দিবর স্তম্ভ
দিবর স্তম্ভ বা দিব্যক জয়স্তম্ভ বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার পত্নীতলা থানার দিবর দিঘীর মধ্যস্থলে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। এ দিঘী স্থানীয় জনগনের কাছে কর্মকারের জলাশয় নামে পরিচিত। দিঘীটি ৪০/৫০ বিঘা বা ১/২ বর্গ মাইল জমির উপর অবস্থিত। দিবর দিঘীর মধ্যস্থলে অবস্থিত আটকোণ বিশিষ্ট গ্রানাইট পাথরের এতবড় স্তম্ভ বাংলাদেশে বিরল। এ স্তম্ভের সর্বমোট উচ্চতা ৩১ ফুট ৮ ইঞ্চি। পানির নিচের অংশ ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি এবং পানির উপরের অংশ (পরিদর্শন কালে জরিপের সময়) ২৫ ফুট ৫ ইঞ্চি। এ স্তম্ভে কোন লিপি নেই। স্তম্ভের উপরিভাগ খাঁজ কাটা অলঙ্করণ দ্বারা সুশোভিত।[১]
দিব্যক জয়স্তম্ভ | |
---|---|
সাধারণ তথ্যাবলী | |
অবস্থা | সম্পূর্ণ |
ধরন | স্তম্ভ |
স্থাপত্যশৈলী | প্রাচীন |
অবস্থান | রাজশাহী, বাংলাদেশ |
ঠিকানা | পত্নীতলা, নওগাঁ জেলা |
প্রতিষ্ঠা
সম্পাদনাদিবর দিঘীর মধ্যস্থিত জয়স্তম্ভ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ৩টি পৃথক মত পাওয়া যায়:
- এক: দ্বিতীয় মহিপাল কে পরাজিত ও হত্যা করার সাফল্য কে স্মরণীয় করে রাখতে দিব্যক এ জয় স্তম্ভ নির্মাণ করেন। দীনেশ চন্দ্র সেন “বৃহতৎ বঙ্গ” গ্রন্থে লিখেছেন – “কৈবর্তরাজ ভীমের খুল্ল পিতামহ দিব্বোক দ্বিতীয় মহিপাল কে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করিয়া বিজয়োল্লাসে যে স্তম্ভ উত্থাপিত করিয়াছিলেন তাহা এখনও রাজশাহী জেলার এক দিঘীর উপরে মস্তক উত্তোলন করিয়া বিদ্যমান”। উল্লেখ্য পূর্বে নওগাঁ রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
- দুই: দিব্যকের রাজত্ব কালে পাল যুবরাজ রামপাল বরেন্দ্র উদ্ধারের চেষ্টা করে দিব্যক এর নিকট পরাজিত হন। দিব্যক এই সাফল্যের স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে দিঘীর মধ্যস্থিত এ স্তম্ভ নির্মাণ করেন। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতের পরিচিতি পর্বে অনুবাদক বিজয় স্তম্ভ নির্মাণের করন সম্পর্কে নিম্নলিখিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন : “পূর্ববঙ্গের ভোজ বর্মার তাম্রশাসন হইতে জানা যায় দিব্যের বীরত্ব খ্যাতি তৎকালে উপমার বিষয় ছিল। অত্যল্পকালই বরেন্দ্রী দিব্যের রক্ষণাধীন থাকে। পূর্বোদ্ধৃত মনহলি লিপির ১৪শ শ্লোক ও রামচিরতের ১/২৯ শ্লোক একত্রে পাঠ করিলে জানা যায় দিব্যের রাজত্বকালে রামপাল (১০৮২ - ১১২৪) একবার পিতৃরাজ্য উদ্ধারে সচেষ্ট হইয়া ব্যর্থকাম হন। দিনাজপুর জেলার ( বর্তমানে নওগাঁ) দিবর দিঘী নামক জলাশয় ও তন্মধ্যস্থিত শিলাস্তম্ভ আজও তাহার স্মৃতি রক্ষা করিতেছে”।
- তিন: ভীম এ স্তম্ভটি নির্মাণ করেন এবং পিতৃব্য স্মৃতি রক্ষার্থে স্তম্ভটি তার নামে উৎসর্গ করেন। অধ্যাপক শিরিন আখতারের বিবরনে তার সমর্থন পাওয়া যায়। যে উদ্দেশ্যেই এ স্তম্ভটি নির্মিত হোক না কেন, এই দিবর দিঘী নামক জলাশয় ও তন্মধ্যস্থিত শিলাস্তম্ভটি দিব্যকের স্মৃতি অম্লান করে রেখেছে।
কাঠামো
