সত্যার্থ প্রকাশ

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী রচিত একটি গ্রন্থ

সত্যার্থ প্রকাশ (হিন্দি: सत्यार्थ प्रकाश) হচ্ছে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী রচিত একটি গ্রন্থ। গ্রন্থটি সর্বপ্রথম ১৮৭৪ সালে হিন্দিতে প্রকাশিত হয়।

সত্যার্থ প্রকাশ গ্রন্থটির প্রচ্ছদ (বাংলা).

দয়ানন্দ সরস্বতী ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু ধর্মগুরু, সমাজ সংস্কারক এবং আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা। সত্যার্থ প্রকাশ ছিল তাঁর অন্যতম পাণ্ডিত্যপূর্ণ রচনা। বর্তমানে গ্রন্থটি হিন্দি ছাড়াও বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, সোয়াহিলি, আরবি, চীনাসহ ২০টিরও অধিক ভাষায় অনুদিত হয়েছে। গ্রন্থটির বিশাল অংশ জুড়ে ধর্মীয় সংস্কার বিষয়ক তথ্য এবং শেষ চারটি অধ্যায়ে বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে।

সত্যার্থ প্রকাশ, দয়ানন্দ সরস্বতী (বাংলা পঞ্চম সংস্করণ)

গ্রন্থ বিবরণ

সম্পাদনা

মধ্যযুগে ভারতের হিন্দু সমাজে ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে নানাবিধ বিশ্বাস ও মতবাদ গজিয়ে উঠে। বিভিন্ন বিশ্বাস ও মতবাদ প্রতিষ্ঠাতা ও তাদের প্রচারের মোহে আকৃষ্ট হয়ে হিন্দুরা বেদের শিক্ষা থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকে। তখন থেকেই মূলত বহুঈশ্বরবাদের শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে হিন্দু সমাজের বিভিন্ন মতানুসারীদের মাঝে বিরাট পার্থক্যের সৃষ্টি হয়, যা হিন্দু সমাজকে বিভক্ত ও দুর্বল করে দেয়। জন্মভিত্তিক বর্ণপ্রথা শক্তিশালী হয়ে ওঠার ফলে হিন্দুসমাজে বিভাজন আরো বৃদ্ধি পায়। যেকোনো প্রাচীন সমাজের ন্যায় হিন্দুসমাজেও সংস্কারের অভাবে ধর্মীয় রীতিনীতিগুলো কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, যেখানে ধর্মীয় সংস্কারগুলো যুক্তিযুক্ত না থাকার ফলে অলৌকিকতা ও অন্ধ বিশ্বাসের বিস্তার ঘটে, যা "হিন্দু" সমাজের অবক্ষয়ের কারণ হয়। হিন্দু শব্দটি যথাযথ নয়, যেখানে সঠিক শব্দটি হলো বৈদিক ধর্ম বা সনাতন ধর্ম, যা মূলত বেদ ভিত্তিক একটি ধর্মহিন্দু শব্দটি কোনো প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া যায় না।

এ সময় বেদের জ্ঞান এবং ঈশ্বরের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য প্রচার ও প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী রচনা করেন সত্যার্থ প্রকাশ। গ্রন্থটিতে মোট চৌদ্দোটি সমুল্লাস বা বিভাগ রয়েছে। প্রথম দশটি সমুল্লাস পূর্বার্ধে এবং পরবর্তী চারটি সমুল্লাস উত্তরার্ধে বিভক্ত। পূর্বার্ধে বৈদিক বিভিন্ন রীতি-নীতি ও ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে এবং উত্তরার্ধে বিভিন্ন মতের যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা করা হয়েছে। একাদশ সমুল্লাসে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মত ও কুসংস্কার এবং পরবর্তি সমুল্লাসগুলোতে অন্যান্য ধর্মের মত পর্যালোচিত হয়েছে। চতুর্দশ সমুল্লাসের শেষে আর্যদের সনাতন বেদবিহিত মতের অর্থাৎ বৈদিক মতের বিশেষ ব্যাখ্যা লিখিত হয়েছে।

সত্যার্থ প্রকাশ এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এক ঈশ্বরের উপাসনা, বেদের মূল নীতিগুলের ব্যাখ্যা, ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে এবং ভক্তি ও বুদ্ধির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন এবং সমাজকে শক্তিশালী করার জন্য বর্ণপ্রথা দূর করা ও বিভিন্ন ধর্মীয় ও বিরোধী মতবাদকে অপসারণ করা; কুসংস্কার, মিথ্যা ধারণা ও মূল্যহীন ধর্মীয় রীতি, সংকীর্ণ মনোভাব দূর করে মানুষের ভ্রাতৃত্ববোধকে উৎসাহিত করা। এই গ্রন্থে বৈদিক ধর্মের মানদণ্ডে প্রচলিত বিভিন্ন মত মতান্তরের যুক্তিপূর্ণ তুলনাত্মক সমালোচনা করা হয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে দয়ানন্দ সরস্বতীর এই গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে। স্বদেশ, স্বাধীনতা, স্বাদেশিকতা, স্বরাজ্য, সংগঠন, ধর্মরাজ্য ও চক্রবর্তী রাজ্য প্রতিষ্ঠার বাণী এই গ্রন্থ দ্বারা স্পষ্টভাবে সর্বপ্রথম ভারতে প্রচারিত হয়।

