উইকিপিডিয়া:উইকিপত্রিকা/মাঘ ১৪৩১/সাধারণ

সাধারণ

উইকিপিডিয়া, সাধু ভাষা ও চলিত ভাষা

উইকিপিডিয়ায় সাধু ভাষায় লিখা হয়তো বর্ত্তমান কালে নিরেট একখানা স্বপ্ন। কিন্তু বাংলা চলিত ভাষার এতো এতো লাগামহীন পরিবর্তনের কারণে খুব বেশিদিন ইহার চর্চা থাকিবেনা বলিয়াই অনুমিত হয়। ইহা ব্যতীত ভাষার মাধুর্য্যের কথা তো আমি পূর্বেই লিখিয়াছি। ভাষার মাধুর্য্যের জন্যই খুব সম্ভবতঃ লিখক জাতি চলিত ভাষা ছাড়িয়া সাধু ভাষায় চলিয়া আসিবেন।

কেবল উইকিপিডিয়াই নহে, তাবৎ পত্র-পত্রিকা আর বই-পত্তরে চলিত ভাষা দেখিয়া আমার বোধ হয় যেন কেহ বাংলা ভাষার সঞ্জীবনী ছিনাইয়া লইতেছে। যদিওবা চলিত ভাষা মানুষের মুখের কাছাকাছি বলিয়া লিখিতে সহজ, কিন্তু এই ভাষায় লিখিবার কিংবা পড়িবার আনন্দ নিতান্তই গৌণ বলিয়াই বোধগম্য হইবে। অন্যান্য ভাষার দিকে তাকাইয়া দেখুন, সেইসব ভাষার পদ্য ও গদ্য অদ্যাবধি কিরূপ রাজকীয়ভাবে স্বীয় দায়িত্ব পালন করিয়া যাইতেছে। বাংলা চলিতরূপের প্রসারের কারণেই ইহার মধ্যে পুরাতন সেই ঐশ্বর্য্য আর বাকি নাই। উর্দু ভাষার প্রতি এই কারণে কখনও কখনও আমি বেশ ঈর্ষান্বিত হই। ঐ ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব দেখুন না, আজকেও ঐ ভাষার পাঠদান পাকিস্তান কিংবা ভারত দেশে শ্রেষ্ঠ পর্যায়ের কর্ম্ম বলিয়া গণ্য হয়। যদিও বাংলা ভাষার অধ্যাপকগণও বাংলাদেশ কিংবা ভারতে সম্মান পাইয়া থাকেন, কিন্তু সেই সম্মান পাওয়া কেবলই অধ্যাপনার কারণেই হইয়া থাকে; এর সাথে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্বের দূর দূর সম্পর্ক নাই। ঐসমস্ত দেশে যখন কাব্যচর্চার জন্য শায়েরী-মুশায়েরার আসর বসে, কতো গুণীজন সেখানে যাইয়া স্বীয় পদধূলি দিয়া আসিতে প্রাধান্য দিয়া থাকেন।

উইকিপিডিয়া লইয়া যদ্যাবধি সম্পাদনা-আরাধনা করিয়া আসিতেছি, কাহাকেও পাই নাই যিনি উইকিপিডিয়াকে সাধু ভাষায় রূপ দিতে চাহেন। সবাই হয়তো স্রোতের দিকেই বহিয়া যাইতে পছন্দ করিয়া থাকিবেন। আমিও বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে বিষয়টি লইয়া নীরবতাই অবলম্বন করিয়া আসিয়াছি অথবা স্রোতের সঙ্গেই তাল মিলাইয়া চলিতে পছন্দ করিয়া আসিতেছি। উইকিপিডিয়ার ভগিনীপ্রকল্প উইকিসংকলনে কখনও কখনও এই কারণেই গিয়া শান্তি লইয়া আসি, সেইস্থানে পুরাতন বই-পত্তর লইয়া কাজ হইয়া থাকে। সেইসব বই পড়িতে কতোই না আনন্দ! কেহ বুঝি কোমল আর মোলায়েম শব্দগুলি আমার মনের মধ্যে স্পর্শ করাইয়া দিতেছে।

আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমদিকে সাধু ভাষায় লিখালিখি আরম্ভ করিলেও খুব দ্রুতই লিখার ধারা পরিবর্তন করিয়া লন। তাহার লিখা পরিবর্তন করিতে আমাদের প্রিয় লিখক প্রমথ চৌধুরীর অবদান উল্লেখ্যভাবে বলা হইয়া থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বীয় মনমাধুরী আর লিখিবার শক্তিবলে হয়তোবা গীতাঞ্জলী লিখিয়াছিলেন, কিন্তু কবিগুরুর পরবর্তী সময়ে ভিন্ন কাহাকেও পাওয়া যাইবেনা, যিনি ভাষাকে এতোখানি মাধুর্য্য দিতে পারিয়াছেন। অন্যান্য সাহিত্যিকদের আমি ছোট করিতেছি না, তাহারা স্বীয় সময়ে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু হয়তোবা সাধু ভাষার এতো নিকটবর্ত্তী কালে থাকিবার কারণেই কবিগুরু এতো সুন্দর করিয়া ভাষার ব্যবহার করিতে পারিয়াছিলেন। পরবর্তী ব্যক্তিবর্গ সাধু ভাষা কেবলই পড়িবার জন্যই চর্চা করিয়াছেন, নিজে চর্চা নিতান্তই গৌণ সংখ্যক মানুষ করিয়াছেন।

উইকিপিডিয়ায় সাধু ভাষায় লিখা হয়তো বর্ত্তমান কালে নিরেট একখানা স্বপ্ন। কিন্তু বাংলা চলিত ভাষার এতো এতো লাগামহীন পরিবর্তনের কারণে খুব বেশিদিন ইহার চর্চা থাকিবেনা বলিয়াই অনুমিত হয়। ইহা ব্যতীত ভাষার মাধুর্য্যের কথা তো আমি পূর্বেই লিখিয়াছি। ভাষার মাধুর্য্যের জন্যই খুব সম্ভবতঃ লিখক জাতি চলিত ভাষা ছাড়িয়া সাধু ভাষায় চলিয়া আসিবেন। অন্যান্য ভাষাগুলি দেখুন, ইংরাজি ভাষায় কথা বলা শিক্ষা করা কতোই না সহজ। তথাপি, শেক্সপিয়র সাহেবের লিখা বুঝিতে পারা ভিন্নরূপের যোগ্যতা। ইহা ব্যতীতও আপনি কি সাধারণ ইংরাজি শিখিয়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীতের মর্ম উপলব্ধি করিতে পারিবেন? কক্ষনোই না। উর্দু ভাষার বিষয়টিও দেখুন, আল্লামা ইকবাল কিংবা জন এলিয়ার লিখা বুঝে, এমন উর্দুভাষী কি খুব বেশী? অথচ ভারত ও পাকিস্তানের পৃথক পৃথক শিক্ষালয়ে মির্জা গালিবের চর্চাও দেখিয়াছি। যেইখানে গত শতাব্দীর উর্দু লিখকদের লিখা বুঝাই দুরূহ কার্য।

আমাদের কবিগুরু এবং অন্যান্য চলিত ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া কবি-সাহিত্যিকরা হয়তো বাংলা ভাষার উপর সংস্কৃতের প্রভাবকে অপসারণ করিতে চাহিতেন। কিন্তু একখানা প্রচলিত ভাষার একখানা শ্রেণীকে অপসারণ করা কি খুবই সহজ? অভিধান খুলিয়াই দেখুন, কতগুলি শব্দ অদ্যাবধি আমরা সংস্কৃতের অনুরূপ ব্যবহার করিতেছি। আমি কাহাকেও বলিতেছিলাম, আমরা সংস্কৃতের অপ্রয়োজনীয় দিকখানা রাখিয়া দিয়াছি, প্রয়োজনীয় দিক বর্জন করিয়াছি। নচেৎ যাহারা চাহেন সংস্কৃতের প্রভাব বর্জন করিতে তাহাদের উচিত ছিল, নতুন শব্দ আবিষ্কার করা ও সংস্কৃত শব্দ বর্জন করা। সেইখানে তাহারা পুরাতন শব্দ বর্জন না করিয়াই কেবলই সুন্দর নীতিগুলি বর্জন করিয়াছেন।

অন্যের সমালোচনা তো অনেক করিলাম, এক্ষণে স্বীয় কার্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করি। আমি যদ্যপি চাহি যে, সাধু ভাষা প্রচলিত হউক, তথাপি আমার দ্বারা ইহার প্রতি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা সম্ভব হইয়া উঠে নাই। আমি অন্যদের ন্যায় সদাই কল্পনা করিয়া যাই, ঈশ্বরের পক্ষ হইতে কোনো দেবতুল্য মানব আসিবেন ও সঠিক সঠিক বিষয়গুলি প্রচলিত করিবেন। আমার মনে হইতেছে না যে, ইহজন্মে এই স্বপ্ন সত্য হইবে। তবুও স্বপ্ন দেখিতে দোষ কী?