কঠিন অবস্থা পদার্থবিজ্ঞান
কঠিন অবস্থার পদার্থবিজ্ঞান (English: Solid-State Physics) হলো কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান, কেলাসবিজ্ঞান, তড়িচ্চুম্বকত্ব এবং ধাতুবিজ্ঞান মতো পদ্ধতির মাধ্যমে অনমনীয় বা কঠিন পদার্থের আলোচনা। এটি ঘনীভূত পদার্থের পদার্থবিজ্ঞানের বৃহত্তম শাখা। কঠিন অবস্থার পদার্থবিজ্ঞান আলোচনা করে কীভাবে কঠিন পদার্থের বৃহৎ বৈশিষ্ট্যগুলি তাদের পারমাণবিক-স্কেল বৈশিষ্ট্য থেকে ফলাফল দেয়। তাই বলা যায়, কঠিন অবস্থা পদার্থবিজ্ঞান উপাদান বিজ্ঞানের (Materials Science) একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি গঠন করে। ট্রানজিস্টর (Transistor) এবং অর্ধপরিবাহীর (Semiconductor) মতো প্রযুক্তিতে এর প্রত্যক্ষ ব্যবহার বা প্রয়োগ রয়েছে।
পটভূমি
সম্পাদনাকঠিন পদার্থে পরমাণুর ঘণত্ব অনেক বেশি হয় এবং পরমাণু গুলো তীব্রভাবে পরস্পরের উপর ক্রিয়া করে। এবং পরমাণু গুলোর এই ক্রিয়া বিভিন্ন যান্ত্রিক (যেমন কঠোরতা এবং স্থিতিস্থাপকতা), তাপীয়, বৈদ্যুতিক, চৌম্বকীয় এবং আলোকিয় বা অপটিক্যাল বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী। কঠিন পদার্থের পরমাণুগুলো হতে পারে নিয়মিত, অনিয়মিত অথবা জ্যামিতিক আকারে সজ্জিত, যেটি নির্ভর করে ঐ পদার্থ কি কি উপাদান দিয়ে তৈরী।
সাধারণত কঠিন অবস্থার পদার্থবিজ্ঞানে ক্রিস্টাল বা স্ফটিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। মূলত, কারণ এটি একটি ক্রিস্টালের মধ্যে পরমাণুর পর্যায়ক্রমিকতা গাণিতিক প্যাটার্ণ তৈরী করে এবং ক্রিস্টালের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। তেমনিভাবে, ক্রিস্টালের উপাদানগুলিতে প্রায়শই বৈদ্যুতিক, চৌম্বকীয়, অপটিক্যাল বা যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকে যা প্রকৌশল উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ক্রিস্টালের মধ্যে পরমাণুগুলো বিভিন্ন বল (Force) দ্বারা আবদ্ধ থাকে। যেমন সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl) (যা সাধারণত 'লবণ' নামে পরিচিত) এর ক্রিস্টাল আয়নিক সোডিয়াম (Na+) ও আয়নিক ক্লোরিন (Cl-) দিয়ে গঠিত হয়, এবং এরা আয়নিক বন্ধনের মাধ্যমে পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকে। অন্য কথায়, পরমাণুগুলি ইলেকট্রন শেয়ার করে এবং সমযোজী বন্ধন তৈরি করে। কিন্তু, নিষ্ক্রিয় গ্যাসসমূহ এই ধরনের বন্ধন তৈরী করে না। কঠিন অবস্থায়, নিষ্ক্রিয় গ্যাসসমূহের পরমাণুগুলো ভ্যানডার-ওয়ালস বন্ধনের (Van der Waals force) মাধ্যমে যুক্ত থাকে যা প্রতিটি পরমাণুর বৈদ্যুতিক চার্জের মেঘের মেরুকরণের ফলে সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন ধরনের বন্ধন ঐ কঠিন পদার্থের বিভিন্ন বৈশিষ্টের কারণ।
ইতিহাস
সম্পাদনাকঠিন পদার্থের ভৌত বৈশিষ্ট্যগুলি বহু শতাব্দী ধরে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের বিষয় ছিল, তবে আমেরিকান ফিজিকাল সোসাইটির কঠিন অবস্থার পদার্থবিজ্ঞান বা সলিড-স্টেট ফিজিক্স বিভাগ (ডিএসএসপি বা DSSP: Department of Solid State Physics) প্রতিষ্ঠার সময় ১৯৪০ এর দশক পর্যন্ত কঠিন অবস্থার পদার্থবিজ্ঞান বা সলিড-স্টেট ফিজিক্স নামে বিজ্ঞানের পৃথক কোনো শাখার উদ্ভব হয়নি। ডিএসএসপি শিল্প পদার্থবিজ্ঞানী প্রস্তুত করে এবং তারা কঠিন পদার্থগুলির উপর গবেষণা শুরু করেন এবং এর প্রযুক্তিগত প্রয়োগগুলির সাথে যুক্ত হন। ১৯৬১ এর দশকের গোড়ার দিকে, ডিএসএসপি আমেরিকান ফিজিকাল সোসাইটির বৃহত্তম বিভাগ ছিল।[১][২]