সমুল্লাস বিষয়
প্রথম সমুল্লাস ঈশ্বরের ওঙ্কারাদি নামের ব্যাখ্যা।
দ্বিতীয় সমুল্লাস সন্তানদেরর শিক্ষা।
তৃতীয় সমুল্লাস ব্রহ্মচর্য, পঠন পাঠন ব্যবস্থা,

সত্য ও অসত্য গ্রন্থসমূহের নাম এবং অধ্যয়ন অধ্যাপনার রীতি।

চতুর্থ সমুল্লাস বিবাহ ও গৃহাশ্রমের ব্যবহার।
পঞ্চম সমুল্লাস বানপ্রস্থসন্ন্যাস আশ্রমের বিধি।
ষষ্ঠ সমুল্লাস রাজধর্ম।
সপ্তম সমুল্লাস বেদঈশ্বরের বিষয়।
অষ্টম সমুল্লাস জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও প্রলয়
নবম সমুল্লাস বিদ্যা, অবিদ্যা, বন্ধন ও মোক্ষের ব্যাখ্যা।
দশম সমুল্লাস আচার, অনাচার ও ভক্ষ্যাভক্ষ্য বিষয়।
একদশ সমুল্লাস আর্যাবর্তীয় মত মতান্তরের খণ্ডন-মণ্ডন বিষয়।
দ্বাদশ সমুল্লাস চার্বাক, বৌদ্ধজৈন মতের পর্যালোচনা।
ত্রয়োদশ সমুল্লাস খ্রিস্টান মতের পর্যালোচনা।
চতুর্দশ সমুল্লাস   মুসলমানদের মতের পর্যালোচনা।

সংস্করণ

সম্পাদনা

গ্রন্থটি মূলত ১৮৭৪ সালে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী হিন্দিতে লিখেছিলেন। রাজা জয়কৃষ্ণ দাস এর প্রকাশ করেন। প্রথম সংস্করণে বাদ পড়া, ভাষা এবং মুদ্রণের ভুলগুলো শনাক্ত করার পর, কাশীর রামপুরের ভিতরে ইসরার মহলে সংশোধন করার পর তিনি দ্বিতীয় সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশ করেন। দ্বিতীয় সংস্করণে শেষের দুটি সমুল্লাস তখন সংযোজিত হয়। তার মৃত্যুর পর এই সংস্করণটি বাজারে আসে।

গ্রন্থটি চব্বিশটি ভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ২০০৪ সালে নবলাখা মহল বৈদিক পণ্ডিতদের একটি প্রমাণীকরণ কমিটি নিযুক্ত করেছে এবং গ্রন্থটির সত্যায়িত সংস্করণ প্রকাশ করতে শুরু করেছে।

ক্রম নং. ভাষা লেখক / অনুবাদক প্রকাশনার বছর (খ্রিস্টাব্দ)
হিন্দি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী(লেখক); রাজা জয়কৃষ্ণ দাস দ্বারা মুদ্রিত ১৮৭৪ (১ম সংস্করণ , কাশীতে), ১৮৮২ (২য় সংস্করণ )
ইংরেজি (বিভিন্ন পণ্ডিতদের দ্বারা ৪ টি অনুবাদ)

১. ডাঃ চিরঞ্জীব ভরদ্বাজা (অনুবাদক), ২. মাস্টার দুর্গা প্রসাদ (অনুবাদক), ৩. পন্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায় (অনুবাদক), ৪. বন্দেমাতরম রামচন্দ্র রাও (অনুবাদক)

১. ১৯০৬, ২. ১৯০৮, ৩. ১৯৪৬ , ৪. ১৯৮৮
সংস্কৃত পণ্ডিত শঙ্করদেব পাঠক ১৯২৪ (১ম সংস্করণ)
উর্দু ১. আত্মারাম অমৃতসরী, ভক্ত রাইমল এবং নাউনিহাল, ২. জীবনদাস পেনশনার, ৩. পণ্ডিত চমূপতি, ৪. মেহতা রাধাকৃষ্ণ ১. ১৮৯৮, ২. ১৮৯৯, ৩. ১৯৩৯, ৪. ১৯০৫
সিন্ধি জীবনলাল আর্য ১৯১২
পাঞ্জাবি আত্মারাম অমৃতসরী ১৮৯৯
বাংলা ১. মতিলাল ভট্টাচার্য,

২. শঙ্করনাথ,

৩. গৌরমোহনদেব বর্মন

১. ১৯০১,

২. ১৯১১,

মারাঠি ১. শ্রীদাস বিদ্যার্থী,

২. শ্রীপদ দামোদর সাতভলেকার, ৩. স্নাতক সত্যব্রত, ৪. শ্রীপদ জোশি

১. ১৯০৭,

২. ১৯২৬, ৩. ১৯৩২, ৪. ১৯৯০

তেলুগু ১. এ. সোমনাথান রাও "উপদেশক",

২. পণ্ডিত গোপাদেব শাস্ত্রী

১. ১৯৩৩, ২. ???
১০ তামিল ১. এম. আর. জম্বুনাথান, ২. কানাইয়া,

৩. সুধানন্দ ভারতী

১. ১৯২৬, ২. ১৯৩৫, ৩. ১৯৭৪
১১ মালায়ালাম ১. ব্রহ্মচারী লক্ষ্মণ (মূল- বেদবন্ধু শর্মা),

