মমতাজ বেগম (ভাষা সংগ্রামী)

একুশে পদক প্রাপ্ত ভাষা সংগ্রামী

মমতাজ বেগম (২০ মে ১৯২৩ - ৩০ মার্চ ১৯৬৭) মহান বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগ্রামী নারী ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে তিনি চরম ভাবে লাঞ্চিত ও নির্যাতিত হন, এমনকি দীর্ঘ কারাভোগ পর্যন্ত তাকে করতে হয়।

মমতাজ বেগম
জন্ম২০ মে, ১৯২৩
শিবপুর, হাওড়া,
মৃত্যু৩০ মার্চ, ১৯৬৭
জাতীয়তাপাকিস্তান
নাগরিকত্ব পাকিস্তান
পেশাশিক্ষকতা
পরিচিতির কারণভাষা আন্দোলন
দাম্পত্য সঙ্গীআব্দুল মান্নাফ
পিতা-মাতামহিমচন্দ্র রায়চৌধুরী (পিতা)
মাখনমতি দেবী (মাতা)
পুরস্কারএকুশে পদক (২০১২)

১৯২৩ সালের ২০ মে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া জেলার শিবপুরে সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম কল্যাণী রায়চৌধুরী। এবং ডাক নাম ছিলো মিনু। তার বাবা কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রায়বাহাদুর মহিমচন্দ্র রায়চৌধুরী এবং মাতা মাখনমতি দেবী ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী ছিলেন তার মামা।[]

শিক্ষা ও চাকরি জীবন

সম্পাদনা

সম্ভ্রান্ত কিন্তু অত্যন্ত রক্ষনশীল হিন্দু পরিবারে পড়াশোনার তেমন সুযোগ পান নি তিনি। তবুও নিজের একান্ত প্রচেষ্টায় ১৯৩৮ সালে কলকাতা থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। কিন্তু এরপরেই তার পরিবার থেকে পড়াশুনা ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ আসতে থাকে। নিজের অনড় সিদ্ধান্তের কারণে তার পরিবার অবশেষে তাকে কঠিন পর্দাঘেরা নিয়মের মধ্যে পড়াশুনার সুযোগ দেয়। তিনি ১৯৪২ সালে কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষা এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিএড পরীক্ষায় পাশ করেন। ১৯৫৮ সালে এডুকেশন ওয়ার্কশপ ফর টিচার্স কোর্স সম্পন্ন এবং ১৯৬৩ সালে এমএড ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৪২ সালে তিনি কলকাতার দি স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’য় যোগদান করেন। '৪৭ এর দেশ ভাগের পর তিনি ময়মনসিংহ চলে আসেন এবং শহরের বিদ্যাময়ী স্কুলে সহকারী শিক্ষিকা পদে সাত মাস শিক্ষকতা করেন। ১৯৫১ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জের মর্গ্যান হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন।[] ১৯৫৪ সালে আনন্দময়ী গার্লস স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা পদে এবং পরে কিছু সময়ের জন্য আহমদ বাওয়ানী জুটমিল বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা পদে চাকরি করেন। তাছাড়া শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে 'শিশু নিকেতন' নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

বৈবাহিক জীবন

সম্পাদনা

অত্যন্ত রক্ষনশীল পরিবারের মেয়ে হওয়া সত্বেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং পরবর্তীতে সিভিল সাপ্লাই অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আব্দুল মান্নাফের সঙ্গে তিনি ভালোবেসে বিয়ে করেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর তিনি মমতাজ বেগম নাম গ্রহণ করেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে তার সংসার ভেঙে যায়। তিনিই একমাত্র মহিলা যাকে ভাষা আন্দোলন করার দায়ে তার স্বামী তালাক দেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা

সম্পাদনা

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দলোনের সময় তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলার মর্গান হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। '৫২ এর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে মর্গান হাইস্কুলের নিকটস্থ রহমতুল্লাহ মুসলিম ইনস্টিটিউট মাঠে একটি বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে মর্গ্যান স্কুলের ছাত্রীসহ মহিলাদের প্রথম মিছিল নিয়ে উপস্থিত হন মমতাজ বেগম। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম। বিক্ষুব্ধ জনতা সারা দেশে সভা সমাবেশের উপর চলমান নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও বিশাল মিছিল বের করে। এতে নারীদের নিয়ে অন্যতম নেতৃত্ব দেন মমতাজ বেগম।