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপে, বিশেষত ইংল্যান্ড, জার্মানি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে কঠিন অবস্থার পদার্থবিদদের বৃহৎ জনগোষ্ঠীও উদ্ভূত হয়েছিল।[৩] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে অর্ধপরিবাহী, সুপারকন্ডাক্টিভিটি, পারমাণবিক চৌম্বকীয় অনুরণন এবং অন্যান্য বিষয় গবেষণার মাধ্যমে কঠিন অবস্থার পদার্থবিজ্ঞান একটি বিশিষ্ট ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। শৈত্য যুদ্ধের (Cold War) প্রথমদিকে, কঠিন অবস্থার পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাগুলি শুধুই কঠিন পদার্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, যা ঘন তরল, প্লাজমা গবেষণার জন্যও ব্যবহৃত সাধারণ কৌশলগুলির চারপাশে সংগঠিত হয়েছিল। ১৯৭০ এবং ১৯৮০ এর দশকে কিছু পদার্থবিজ্ঞানী ঘনীভূত পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্র এবং অন্যান্য জটিল বিষয় অনুসন্ধান করেছিল।[১] বর্তমানে কঠিন অবস্থার পদার্থবিজ্ঞানকে ঘনীভূত পদার্থের পদার্থবিজ্ঞানের বিস্তৃত উপশাখা হিসাবে বিবেচনা করা হয়, এবং প্রায়শই এটাকে অতি-ঘনীভূত পদার্থবিজ্ঞান বা হার্ড কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্স (Hard Condensed Matter Physics) হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
ক্রিস্টাল কাঠামো এবং বৈশিষ্ট্যাবলী
সম্পাদনাপদার্থের অনেক বৈশিষ্ট্য তাদের ক্রিস্টাল কাঠামো দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই কাঠামোটি এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি, নিউট্রন বিচ্ছুরণ এবং ইলেক্ট্রনের বিচ্ছিন্নতা সহ বিভিন্ন ক্রিস্টালগ্রাফিক কৌশল ব্যবহার করে তদন্ত করা যেতে পারে।
কঠিন পদার্থে প্রত্যেক ক্রিস্টালের আকার নির্ভর করে পদার্থটি কোন কোন উপাদান দিয়ে গঠিত এবং গঠিত হওয়ার সময় কোন অবস্থায় ছিল। প্রতিদিনের জীবনের বেশিরভাগ ক্রিস্টালের উপাদানগুলি হলো পলিক্রিস্টাললাইন, স্বতন্ত্র ক্রিস্টালগুলি আকারে মাইক্রোস্কোপিক হয় তবে ম্যাক্রোস্কোপিক একক ক্রিস্টাল প্রাকৃতিকভাবে (উদাঃ হীরা) বা কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত হতে পারে।
বাস্তব স্ফটিকগুলি আদর্শ ব্যবস্থায় ত্রুটিপূর্ণ। এবং এই ত্রুটিগুলিই পদার্থের বৈদ্যুতিক এবং যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি নির্ধারণ করে থাকে।
ইলেকট্রনিক বৈশিষ্ট্যাবলী
সম্পাদনাকঠিন অবস্থার পদার্থবিজ্ঞানে পদার্থের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যেমন বিদ্যুৎ পরিবাহিতা, তাপীয় ক্ষমতা ইত্যাদি গবেষণা করা হয়। বৈদ্যুৎ পরিবহনের একটি প্রাথমিক মডেল ছিল ড্রড মডেল (Drude model), যা পদার্থের ইলেকট্রনে গতিশীলতার তত্ত্ব প্রয়োগ করে। পদার্থে স্থিতিশীল পজিটিভ আয়ন এবং নন-ইন্টারেক্টিভ ইলেকট্রনগুলির একটি "বৈদ্যুতিক গ্যাস" রয়েছে বলে ধরে নিয়ে, ড্রুড মডেলটি বৈদ্যুতিক এবং তাপীয় পরিবাহিতা এবং ধাতব ক্ষেত্রে হলের প্রভাব সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছিল, যদিও এটি বৈদ্যুতিক তাপের ক্ষমতাকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছিল।
আর্নল্ড সামারফেল্ড ক্লাসিকাল ড্রুড মডেলকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে ফ্রি ইলেক্ট্রন মডেল (বা ড্রড-সোমারফিল্ড মডেল) এর সাথে একত্রিত করেন। এখানে, ইলেক্ট্রনগুলি ফার্মি গ্যাস হিসাবে মডেল করা হয়। ফার্মি গ্যাস হলো এমন একটি কণার গ্যাস যা কোয়ান্টাম মেকানিকাল ফার্মি-ডািরাকের পরিসংখ্যান মেনে চলে। ফ্রি ইলেকট্রন মডেল ধাতব পদার্থের তাপীয় ক্ষমতার উন্নত পূর্বাভাস দিয়েছে, তবে এটি ইনসুলেটরের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করতে পারে নি।
