লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র
পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র (২৩ জুলাই ১৮৯৫ - ২৫ জুলাই ১৯৫৩) ছিলেন একজন ভারতীয় রাজনীতিবিদ। তিনি সংসদ সদস্য ছিলেন, এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য হিসাবে ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তিনি ভারতীয় গণপরিষদেরও সদস্য ছিলেন।[১][২][৩][৪]
লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র | |
---|---|
সংসদ সদস্য, লোকসভা | |
কাজের মেয়াদ ১৯৫২ – ১৯৫৭ | |
উত্তরসূরী | ইলা পালচৌধুরী |
সংসদীয় এলাকা | নবদ্বীপ, পশ্চিমবঙ্গ |
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | ২৩ জুলাই ১৮৯৫ নারায়ণগঞ্জ , বৃটিশ ভারত বর্তমানে বাংলাদেশ |
মৃত্যু | ২৫ জুলাই ১৯৫৩ (বয়স ৫৯) কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
রাজনৈতিক দল | ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস |
সন্তান | কাশীকান্ত মৈত্র |
পিতামাতা | রজনীকান্ত মৈত্র (পিতা) |
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
সম্পাদনালক্ষ্মী কান্ত মৈত্রর জন্ম ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুলাই বৃটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের ঢাকার নারায়ণগঞ্জে। তার পৈত্রিক বাসস্থান অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শান্তিপুর৷[৫] তবে তাদের আদি বাসস্থান নদীয়া জেলার ধুবুলিয়ার বেলপুকুর গ্রাম৷ তার পিতা রজনীকান্ত মৈত্র।[৬] তিনিই প্রথম ধুবুলিয়ার বাসস্থান ছেড়ে শান্তিপুরে বাস করেন৷[৭][৮] লক্ষ্মী কান্ত মৈত্র অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন ছোটবেলা থেকেই। তার শৈশব, বাল্য, কৈশোর এবং যৌবনের সন্ধিক্ষণ কেটেছিল নারায়ণগঞ্জ-ঢাকায়। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার সরকারি জগন্নাথ কলেজ থেকে আই.এ, কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজ থেকে বি.এল পাশের পর সংস্কৃত সাহিত্যে কাব্য সংখ্য ও তীর্থ ডিগ্রি লাভ করে "পণ্ডিত" উপাধি প্রাপ্ত হন।
কর্মজীবন
সম্পাদনাসংস্কৃতে পণ্ডিত লক্ষ্মী কান্ত আইন ব্যবসা শুরু করেন যশস্বী হন নদীয়ার কৃষ্ণনগরে। আইনজীবী হিসাবে তার সে খ্যাতি পরবর্তীতে কলকাতা ও দিল্লিতে ব্যাপ্ত হয়। কিন্তু ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ২৬ বৎসর বয়সে সেই আইন ব্যবসা ছেড়ে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের ন্যায় ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে আসেন। অবশ্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্রাবস্থায় সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে পরিচয় ঘটে। মোটামুটি তারই প্রভাবে বাংলা ও বাঙালির জন্য লড়াই তার মধ্যে একাত্ম হয়ে যায়। তার সখ্যতা ছিল ভারত কেশরী ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হিসাবে কংগ্রেস জাতীয় দলের নেতা হয়েছিলেন। কংগ্রেসের সুভাষ-বিরোধী চক্রান্তের কট্টর সমালোচক ছিলেন তিনি। ত্রিপুরা-কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্র বসুর দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পর, যে পরিস্থিতিতে কংগ্রেস ছেড়ে নতুন দল গঠনের সময় দলের নাম ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ রাখার পরামর্শ লক্ষ্মীকান্তই দিয়েছিলেন। কংগ্রেসের মধ্যে যাঁরা প্রগতিশীল তারাই নেতাজির নতুন দলে আসবেন এই রকম প্রত্যাশা করেই। জেলের ভিতর থেকে গভর্নরের উদ্দেশে লেখা নেতাজির ‘শেষ চিঠি’তেও লক্ষ্মী কান্ত মৈত্রের প্রস্তাবের উল্লেখ রয়েছে। [৯] তিনি ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে অস্থায়ী পার্লামেন্টের সদস্য হন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে সেটি গণ পরিষদের রূপ নেয়। ড. বি আর আম্বেদকরের হাতে সংবিধান রচনার ভার ন্যস্ত হলে , তিনি বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য হন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ই আগস্ট সংসদে তার ও সুচেতা কৃপালনির দ্বৈতকণ্ঠে গীত 'জনগনমন' ও 'বন্দেমাতরম' পর অধিবেশনের কাজ শুরু হয়। দীর্ঘ সংসদীয় জীবনে রেল সড়ক ডাক স্বাস্থ্য লবণ শিক্ষা বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন সরকারি বিভাগের উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন ; কিন্তু স্বাধীনতার পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সভায় স্থান হয়নি সম্ভবতঃ তার স্পষ্টবাদিতার কারণে। নেতাজীর অন্তর্ধানের পর কংগ্রেসের ভিতর বাঙালি হয়ে দরবার করার জন্য তিনি ছিলেন। নদীয়া জেলার পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তি তিনিই রুখে ছিলেন। ১৫ ই আগস্ট নবদ্বীপ শ্রীচৈতন্যের জন্মভিটে, লীলাক্ষেত্র সহ কৃষ্ণনগর, তার বসত ভিটা শান্তিপুর, রানাঘাট ইত্যাদির বিশাল অংশ পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয়। অত্যন্ত তৎপরতায় জওহরলাল নেহরু কাছে বলিষ্ঠ দরবারে ও তার হস্তক্ষেপে এক বিস্তীর্ন অঞ্চলের ভারতভুক্তি সম্ভব হয় ১৮ ই আগস্ট। সেই সময়ে সংসদে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য ও পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র - এই তিন জন সুবিদিত পণ্ডিত বাগ্মী ছিলেন। স্বাধীনচেতা ও স্পষ্টবাদী বক্তা হিসাবে যেমন প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেন, ঠিক তেমনই স্বাধীনভাবে সমালোচনাতেও কখনো কুন্ঠা বোধ করতেন না। গণপরিষদে সংবিধান চূড়ান্তরূপে গৃহীত হওয়ার সময় স্মরণীয় ভাষণে তিনি বলেছিলেন-
" এই সংবিধান আমাদের লিবার্টি সুনিশ্চিত করেছে, কিন্তু লিবার্টিকে লাইসেন্সে পরিণত করার পথ বন্ধ করেছি। আজ আমাদের আত্মবিশ্লেষণ আত্মপরীক্ষার সময়। আজই, এখন থেকেই, এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে সংবিধানে দেওয়া ব্যবস্থাগুলি কার্যকর করা যায়। যেমন আমরা প্রাপ্তবয়স্ক দের ভোটাধিকার দিয়েছি। কিন্তু অশিক্ষা দূর না-হলে এই ভোটাধিকার আশীর্বাদের পরিবর্তে অভিশাপ হয়ে উঠবে।"
লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। ধর্ম সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভারতভাগের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু দেশভাগ অনিবার্য হলে উঠলে পূর্ববঙ্গ হতে উদ্বাস্তুদের দুর্দশা তাকে ব্যথিত করত। তাদের বঞ্চনা বৈষম্যের প্রতিবাদে পুনর্বাসন দাবিতে হিন্দুত্ববাদী ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যেমন অতি সক্রিয় ছিলেন, পণ্ডিত মৈত্রও লৌহপুরুষের ন্যায় ব্যক্তিত্বে সমানভাবে সোচ্চার ছিলেন।
লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র নদীয়ার শান্তিপুরে কলেজ, পুরাণ পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট সদস্য, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন কমিটির সদস্য-সহ বহু পদে আসীন ছিলেন। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বিশিষ্ট আইনজীবী কাশীকান্ত মৈত্র তার পুত্র। বিশিষ্ট চিকিৎসক সুব্রত মৈত্র (১৯৫৬ -২০১৬) ছিলেন তার পৌত্র।
মৃত্যু
সম্পাদনাপণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে জুলাই ৫৯ বৎসর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ India. Parliament. Lok Sabha (১৯৫২)। Who's who। Parliament Secretariat.। পৃষ্ঠা 160। সংগ্রহের তারিখ ৯ এপ্রিল ২০১৯।
- ↑ Ravindra Kumar (১৯৯২)। The Selected Works of Subhas Chandra Bose, 1936-1946। Atlantic Publishers & Dist। পৃষ্ঠা 204–। আইএসবিএন 978-81-7156-319-7। সংগ্রহের তারিখ ৯ এপ্রিল ২০১৯।
- ↑ India. Legislature. Legislative Assembly (১৯৪৩)। The Legislative Assembly Debates. Official Report। পৃষ্ঠা 206। সংগ্রহের তারিখ ৯ এপ্রিল ২০১৯।
- ↑ "LIST OF MEMBERS OF THE CONSTITUENT ASSEMBLY (AS IN NOVEMBER, 1949)"। Rajya Sabha। সংগ্রহের তারিখ ৯ এপ্রিল ২০১৯।
- ↑ সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান, শ্রীসুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ, কলিকাতা, ১৯৬০, পৃ. ৪৯৯
- ↑ সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬ পৃষ্ঠা ৬৭৯, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
- ↑ "ছাদের চেম্বারটা খাঁ-খাঁ করছে, ডাক্তারবাবু নেই"।
- ↑ "নীরবে পালন হল ভারত বরেণ্য পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্রের ১২৫ তম জন্ম দিবস"।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ উদ্ধৃতি ত্রুটি:
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়;:02
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি