সন্ধি
সন্ধি বাংলা ব্যাকরণে শব্দগঠনের একটি মাধ্যম। এর অর্থ মিলন। সন্নিহিত দুটি ধ্বনি মিলিয়ে একটি ধ্বনিতে পরিণত হওয়াকে বা পরস্পর সন্নিহিত দুই বর্ণের মিলনকে সন্ধি বলে। সন্ধি বাংলা ব্যাকরণের ধ্বনিতত্ব অংশে আলোচিত হয়। ধ্বনিগত মাধুর্য এবং স্বাভাবিক উচ্চারণে সহজপ্রবণতা সন্ধির উদ্দেশ্য। যেকোনো পদের সঙ্গে সন্ধি হয়ে নতুন শব্দ তৈরি হতে পারে। তবে বাংলা অব্যয় পদের সঙ্গে সন্ধি হয় না।
সন্ধির দ্বারা দুটি শব্দকে মিলিয়ে একটি নতুন শব্দ তৈরি করা হয়। যেমন — দেব শব্দটির অর্থ দেবতা এবং আলয় শব্দের অর্থ গৃহ। এই দুটি শব্দ মিলে তৈরি হয় দেবালয়, যার অর্থ দেবতার থাকার স্থান বা গৃহ।
ধারণা
সন্ধি শব্দটির বিশ্লেষিত রূপ সম + √ধি + ই,[ক][১] অর্থাৎ সমদিকে ধাবিত হওয়া বা মিলিত হওয়া। বাংলা ব্যাকরণমতে, দুটি শব্দের মধ্যে প্রথম শব্দের শেষ ধ্বনি এবং দ্বিতীয় শব্দের প্রথম ধ্বনি যদি একইভাবে উচ্চারিত হয় বা তাদের উচ্চারণ প্রায় কাছাকাছি হয় তবে ধ্বনিদ্বয় পরস্পর সংযুক্ত হওয়া অর্থাৎ শব্দ দুটি মিলিত হয়ে এক শব্দে পরিণত হলে সেখানে সন্ধি হয়।[২] উদাহরণস্বরূপ, বিদ্যা + আলয় = বিদ্যালয়। এখানে বিদ্যা ও আলয় শব্দদ্বয় মিলিত হয়ে বিদ্যালয় শব্দটি গঠন করেছে।
উদ্দ্যেশ্য
সন্ধির উদ্দেশ্য হল:
- বাক্যকে সুন্দর, প্রাঞ্জল ও সহজবোধ্য করা।
- নতুন শব্দ তৈরি করা।
- শব্দকে সংক্ষিপ্ত করা।
- বাক্যকে সংক্ষিপ্ত করা।
- উচ্চারণে স্বাচ্ছন্দ্য আসে।
- ধ্বনিগত মাধুর্য রক্ষা করা।
প্রকারভেদ
সন্ধি প্রধানত দুই প্রকার।
- বাংলা সন্ধি
- তৎসম সন্ধি
- বাংলা সন্ধি ২ প্রকার।
- তৎসম সন্ধি তিন প্রকার।
স্বরসন্ধি
স্বরধ্বনির সাথে স্বরধ্বনির সন্ধি হলে স্বরসন্ধি হয়। যেমন, সিংহাসন = সিংহ + আসন (সিংহ = স্+ই+ং+হ্+অ ; আসন = আ+স্+অ+ন্+অ), বিদ্যালয় = বিদ্যা + আলয়, হিমালয় = হিম + আলয়।
- নিয়ম
১. অ/আ + অ/আ = আ
উদাহরণ: সিংহাসন = সিংহ + আসন (স্+ই+ং+হ্+অ + আ+স্+অ+ন্+অ = স্+ই+ং+হ্+আ+স্+অ+ন্+অ = সিংহাসন)
২. ই/ঈ + ই/ঈ = ঈ
উদাহরণ: সতীশ = সতী + ঈশ (স্+অ+ত্+ঈ + ঈ+শ্+অ = স্+অ+ত্+ঈ+শ্+অ = সতীশ)
৩. উ/ঊ + উ/ঊ =ঊ
উদাহরণ: বধূৎসব = বধূ + উৎসব (ব্+অ+ধ্+ঊ + উ+ত্+স্+অ+ব্+অ = ব্+অ+ধ্+ঊ+ত্+স্+অ+ব্+অ = বধূৎসব)
৪. অ/আ + ই/ঈ = এ
উদাহরণ: মহেশ = মহা + ঈশ (ম্+অ+হ্+আ + ঈ+শ্+অ = ম্+অ+হ্+এ+শ্+অ = মহেশ)
৫. অ/আ + উ/ঊ = ও
