Back-ground of Assamese culture। পৃষ্ঠা 114–120।
- ↑ Furui, Furui (২০০৯)। Prajñådhara। New Delhi: Kaveri Books। পৃষ্ঠা 322।
- ↑ Thapar, Romila (2004-02)। Early India: From the Origins to AD 1300 (ইংরেজি ভাষায়)। University of California Press। আইএসবিএন 978-0-520-24225-8। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য) - ↑ Bhandarkar, Devadatta Ramkrishna (১৯৩৯)। Indian Culture Vol. 6। পৃষ্ঠা 113–14।
- ↑ Kotiyal, H. S. (১৯৭৩)। "Sudra Rulers and Officials in Early Medieval Times"। Proceedings of the Indian History Congress। 34: 80–87। আইএসএসএন 2249-1937।
- ↑ Sengupta, Nitish K. (২০১১)। Land of Two Rivers: A History of Bengal from the Mahabharata to Mujib (ইংরেজি ভাষায়)। Penguin Books India। পৃষ্ঠা 64–67। আইএসবিএন 978-0-14-341678-4।
- ↑ Sharma, R. S.; Sharma, Ram Sharan (২০০৩)। Early Medieval Indian Society: A Study in Feudalisation (ইংরেজি ভাষায়)। Orient Blackswan। আইএসবিএন 978-81-250-2523-8।
- ↑ ক খ Sharma, R. S.; Sharma, Ram Sharan (২০০৩)। Early Medieval Indian Society (pb) (ইংরেজি ভাষায়)। Orient Blackswan। পৃষ্ঠা 221–226। আইএসবিএন 978-81-250-2523-8।
- ↑ ক খ গ সম্পাদনা অরূপ চন্দ্র (২০১৪)। বাংলায় হাজার বছরের কৃষক বিদ্রোহ ও মুর্শিদাবাদ। বহরমপুর: বাসভূমি প্রকাশন। পৃষ্ঠা ৭৩। উদ্ধৃতি ত্রুটি:
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; আলাদা বিষয়বস্তুর সঙ্গে ":0" নামটি একাধিক বার সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে - ↑ টেলিভিশন, Ekushey TV | একুশে। "কালের সাক্ষী নওগাঁর ঐতিহাসিক দিবর দীঘি"। Ekushey TV (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০২-১৫।
- ↑ প্রতিবেদক, নিজস্ব। "ভীমের পান্টি কি হারিয়েই যাবে"। দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০২-১৫।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "ভীমের জাঙ্গাল - বাংলাপিডিয়া"। bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০২-২৮।
- ↑ রায়, নীহাররঞ্জন। বাঙ্গালীর ইতিহাস- আদিপর্ব। কলকাতা: দে'জ পাবলিশিং। পৃষ্ঠা ৩৯৫–৩৯৬।
- ↑ চট্টোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ (১৯৮৮)। চুরাশি সিদ্ধার কাহিনী। কলকাতা: অনুষ্টুপ। পৃষ্ঠা ৫১–৬৬।
- ↑ দেবী, মহাশ্বেতা (১৯৯৪)। কৈবর্তখন্ড। কলকাতা: দে'জ পাবলিশিং।
- ↑ Furui, Ryosuke (২০১৪)। "Characteristics of Kaivarta Rebellion Delineated from the Rāmacarita"। Proceedings of the Indian History Congress। 75: 93–98। আইএসএসএন 2249-1937।
- ""বিদ্রোহী কৈবর্ত""। সত্যেন সেন
- Bibliography
- Sharma, Ram Sharan (২০০৩)। Early medieval Indian society: a study in feudalisation। Orient Longman। আইএসবিএন 8125025235। ওসিএলসি 77538061।