মারাঠা খাত বা মারহাট্টা খাত ১৭৪২ সালে বর্গি অর্থাৎ মারাঠাদের সম্ভাব্য আক্রমণের হাত থেকে কলকাতা শহরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে খনন করা একটি ৪.৮ কিলোমিটার (৩ মাইল) দীর্ঘ পরিখা। যদিও বর্গিরা শেষ পর্যন্ত কলকাতা আক্রমণ করেনি। ১৭৫৬ সালে বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করে ইংরেজ বসতি লুণ্ঠন করলে এই খাতটি অকার্যকরী প্রমাণিত হয়।[] খাতটির নির্মাণকাজ কখনই সম্পূর্ণ হয়নি। ১৭৯৯ সালে সার্কুলার রোড নির্মাণের সময় এর অধিকাংশ বুজিয়ে দেওয়া হয়; অবশিষ্টাংশ বোজানো হয় ১৮৯২–৯৩ সালে। এই খাতটির অবস্থানের জন্য সেকালে কলকাতাবাসীদের "ডিচার্স" ("Ditchers") বা "খাতবাসী" নামে অভিহিত করা হত। এই খাত দিয়ে ঘেরা অঞ্চলটিকে মনে করা হত কলকাতার মূল নগরাঞ্চল।[]

মারাঠা আক্রমণ

সম্পাদনা

১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামগুলিতে মারাঠা আক্রমণ ও লুটতরাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বর্গি শব্দটি একটি মারাঠি শব্দের অপভ্রংশ যার অর্থ মারাঠা সাম্রাজ্যের অশ্ব ও অস্ত্রধারী অশ্বারোহী সৈনিক। সিলাদারদের মতো এরা নিজের অশ্বে আরোহণ করে যুদ্ধ করত না[]

বাংলার জনমানসে মারাঠা আক্রমণের ভীতি প্রতিফলিত হয় লোকসাহিত্যেও। আজও জনপ্রিয় ছেলেভুলানো ছড়ায় গাওয়া হয়,

খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গি এলো দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেবো কিসে।

[]

১৭৪০ সালের এপ্রিল মাসে সরফরাজ খানকে পরাজিত ও নিহত করে আলীবর্দী খান বাংলার নবাব পদে আসীন হন। সরফরাজ খানের শ্যালক তথা উড়িষ্যার নায়েব নাযিম (উপ-শাসনকর্তা) রুস্তম জঙ্গ আলীবর্দী খানের কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন। আলীবর্দী খান বালাসোরের নিকট ফুুলওয়ারীর যদ্ধে তাকে পরাস্ত করে নিজের ভাগনেকে উড়িষ্যার নায়েব নাযিম পদে স্থাপন করে রাজধানী মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। রুস্তম জঙ্গ নাগপুরের মারাঠা শাসক রঘুজী ভোঁসলের সহায়তা প্রার্থনা করেন। মারাঠাদের সাহায্যে তিনি উড়িষ্যার কর্তৃত্ব পুনরায় অধিকার করেন। মারাঠারাও সুসমৃদ্ধ গ্রামীণ বাংলাকে লুণ্ঠন করা কত সহজ তা অনুধাবন করার সুযোগ পেয়ে যায়। আলীবর্দী পুনরায় উড়িষ্যায় এসে রুস্তম জঙ্গকে পরাজিত করেন। কিন্তু তিনি মুর্শিদাবাদে ফিরে আসার আগেই রঘুজী ভাস্কর পণ্ডিতের অধীনে একটি মারাঠা সশস্ত্রবাহিনী বাংলায় প্রেরণ করেন। তারা পাঞ্চেত হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে লুটতরাজ শুরু করে[][]