সম্পাদনানওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার অন্যতম ঐতিহাসিক নিদর্শন দিবর দিঘীর দিব্যকের জয়স্তম্ভ। এই দিবর দিঘীর দিব্যকের জয়স্তম্ভকে ঘিরে গড়ে উঠেছে দীঘির চারপাশে মনোরম পরিবেশ। পাল আমলে খননকৃত ৬০ বিঘা দিঘীর মাঝখানে আশ্চর্যজনকভাবে স্থাপিত অখণ্ড গ্রানাইড পাথরের স্তম্ভ সূদুর অতীতের বাঙ্গালীর শৌর্যবীর্যের সাক্ষ্য বহন করছে আজও। উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক দিবর দিঘীটি নওগাঁ জেলা সদর হতে উত্তর পশ্চিমে ৫২ কি.মি. এবং পত্নীতলা সদর হতে ১৩ কি.মি. পশ্চিমে নজিপুর- সাপাহার রাস্তার পার্শ্বে দিবর ইউনিয়নের দিবর গ্রামে অবস্থিত।[২] এই দিবর দীঘির মাঝখানের স্তম্ভটির উচ্চতা ৩১ ফুটের মধ্যে পানির উপরিভাগে ১০ ফুট, পানির নিচে ১০ ফুট ও মাটির নিচে ১১ ফুট গ্রথীত আছে বলে জানা গেছে।
ইতিহাস
সম্পাদনাপাথরটির ইতিহাস নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। দ্বিতীয় মহিপাল ছিল দুর্বল ও চরিত্রহীন শাসক। দ্বিতীয় মহিপালের অযোগ্যতার কারণে বাংলায় অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। কিছু সেনাপতি ও বিপথগামী লোক এ সুযোগে দ্বিতীয় মহিপালকে হত্যা করে। দিব্যক সর্বসম্মতিক্রমে বরেন্দ্রভূমির অধিপতি নির্বাচিত হন। দিব্যকের শাসনামল ছিল ১০৭৫-১১০০ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় মহিপালের সময় তিনজন রাজা বাংলায় শাসন করেন। এরা হলেন দিব্যক, রুদ্রক ও ভীম। ব্রিটিশ ভারতীয় বিশিষ্ট ইতিহাস লেখক বুকারন হ্যামিলটনকে পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলে ঐতিহাসিক স্থানগুলোর উপর জরিপ করে একটি তালিকা প্রণয়নের জন্য এই অঞ্চলে পাঠান। তিনি ১৭৮৯ সালে দীঘির পার্শ্বে এসে উপস্থিত হন এবং জরিপ করেন। বুকারন হ্যামিলটন ঐ দিঘীটিকে কৈবর্ত্যদের বলে উল্লেখ করেন। তবে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ববিদ স্যার আলেকজান্ডার ক্যানিং হামের মতো, একাদশ শতাব্দির দিব্যকের ভ্রাতা রুদ্রকের পুত্র প্রখ্যাত নৃপতি ভীমের কীর্তি এটি। এ স্তম্ভের প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মাঝে মতবিরোধ থাকলেও আজ অবধি দিব্যকের কীর্তি বলে অত্রাঞ্চলে প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে। ধারণা করা হয, এই শাসনামলে পাল বংশকে পরাজিত করে বিজয় অর্জনের স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে দীঘির মাঝখানে জয়স্তম্ভ স্থাপন করা হয়। এটি একটি অখণ্ড পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে।[২] বর্তমান মুর্শিদাবাদে সাগরদিঘীতেও দিব্যকের অভিযান হয়েছিল এবং সেই স্থানে একটি বিজয়স্তম্ভ প্রোথিত হয়। রামপাল কর্তৃক সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের পরে এটি ভেংগে ফেলা হয়েছিল।[৩]
আরো দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Pratidin, Bangladesh (২০১৯-০১-২২)। "নওগাঁয় এক রাতে তৈরি ঐতিহাসিক দিবর দীঘি"। বাংলাদেশ প্রতিদিন। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-০৩।
- ↑ ক খ "দৈনিক সংগ্রাম ওয়েব সংস্করণ"। দিব্যক জয়স্তম্ভ। ৬ সেপ্টেম্বর ২০১২।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ সম্পাদনা অরূপ চন্দ্র (২০১৪)। বাংলায় হাজার বছরের কৃষক বিদ্রোহ ও মুর্শিদাবাদ। বহরমপুর: বাসভূমি প্রকাশন। পৃষ্ঠা ৭৮।