রক্তেশ্বরী,[][] যাকে আদি পরাশক্তির এক অবতার হিসেবে গণ্য করা হয়, যিনি দুর্গা পরমেশ্বরী নামেও পরিচিত, হিন্দু দেবীর প্রধান ও জনপ্রিয় রূপ। এই দেবী মূলত পরশুরাম ক্ষেত্রসমূহে পূজিত।[][][] রক্তেশ্বরী তুলু নাডুর ইষ্ট দেবতা[][][]

উপাসনা এবং উৎসব

সম্পাদনা
 
দেবী রক্তেশ্বরীর উপাসনার ( ডানহস্তপন্থী) নমুনা চিত্র (রক্তেশ্বরীর মূলাস্থনা), লোককাহিনী অনুযায়ী উপাসনা থেকে যার পার্থক্য রয়েছে।

রক্তেশ্বরী হলেন দুর্গা পরমেশ্বরী,[] মহাবিশ্বের স্বর্গীয় জননী,[][১০] শাক্ত হিন্দু সম্প্রদায় কর্তৃক ভারতের হিন্দু মন্দিরসমূহে যার পূজা করা হয়ে থাকে। তাঁর মন্দির, উপাসনা এবং উৎসবগুলির ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষত প্রতিটি সংক্রমণের সময়ে (বা সংক্রান্তি দিনসমূহ / হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে প্রতি মাসের সূর্য অতিক্রমণের দিনগুলিতে) জনপ্রিয়। তাঁর পূজার গুরুত্বপূর্ণ উৎসর্গসমূহ হলো নারকেল ফুল, সিঁদুর এবং পুরো নারকেল।

রক্তেশ্বরীর বিজা-মন্ত্র, "ওম ক্লিম রাম রক্তেশ্বরাই নামাহা" শিখরাগ্রে (একটি পর্বতের উপরে), প্রবাহমান নদীর নিকটে, যে কোনও ঘন অরণ্যে, কদম্ব গাছের বাগানে প্রভৃতি স্থানে প্রয়োজনীয় শাক্ত বিধিবিধানের (শাক্ত উপনিষদ) সমন্বয়ে কোন যোগ্য গুরুর পরিচালনায় আবৃত্তি করা হয়।

দেবতা রক্তেশ্বরীকে প্রায়শই ভুলবশত প্রেত/রাক্ষস মনে করা হয়। রক্তেশ্বরী এমন এক দেবী যাকে রক্ত উৎসর্গ করতে হয় - এমন ধারণা দক্ষিণাচার অনুষ্ঠানসমূহে অস্বীকার করা হয়। তিনি একজন হিংস্র দেবতা হলেও দক্ষিণাচার পদ্ধতিতে (ডানহস্ত পথ) তাঁর শান্ত ভঙ্গিকে পূজা করা হয়। এক্ষেত্রে বলী (অর্ঘ্য) হিসেবে কুমকুম (সিঁদুর ) এবং পুরো নারকেলকে ব্যবহার করা হয়। এই দেবী পূজার বৈশিষ্ট্য হলো এটি নির্দিষ্ট কিছু মুদ্রা (অভ্যন্তরীণ শক্তিবৃদ্ধির অভ্যাস) ব্যবহার করে ভক্তকে অপর মানুষদের নেতিবাচক শক্তি হতে পরিত্রাণ লাভের জন্য শক্তিদান করেন (অর্থাৎ দুশ্চিন্তা, ভয়, বিষণ্ণতা, ক্ষুধামান্দ্য, রাগ, হতাশা, অমনোযোগিতা ইত্যাদি সৃষ্টির দ্বারা মানবদেহের সাত চক্রের (শক্তির কেন্দ্রসমূহ) কোন একটিতে বাধা প্রদানের মাধ্যমে)। এটি করা হয় বিশেষত প্রতি মাসের সংক্রমণের দিনগুলিতে (সঠিক তারিখ জানার জন্য নিচের টেবিলটি দেখুন)।

সংক্রম তারিখ সূর্য অধিক্রমণের চিহ্ন
১৪ জানুয়ারী মকর
১৩ ফেব্রুয়ারি কুম্ভ
১৪ মার্চ মীন
১৪ এপ্রিল মেষ
১৫ মে বৃষ
১৫ জুন মিথুন
১৬ জুলাই কর্কট
১ আগস্ট সিংহ
১৭ সেপ্টেম্বর কন্যা
১৭ অক্টোবর তুলা
১৬ নভেম্বর বৃশ্চিক
১৬ ডিসেম্বর ধনু

রক্তেশ্বরী উপাসনার উপর উচ্চতর দক্ষতা থাকায় কিছু প্রতিষ্ঠিত রক্তেশ্বরী উপাসক আধ্যাত্মিক নিরাময়ের (মানবদেহে সাত চক্রের বাধাসমূহ পরিষ্কার করার) জন্য পৃথকভাবে পরিচিত। "ওঁ" বীজ মন্ত্রের বিধানটি অন্যতম প্রধান সাত্ত্বিক নিরাময়-পরবর্তী প্রক্রিয়া হিসেবে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে (মন্ত্রপাঠের সময়বাধার পার্থক্যের ভিত্তিতে পরিবর্তিত হতে পারে)।

মঙ্গলগ্রহ এবং দেবী রক্তেশ্বরীর সাথে এর যোগসূত্র

সম্পাদনা

ঐতিহ্যবাহী হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্রে চাঁদ, মঙ্গল মানবদেহের রক্তের সাথে প্রধানভাবে সম্পর্কযুক্ত। মঙ্গল যখন কোনও রাশির জাতক হয় এবং এটি কোন জোড় চিহ্নকে দখল করে, তখন দেবী রক্তেশ্বরীর কাছে রক্ত সম্পর্কিত যে কোনও অসুখ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করার উপযুক্ত সময়।[১১] কিছু স্থানীয় বিশ্বাস অনুসারে, রক্তেশ্বরীর উপাসনার দ্বারা গুটিবসন্ত এবং ঋতুস্রাবের সময় রক্তপাতজনিত ব্যাধিগুলির মতো সংক্রামক রোগসমূহের (মঙ্গল গ্রহ দেহের গোপন অঙ্গেরও প্রতিনিধিত্ব করে) নিরাময় করা যায় [১২]

রক্তেশ্বরীর ভমমর্গ পূজা (বামহস্ত পথ বা বিকল্প পথ যাতে উৎসর্গ হিসেবে মদ, মাংস, রক্ত, পশুবলি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়) লোকাচারবিদ্যার রীতি অনুযায়ী করা হয় না।[১৩] অন্যান্য মহিলা দেবতাদের মতো সাধারণ গৃহ উপাসনায় রক্তেশ্বরীকে দ্রাবিড়ীয় তুলু কথ্য লোকসাহিত্যে বর্ণিত লোক সংস্কৃতি পরিবেশনায় পছন্দনীয় সংগীত, লোকনৃত্য, আবৃত্তি এবং অন্যান্য প্রশস্ত বেশসমূহ (পোশাক),[১৪] গরুর দুগ্ধজাত ঘিয়ের প্রদীপ এবং কুমকুম (সিন্দূর) তুষ্ট করার জন্য উৎসর্গ করা হয়।

মন্দির

সম্পাদনা
 
শ্রী মেরু (শ্রী চক্রের ত্রিমাত্রিক আকার)

কোঙ্কণ, কর্ণাটক উপকূল ও কেরলের অঞ্চলগুলিকে পরশুরাম ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এসব স্থানে রক্তেশ্বরীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত অসংখ্য মন্দির রয়েছে। [][][১৫] দক্ষিণ কানারায় ব্রাহ্মণগণ এবং অন্যান্য হিন্দুগণ কর্তৃক মূলস্থানে [] রক্তেশ্বরীর উপাসনা [] বিখ্যাত।