'দি নিয়ারলি ইলেক্ট্রন মডেল' হ'ল ফ্রি ইলেকট্রন মডেলটির একটি পরিবর্তন যা একটি ক্রিস্টালের শক্তিতে বাহিত ইলেক্ট্রন এবং আয়নের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া করার জন্য একটি দুর্বল পর্যায়ক্রমিক ক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করে। বৈদ্যুতিন বন্ধনের ধারণা প্রবর্তনের মাধ্যমে তত্ত্বটি পরিবাহী, অর্ধপরিবাহী এবং ইনসুলেটরের অস্তিত্বের ব্যাখ্যা দেয়।
'দি নিয়ারলি ইলেক্ট্রন মডেল' পর্যায়ক্রমিক সম্ভাবনার ক্ষেত্রে শ্রাইডিনগার সমীকরণটি মেনে চলে। এই ক্ষেত্রে সমাধানগুলি 'ব্লুচ স্টেটস' বা 'ব্লচের উপপাদ্য' নামে পরিচিত।
যেহেতু ব্লচের উপপাদ্য শুধুমাত্র সাময়িক সম্ভাবনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, এবং যেহেতু একটি ক্রিস্টাল বিচ্ছিন্ন সময়কালে পরমাণুগুলির এলোমেলো আন্দোলনকে অবিরত করে দেয়, তাই ব্লচের এই উপপাদ্যটির ব্যবহার কেবলমাত্র একটি আনুমান, তবে এটি একটি অত্যন্ত মূল্যবান সমীকরণ হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে, যা ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কঠিন অবস্থার পদার্থবিজ্ঞান ক্রিস্টাল কাঠামো এবং বৈশিষ্ট্যাবলী বিশ্লেষণে অক্ষম হবে।
আধুনিক গবেষণা
সম্পাদনাকঠিন অবস্থার পদার্থবিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণার বিষয়গুলির মধ্যে রয়েছে:
- উচ্চ-তাপমাত্রা অতিপরিবাহিতা (High-Temperature Superconductivity)
- কোয়াসি-কেলাস (Quasicrystal)
- স্পিন গ্লাস (Spin glass)
- পরম্পর দৃঢ়ভাবে সম্পর্কযুক্ত উপাদান (Strongly correlated material)
- দ্বি-মাত্রিক বস্তুসমুহ (Two-Dimensional Materials)
- ন্যানোম্যাটেরিয়ালস (Nanomaterials)
আরও দেখুন
সম্পাদনা- ঘনীভূত পদার্থের পদার্থবিজ্ঞান (Condensed Matter Physics)
- কেলাসবিজ্ঞান (Crystallography)
- নিউক্লিয়ার স্পেকট্রোস্কোপি (Nuclear spectroscopy)
আরও পড়ুন
সম্পাদনা- Neil W. Ashcroft and N. David Mermin, Solid State Physics (Harcourt: Orlando, 1976).
- Charles Kittel, Introduction to Solid State Physics (Wiley: New York, 2004).
- H. M. Rosenberg, The Solid State (Oxford University Press: Oxford, 1995).
- Steven H. Simon, The Oxford Solid State Basics (Oxford University Press: Oxford, 2013).
- Out of the Crystal Maze. Chapters from the History of Solid State Physics, ed. Lillian Hoddeson, Ernest Braun, Jürgen Teichmann, Spencer Weart (Oxford: Oxford University Press, 1992).
- M. A. Omar, Elementary Solid State Physics (Revised Printing, Addison-Wesley, 1993)
- Hofmann, Philip (2015-05-26). Solid State Physics (2 ed.). Wiley-VCH. ISBN 978-3527412822
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ Martin, Joseph D. (২০১৫)। ""What's in a Name Change? Solid State Physics, Condensed Matter Physics, and Materials Science"" (পিডিএফ)। Physics in Perspective।
- ↑ Hoddeson, Lillian (১৯৯২)। Out of the Crystal Maze: Chapters from The History of Solid State Physics। Oxford University Press। আইএসবিএন 9780195053296।
- ↑ Hoffmann, Dieter (২০১৩)। "Fifty Years of Physica Status Solidi in Historical Perspective"। Physica Status Solidi B।