পরবর্তী দশ বছরব্যাপী মারাঠারা বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলে তাদের লুটতরাজ চালিয়ে যায়। সমসাময়িক লেখকরা মারাঠা সন্ত্রাসের, তাদের সহসা আক্রমণ ও দ্রুত পলায়ন পদ্ধতির এবং নবাবের সেনাবাহিনীর অসহায়তার এক জীবন্ত চিত্র এঁকেছেন। আলীবর্দী দৃষ্টান্তমূলক সাহস ও সামরিক দক্ষতার সঙ্গে প্রতিটি যুদ্ধ পরিচালনা করেন। কিন্তু মারাঠা হানাদারদের উদ্দেশ্য রাজ্যদখল ছিল না, ছিল শুধুই লুণ্ঠন করা। দ্রুতগতির মারাঠা অশ্বারোহী বাহিনীকে পর্যুদস্ত করা নবাবের বাহিনীর পক্ষে বেশ কঠিন ছিল। একমাত্র ভাগীরথী-হুগলি নদী তাদের গতিপথে বাধা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। খুব অল্প ক্ষেত্রেই তারা এই নদী পার হয়[]

১৭৫১ সালের মে মাসে নবাব ও মারাঠাদের মধ্যে শান্তিচুক্তি সাক্ষরিত হয়। নবাব উড়িষ্যার শাসনকর্তৃত্ব পরিত্যাগ করেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলায় মারাঠা বর্গিদের উৎপাত শেষ হয়[]

মারাঠা খাত

সম্পাদনা
 
লেফট্যানেন্ট কর্নেল মার্ক উড কর্তৃক ১৭৮৪-৮৫ সালে অঙ্কিত মানচিত্রে মারাঠা খাতের বিস্তার

বাংলায় যখন বর্গিহানা শুরু হয় তখনও পর্যন্ত বাংলার নবাব ছিলেন সর্বশক্তিমান এবং ইংরেজরা তখন সদ্যই কলকাতার বাণিজ্যকুঠিকে কেন্দ্র করে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সংগঠিত করে তুলছে। মারাঠাদের আক্রমণের ভয়েই কলকাতার উত্তরে একমাত্র রাস্তাটিকে খনন করে তারা মারাঠা খাত নির্মাণ শুরু করে। তাদের ভয় ছিল ওই পথেই মারাঠারা কলকাতা আক্রমণ করতে পারে।[]

এইচ এ ই কটন লিখেছেন যে এই সময় বালাসোর থেকে রাজমহল পর্যন্ত সমগ্র দেশে ব্যাপক লুটতরাজ চালায় বর্গিরা। বর্তমানে যেখানে শিবপুর ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেনস অবস্থিত তার কাছেই সেযুগে ছিল মুকওয়াহ্ তান্নাহ্ দুর্গ। সেই দুর্গটিও তারা দখল করে নেয়। তখন সেখানকার অধিবাসীরা ইংরেজদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ইংরেজরা বিপদ সংকেত পেয়ে নিজেদের অঞ্চলের চারিপাশে পরিখা খনন করার অনুমতি লাভ করে।[]

মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী সাত মাইল দীর্ঘ একটি খাত খননের পরিকল্পনা ছিল। মাত্র তিন মাসে তিন মাইল খননকার্য সমাপ্তও হয়ে যায়। কিন্তু যখন দেখা যায় যে বর্গিরা কলকাতা আক্রমণ করল না, তখন খননকার্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। গোবিন্দরাম মিত্রউমিচাঁদের বাগানবাড়ির কাছে নেওয়া বাঁক ছাড়া এই খাত মোটামুটি পরবর্তীকালের সার্কুলার রোডকে (বর্তমানে আপার সার্কুলার রোড ও লোয়ার সার্কুলার রোডের নামকরণ করা হয়েছে যথাক্রমে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডআচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড) অনুসরণ করে সূতানুটির (বর্তমান বাগবাজার) উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত পেরিন’স পয়েন্ট-এ চিৎপুর খাল ও হুগলি নদীর মিলনস্থল থেকে বর্তমান এন্টালি অঞ্চল অবধি প্রসারিত ছিল। দক্ষিণে গোবিন্দপুর পর্যন্ত এই খাতটি প্রসারিত করার কথা থাকলেও তা কার্যকর করা হয়নি।[]