রক্তেশ্বরীকে দক্ষিণাচার (ডানহস্ত পথ) প্রথা অনুসারে শ্রীচক্রবাসিনী (শ্রীচক্রপ্রান্তের বাসিন্দা হিসেবে শান্ত ও প্রশংসনীয় দেবতা) হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং [] দুর্গা সুক্ত ও আর্য সুক্তরা দুর্গা পরমেশ্বরী হিসেবে উপাসনা করেছিলেন।[১৬]

ভাস্কর্য

সম্পাদনা

আদি পরাশক্তির অন্যতম ঐশ্বরিক অস্ত্র, তরোয়াল দেবী মাহাত্ম্যমের মতে বৈষম্য দূরীকরণকে প্রতিনিধিত্ব করে। এটি দেবী রক্তেশ্বরীর একটি প্রতীকী রূপ। শ্রীচক্রের টিপ সর্বোচ্চ দেবী দুর্গা পরমেশ্বরীর একটি প্রতীকী রূপ।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Caldwell, Sarah (১৯৯৯)। Oh Terrifying Mother: Sexuality, Violence, and Worship of the Goddess Kā̄ḷi। Oxford University Press। আইএসবিএন 978-0-19-565796-8 
  2. Raman, Bangalore Venkat (সেপ্টেম্বর ১৯৯৯)। Prasna Marga। Motilal Banarsidass। আইএসবিএন 978-81-208-0918-5 
  3. Shah, Umakant Premanand (১৯৯৫)। Studies in Jaina Art and Iconography and Allied Subjects in Honour of Dr. U.P. Shahআইএসবিএন 978-81-7017-316-8 
  4. Jayashanker, S. (২০১১)। Temples of Erṇākuḷam District (ইংরেজি ভাষায়)। Office of the Registrar General & Census Commissioner, India। 
  5. Ayyar, K. V. Krishna (১৯৩৮)। The Zamorins of Calicut: From the Earliest Times Down to A.D. 1806। Publication Division, University of Calicut। আইএসবিএন 978-81-7748-000-9 
  6. JIF, Journal of Indian Folkloristics (ইংরেজি ভাষায়)। Folklore Fellows of India। ১৯৭৮। 
  7. Siraj, S. Anees (২০১২)। Karnataka State: Udupi District (ইংরেজি ভাষায়)। Government of Karnataka, Karnataka Gazetteer Department। 
  8. "Filled with lore"The Hindu (ইংরেজি ভাষায়)। ২০০৮-০৬-০৯। আইএসএসএন 0971-751X। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৪-৩০ 
  9. Das, Potluru Krishna (১৯৮৯)। The Secrets of Vastu (ইংরেজি ভাষায়)। Udayalakshmi Publications। 
  10. Johnsen, Linda (২০০২)। The Living Goddess: Reclaiming the Tradition of the Mother of the Universe। Yes International Publishers। পৃষ্ঠা 89–90। আইএসবিএন 978-0-936663-28-9 
  11. Raman, Bangalore Venkat (সেপ্টেম্বর ১৯৯৯)। Prasna Marga by BV Ramanআইএসবিএন 9788120809185 
  12. Ltd, Infokerala Communications Pvt (২০১৭-০৯-০১)। Pilgrimage to Temple Heritage 2017। Info Kerala Communications Pvt Ltd। আইএসবিএন 978-81-208-0918-5 
  13. Claus, Peter J. (১৯৭৮)। "Oral Traditions, Royal Cults and Material for the Reconsideration of the Caste System in South India"": 1–39। 
  14. Claus, Peter J) (১৯৭৮)। "Heroes and Heroines in the Conceptual Framework of Tulu Culture": 28–42। 
  15. Ltd, Infokerala Communications Pvt (২০১৭-০৯-০১)। Pilgrimage to Temple Heritage 2017। Info Kerala Communications Pvt Ltd। আইএসবিএন 978-81-934567-0-5 
  16. Sankaranarayanan, S. (২০০১)। Glory of the Divine Mother (Devī Māhātmyam)। Nesma Books। আইএসবিএন 978-81-87936-00-8