২. আচার্য নরেন্দ্র ভূষণ

১. ১৯৩৩,

২. ১৯৭৮

১২ গুজরাটি ১. মঞ্চ শঙ্কর, জয়শঙ্কর দ্বিবেদী,

২. মায়াশঙ্কর শর্মা, ৩. দিলীপ বেদালঙ্কার

১. ১৯০৫,

২. ১৯২৬, ৩. ১৯৯৪

১৩ কানাডা ১. ভাস্কর পান্ত,

২. সত্যপাল স্নাতক, ৩. সুধাকর চতুর্বেদী

১. ১৯৩২, ২. ১৯৫৫, ৩. ১৯৭৪
১৪ নেপালি দিলোসিং রাই ১৮৭৯
১৫ জার্মান ১. ডঃ. দৌলত্রম দেবগ্রাম, বরিখেল (মিয়ান্বায়ালি), ২. আর্য দিবাকর ১. ১৯৩০,

২. ১৯৮৩

১৬ স্বাহিলি ??? ???
১৭ উড়িষ্যা ১. শ্রীবৎস পাণ্ড,

২. লক্ষ্মীনারায়ণ শাস্ত্রী

১. ১৯২৭, ২. ১৯৭৩
১৮ অসমীয়া পরমেশ্বর কটি ১৯৭৫
১৯ আরবী কালীচরণ শর্মা ???
২০ বার্মিজ কিত্তিমা ???
২১ চীনা ড. চাও ১৯৫৮
২২ থাই ??? ???
২৩ ফরাসি লুই মরিন ১৯৪০
২৪ কুমাওনি এবং গারহ্বালি বীরভদ্র সাথি ???

সত্যার্থ প্রকাশ - বাংলা সংস্করণ

সম্পাদনা
  1. প্রথম সংস্করণ - আজমীঢ় থেকে প্রকাশিত।
  2. দ্বিতীয় সংস্করণ - কলিকাতা আর্যসমাজ হতে পণ্ডিত শঙ্করনাথ প্রকাশ করেন।
  3. তৃতীয় সংস্করণ - কলিকাতা আর্যসমাজ হতে পণ্ডিত শঙ্করনাথ প্রকাশ করেন।
  4. চতুর্থ সংস্করণ - ১৯৩৪ সালে তুলসী দাস দত্ত কর্তৃক কলিকাতা হতে প্রকাশিত।
  5. পঞ্চম সংস্করণ - ১৯৪৬ সালে বঙ্গ আসাম আর্যপ্রতিনিধি সভা হতে প্রকাশিত।

অভ্যর্থনা ও সমালোচনা

সম্পাদনা

এস. রঙ্গস্বামী আইয়ার গ্রন্থটির ভুয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন,[]

"বইটি বৈদিক ধর্মের সম্পূর্ণ যুক্তিবাদী দর্শন।"

সত্যার্থ প্রকাশ বইটি ১৯৪৪ সালে কিছু রাজা শাসিত রাজ্যে এবং সিন্ধু প্রদেশে নিষিদ্ধ ছিলো এবং আজো সিন্ধে গ্রন্থটি নিষিদ্ধ।[]

২০০৮ সালে সদর বাজার দিল্লীর দুই জন ভারতীয় মুসলমান ব্যক্তি- উসমান গনি এবং মোহাম্মদ খলিল খান, দিল্লীর ফতেপুরী মসজিদের ইমাম মুফতি মুকাররম আহমেদের ফতোয়া অনুসরণ করে দিল্লী হাইকোর্টে সত্যার্থ প্রকাশ নিষিদ্ধ করার জন্য আবেদন করেন।[] যদিও আদালত আবেদনটি বাতিল করে দেয় এবং মন্তব্য করেন, "কোরআনের বিরুদ্ধে হিন্দুদের এবং গীতা বা সত্যার্থ প্রকাশের বিরুদ্ধে মুসলমানদের মামলা মূলত সমাজে কলহ বিবাদ সৃষ্টি করার সামিল।"[]

সানাউল্লাহ অমৃতসরী বইটির জবাবে হক প্রকাশ বইটি রচনা করেন।

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "World Perspectives on Swami Dayananda Saraswati", গঙ্গা রাম গর্গ কর্তৃক লিখিত, পৃষ্ঠা ১৮৮
  2. The Book on Trial: Fundamentalism and Censorship in India, গিরজা কুমার
  3. "Arya Samaj plans march to defend book by founder"দ্য হিন্দু (ইংরেজি ভাষায়)। ২০০৮-০৫-০৯। ২০০৮-০৫-১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  4. "Plea seeking ban on Dayanand book is 'mischief'" (ইংরেজি ভাষায়)। জুলাই ৭, ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।