মারাঠা খাত নির্মিত হয়েছিল কলকাতা শহরকে বর্গি আক্রমণ থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু "নেটিভ" কলকাতাবাসীদের ব্রিটিশ শক্তিকেন্দ্র ফোর্ট উইলিয়ামকে রক্ষা করার জন্য এই খাত নির্মাণের সব খরচ বহন করতে হয়।[]

আলিবর্দি খাঁর পর সিরাজদ্দৌলা বাংলার নবাব হন। ১৭৫৬ সাল অবধি ইংরেজদের মর্যাদা ছিল এক জমিদারের মর্যাদার সমান। ১৭৫৬ সালেই সিরাজ কলকাতা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এই বছর ১৬ জুন ৩০,০০০ সৈন্য ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কলকাতার উপকণ্ঠে উপস্থিত হন সিরাজ। তার অধিকাংশ সৈন্য ১৮ জুন শিয়ালদহের নিকট খাত পার হয় এবং লালদিঘির যুদ্ধ সংঘটিত হয়।[].

পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা এই দেশে শাসকের আসনে বসে। এরপর চল্লিশ বছর ধরে মারাঠা খাতে জমা হতে থাকে শহর কলকাতার যাবতীয় জঞ্জাল ও বর্জ্য পদার্থ। অতঃপর তৎকালীন ভারতের গভর্নর-জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি এটিকে বুজিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।

১৭৯৯ সালে সার্কুলার রোড নির্মাণকালে মারাঠা খাত বুজিয়ে দেওয়া হয়। অবশিষ্টাংশ ১৮৯২-৯৩ সালে হ্যারিসন রোড (বর্তমানে মহাত্মা গান্ধী রোড) নির্মাণকালে প্রাপ্ত মাটি ও জঞ্জাল দ্বারা পূর্ণ করে দেওয়া হয়।[]

মারাঠা খাত বর্তমানে ইতিহাসে পরিণত হলেও উত্তর কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলে একটি রাস্তার নাম এখনও মারাঠা খাত লেন। বাগবাজার স্ট্রিট ও মহাত্মা শিশির কুমার সরণির (গালিফ স্ট্রিট) সমান্তরালে প্রসারিত এই রাস্তাটি নন্দলাল বসু লেন ও অভয় বসু লেনকে সংযুক্ত করেছে।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Lahiri Choudhury, Dhriti Kanta, Trends in Calcutta Architecture, in Calcutta, the Living City, Vol I, edited by Sukanta Chaudhuri, p. 157, Oxford University Press, আইএসবিএন ৯৭৮-০-১৯-৫৬৩৬৯৬-৩
  2. Nair, P. Thankappan in The Growth and Development of Old Calcutta, in Calcutta, the Living City, Vol. I, p. 12.
  3. Sengupta, Nitish, History of the Bengali-speaking People, 2001/2002, pp.132-137, UBS Publishers’ Distributors Pvt. Ltd., আইএসবিএন ৮১-৭৪৭৬-৩৫৫-৪
  4. Ahmed, Wakil। "Folk Literature"Banglapedia। Asiatic Society of Bangladesh। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০২-২১ 
  5. Shah, Mohammad। "Maratha Raids"Banglapedia। Asiatic Society of Bangladesh। ২০০৮-০১-০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০২-২১ 
  6. Cotton, H.E.A., Calcutta Old and New, 1909/1980, pp. 30-33, General Printers and Publishers Pvt. Ltd.
  7. Chakraborty, Satyesh C., The Growth of Calcutta in the Twentieth Century, in Calcutta:The Living City, Vol II, Edited by Chaudhuri, Sukanta, 1990/2005, Page 14, আইএসবিএন ০১৯ ৫৬৩৬৯৭ X
  8. Sinha, Pradip, Siraj’s Calcutta, in Calcutta, the Living City, Vol I, pp. 8-9