উদাহরণ: বঙ্গোপসাগর = বঙ্গ + উপসাগর (ব্+অ+ঙ্+গ্+অ + উ+প্+অ+স্+আ+গ্+অ+র্+অ = ব্+অ+ঙ্+গ্+ও+প্+অ+স্+আ+গ্+অ+র্+অ = বঙ্গোপসাগর)
৬. অ/আ + ঋ = অর্
উদাহরণ: সপ্তর্ষি = সপ্ত + ঋষি (স্+অ+প্+ত্+অ + ঋ+ষ্+ই = স্+অ+প্+ত্+অ+র্+ষ্+ই = সপ্তর্ষি)
৭. আ/আ + ঋত = আর্
উদাহরণ: ক্ষুধা + ঋত = ক্ষুধার্ত
৮. অ/আ + এ/ঐ = ঐ
উদাহরণ: জনৈক = জন + এক
৯. অ/আ + ও/ঔ = ঔ
উদাহরণ: পরমৌষধ = পরম + ঔষধ
বনৌষধি= বন+ ওষধি
১০. ই/ঈ + ই/ঈ ছাড়া অন্য স্বরবর্ণ = ্য
উদাহরণ: ন্যূন = নি + ঊন
১১. উ/ঊ + উ/ঊ ছাড়া অন্য স্বরবর্ণ = ্ব
উদাহরণ: অনু + অয় = অন্বয়
১২. ঋ + ঋ ছাড়া অন্য স্বরবর্ণ = ্র্
উদাহরণ: পিত্রিচ্ছা = পিতৃ + ইচ্ছা
১৩. এ + অন্য স্বরবর্ণ = অয়্
উদাহরণ: নয়ন = নে + অন
১৪. ঐ + অন্য স্বরবর্ণ = আয়্
উদাহরণ: গায়ক = গৈ + অক
১৫. ও + অন্য স্বরবর্ণ = অব্
উদাহরণ: গবেষণা = গো + এষণা
১৬. ঔ + ও/ঔ ছাড়া অন্য স্বরবর্ণ = আব্
উদাহরণ: নাবিক = নৌ + ইক
ব্যঞ্জনসন্ধি
স্বরে আর ব্যঞ্জনে অথবা ব্যঞ্জনে ও ব্যঞ্জনে অথবা ব্যঞ্জনে ও স্বরে সন্ধি হলে ব্যঞ্জন সন্ধি হয়। যেমন, বিপজ্জনক = বিপদ + জনক (বিপদ = ব্+ই+প্+অ+দ্+অ; জনক = জ্+অ+ন্+অ+ক্+অ)। ব্যঞ্জনসন্ধি মূলত কথ্য রীতিতে সীমাবদ্ধ। প্রকৃত বাংলা ব্যঞ্জন সন্ধি মূলত সমীভবনের নিয়মে হয়ে থাকে।
- নিয়ম
১. বর্গের প্রথম বর্ণ (ক, চ, ট, ত/ৎ, প) + স্বরবর্ণ = বর্গের তৃতীয় বর্ণ (গ, জ, ড/ড়, দ, ব)
ষড়ঋতু = ষট্ + ঋতু
২. বর্গের প্রথম বর্ণ + বর্গের পঞ্চম বর্ণ = বর্গের প্রথম বর্ণ বদলে সেই বর্গেরই পঞ্চম বর্ণ হয়
মৃন্ময় = মৃৎ + ময়
৩. ত/দ + জ/ঝ = জ্জ/জ্ঝ
বিপজ্জনক = বিপদ্ + জনক
৪. ত/দ + চ/ছ = চ্চ/চ্ছ
উচ্ছেদ = উৎ + ছেদ
৫. ত/দ + ল = ল্ল
তল্লিখিত = তদ্ + লিখিত
৬. ম + স্পর্শবর্ণ (ক-ম) = ম বদলে ং হয়, অথবা যেই বর্গের স্পর্শবর্ণ সেই বর্গেরই পঞ্চম বর্ণ হয়
সংগীত/সঙ্গীত = সম্ + গীত
৭. ম + অন্তঃস্থ বর্ণ (য, র, ল, ব)/ উষ্মবর্ণ (শ, ষ, স, হ) = ম বদলে ং হয়
বশংবদ = বশম্ + বদ
৮. স্বরবর্ণ + ছ = চ্ছ
পরিচ্ছেদ = পরি + ছেদ
৯. ত/দ + হ = দ্ধ
উদ্ধত = উৎ + হত
১০. ত-বর্গীয় বর্ণ (ত, থ, দ, ধ) + শ = চ্ছ
উচ্ছ্বাস = উৎ + শ্বাস
১১. শ/ষ + ত = ষ্ট
দৃষ্টি = দৃশ্ + তি
১২. শ/ষ + থ = ষ্ঠ
ষষ্ঠ = ষষ্ + থ
বিসর্গসন্ধি
বিসর্গসন্ধি ব্যঞ্জন সন্ধির অন্তর্গত। বিসর্গ সন্ধির প্রকারভেদগুলো হচ্ছেঃ র জাত বিসর্গ এবং স জাত বিসর্গ। বিসর্গসন্ধি র্ ও স্ এর সংক্ষিপ্ত রূপ। যেমন, আশীর্বাদ = আশীঃ + বাদ (আশীঃ = আ+শ্+ঈ+ঃ; বাদ = ব্+আ+দ্+অ)
- নিয়ম
১. 'ক','খ','গ','ফ' পরে থাকলে অ,আ ধ্বনির পরস্থিত বিসর্গ স্থলে দন্ত্য শিশ ধ্বনি 'স' হয়, অ,আ ব্যতীত অন্যধ্বনির পরস্থিত বিসর্গ স্থলে মূর্ধন্য শিশ 'ষ' হয়।
উদাহরণ: পরিস্কার= পরিঃ + কার, নিষ্কর= নিঃ + কর
২. অ + ঃ + অ থাকলে তিনে মিলে 'ও' কার হয়।
উদাহরণ: ততোধিক= ততঃ + অধিক, মনোমোহন= মনঃ + মোহন
৩. স্ত, স্থ, স্প পরে থাকলে বিসর্গ লোপ হয়
উদাহরণ: অন্তস্থ= অন্তঃ + স্থ, নিস্তব্ধ= নিঃ + স্তব্ধ
নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধি
যেসব সন্ধিসমূহ স্বরসন্ধি বা ব্যঞ্জনসন্ধি বা বিসর্গসন্ধির নিয়মগুলো মেনে চলে না, তাদেরকে নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধি বলে। তৎসম শব্দের সন্ধিতেই শুধু নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধি হয়।
- যেমন,
- নিপাতনে সিদ্ধ তৎসম "স্বরসন্ধি"
কুল + অটা = কুলটা, গো + অক্ষ = গবাক্ষ, প্র + ঊঢ়= প্রৌঢ়, মার্ত + অণ্ড = মার্তণ্ড, শুদ্ধ + ওদন = শুদ্ধোদন।
- নিপাতনে সিদ্ধ তৎসম "ব্যঞ্জনসন্ধি"
আ + চর্য = আশ্চর্য, গো + পদ = গোষ্পদ, বন + পতি = বনস্পতি, বৃহৎ + পতি = বৃহস্পতি, তৎ + কর = তস্কর, পর + পর = পরস্পর, মনস্ + ঈষা = মনীষা, ষট্ + দশ = ষোড়শ, এক + দশ = একাদশ, পতৎ + অঞ্জলি= পতঞ্জলি।
নিপাতনে সিদ্ধ তৎসম "বিসর্গসন্ধি"
অহঃ + অহ = অহরহ, অহঃ + নিশ = অহর্নিশ, আঃ + পদ = আস্পদ।[৪]
টীকা
- ↑ এটি সংস্কৃত ভাষায় বিশ্লেষিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় এর অর্থ অন্য আরেকটি। আর ‘√’ চিহ্নটি ধাতুদ্যোতক বোঝায়।
- ↑ বাংলা সন্ধিতে কখনো বির্সগ সন্ধি হয় না।[৩]
তথ্যসূত্র
- ↑ শৈলেন্দ্র বিশ্বাস, সংসদ বাংলা অভিধান, ৪র্থ সংস্করণ, ৬৬২ পৃঃ, ৪৩নং পংক্তি, প্রকাশকাল: ১৯৮২, কলকাতা
- ↑ সন্ধি, বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি পাঠ্যবই, অষ্টম শ্রেণী, ২০১৫ সংস্করণ
- ↑ মাধ্যমিক বাংলা ব্যাকরণ; সন্ধি
- ↑ admin (২০২২-০৫-০৪)। "নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধির উদাহরণ - ব্যাকরণ আলোচনা"। SuggestFor (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২২-০৭-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৭-১৩।