চরম বাঁধা এবং রক্ষনশীল পরিবেশের মধ্যেও নারীদের একত্রিত করে মিছিলে অংশগ্রহণ করা এবং ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে গোপণ কার্যক্রম চালানোর দায়ে পুলিশ তার নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করে। উল্লেখ্য, তিনি ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য তৎকালীন রাজনীতিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক ও মতবিনিময় করতেন। আদমজী জুট মিল শ্রমিকদের সঙ্গে বেশ কয়েকদফা বৈঠক করে তাদেরকে আন্দোলনে উৎসাহিত করেন।

২৯ ফেব্রুয়ারি সকালে তাকে গ্রেপ্তার করে হাইকোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। কোর্ট তার জামিন নামঞ্জুর করে। সংবাদ পাওয়া মাত্র ক্ষেপে ওঠে নারায়ণগঞ্জ বাসী। উত্তেজিত জনতা থানা ঘেরাও করে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মমতাজ বেগমকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু চাষাড়া পর্যন্ত যেতেই জনতার বিশাল বাঁধার মুখে পড়ে পুলিশ। শুরু করে লাঠিচার্জ এবং টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ। কিন্তু উত্তেজিত জনতার বিশাল প্রতিরোধের মুখে পড়ে পুলিশ। ঢাকা থেকে আসে পুলিশ এবং ইপিআর এর আরো ফোর্স। এদিকে উত্তাল নারায়ণগঞ্জ বাসী চাষাড়া থেকে পাগলা পর্যন্ত রাস্তার প্রায় ১৬০ টি গাছ কেটে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। পুলিশ-জনতার তীব্র সংঘর্ষে আহত হন শত শত ব্যক্তি। শতাধিক গ্রেপ্তার হন। গণগ্রেপ্তার এবং লাঠিচার্জের মুখে রাতের বেলা একটি ট্রাকে করে মমতাজ বেগম এবং তার সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃতদের ঢাকাতে নিয়ে আসা হয়। এই সংবাদ দৈনিক আজাদ, ভারতের দ্য স্টেটসম্যান সহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

এরপর সরকার মমতাজ বেগমকে শর্তাধীন বন্ড সইয়ের মাধ্যমে মুক্তি দিতে চাইলেও তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কেননা মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় তাঁর পক্ষে কোন‌ও আপস, সমঝোতা করা অসম্ভব ছিল। এই অস্বীকৃতি জন্য তাকে চাকরী খোয়াতে হয়। অন্যদিকে নিজের ধর্ম ত্যাগ করে ভালবেসে যাকে বিবাহ করেছিলেন,সেই ক্রুদ্ধ স্বামী আব্দুল মান্নাফ তাকে জেলখানাতেই তালাক দেন। []মহান ভাষা আন্দোলনের কারণে প্রথম এবং একমাত্র চাকরিচ্যুত মহিলা হলেন মমতাজ বেগম।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] দেড় বছর পর ১৯৫৩ সালের মে মাসে কারাগার থেকে মুক্তি পান। মুক্তির পর মমতাজ় অভাবে, একাকী দারিদ্রে দিন কাটিয়েছেন। জেলের অত্যাচারে তাঁর শরীর রোগজীর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

সম্মাননা

সম্পাদনা

ভাষা আন্দোলনের সুদীর্ঘ ষাট বছর পর ২০১২ সালে ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি স্বরুপ বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে।[] তার সম্মানে নারায়ণগঞ্জের মর্গান হাইস্কুলের সামনের সড়কটির নাম 'ভাষাসৈনিক মমতাজ বেগম সড়ক রাখা হয়েছে।

মৃত্যু

সম্পাদনা

বেগম মমতাজ, একুশের হত্যাকান্ডের পর প্রথম নারী যিনি সর্বাধিক সময় ধরে কারাভোগ করেন। প্রায় দেড়বছর কারাভোগ শেষে মুক্তি পান তিনি। এরপর শিক্ষা বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। তিনি ১৯৬৭ সালের ৩০ মার্চ মৃত্যু মুখে পতিত হন। শোনা যায় তাকে আজিমপুর কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়েছিল। []

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "বেগম, মমতাজ১ - বাংলাপিডিয়া"bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৪-২১ 
  2. জনকণ্ঠ, দৈনিক। "ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগী এক অনন্য নারী"দৈনিক জনকণ্ঠ || Daily Janakantha (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৪-২১ 
  3. "ভাষা নিয়ে আপস, অসম্ভব"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০২-২২ 
  4. [১] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে একুশে পদক পান মমতাজ বেগম