বিষ্ণুপুরের স্থাপত্যসমূহের তালিকা
বিষ্ণুপুর মল্লরাজাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত টেরাকোটা শৈলীতে মাকড়া বা ল্যাটেরাইট পাথরে নির্মিত স্থাপত্যের জন্য প্রসিদ্ধ।
বিষ্ণুপুরের প্রাচীন মন্দিরসমূহ
সম্পাদনামন্দির | অধিষ্ঠিত মূর্তি | চিত্র | নির্মাণকাল | ইতিহাস ও স্থাপত্য |
রাসমঞ্চ | রাধা ও কৃষ্ণ (রাস উৎসবের সময়) | ১৬০০ | মল্লরাজা বীর হাম্বীর আনুমানিক ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে এই মঞ্চটি নির্মাণ করেন।[১] বৈষ্ণব রাস উৎসবের সময় বিষ্ণুপুর শহরের যাবতীয় রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ এখানে জনসাধারণের দর্শনের জন্য আনা হত।[১] ১৬০০ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত এখানে রাস উৎসব আয়োজিত হয়েছে। [২]
রাসমঞ্চের চূড়া পিরামিডাকৃতির।[১][৩] চূড়ার মূলে চারটি করে দোচালা ও প্রতি কোণে একটি করে চারচালা রয়েছে।[৩] মঞ্চের বেদিটি মাকড়া বা ল্যাটেরাইট পাথরে নির্মিত।[১] বেদিটির উচ্চতা ১.৬ মিটার ও দৈর্ঘ্য ২৪.৫ মিটার।[১] মঞ্চটির মোট উচ্চতা ১২.৫ মিটার।[১] উপরের অংশ ইষ্টকনির্মিত।[৩] চূড়ার কাছে একটি স্বল্প পরিসর ছাদে গিয়ে উপরের অংশটি মিলিত হয়েছে।[১] গর্ভগৃহটি দেওয়াল-দ্বারা আবৃত নয়।[৩] বরং রাসমঞ্চের গর্ভগৃহটিকে ঘিরে রয়েছে তিন প্রস্থ খিলানযুক্ত দেওয়াল।[১] বাইরের সারিতে খিলানের সংখ্যা ৪০।[২] এই খিলানগুলির গায়ে পোড়ামাটির পদ্ম ও পূর্ব দেওয়ালে বিষ্ণুপুরের গায়ক-বাদকদের স্মৃতি-অলংকৃত কয়েকটি টেরাকোটার প্যানেল রয়েছে। রাসমঞ্চটি বিষ্ণুপুরের প্রচলিত স্থাপত্যরীতি অনুসরণে নির্মিত হয়নি।[৩] | |
জোড় বাংলা | কৃষ্ণ রায় | ১৬৫৫ | মল্লরাজা প্রথম রঘুনাথ সিংহ দ্বারা নির্মিত এই মন্দিরটি পরস্পর সংযুক্ত দুটি দোচালা কুটিরের সমন্বয়ে গঠিত। সংযুক্ত অংশের মধ্যস্থলে একটি চারচালা শিখর বিদ্যমান। তাই একে জোড় বাংলা বলা হয়। মন্দিরের দৈর্ঘ্য ১১.৮ মিটার, প্রস্থ ১১.৭ মিটার ও উচ্চতা ১০.৭ মিটার। মন্দিরের দেওয়ালে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী, সামাজিক জীবনযাত্রা ও শিকারের দৃশ্য টেরাকোটা অলংকরণের মাধ্যমে চিত্রিত। [৪] | |
শ্যামরায় মন্দির | শ্যামরায় | ১৬৪৩ | মল্লরাজা রঘুনাথ সিংহ টেরাকোটা কাজে সমৃদ্ধ দক্ষিণমুখী এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। এই মন্দিরের দক্ষিণদিকের দেওয়ালে নিবদ্ধ প্রাচীন উৎসর্গ লিপি থেকে এই তথ্য জানতে পারা যায়। শ্যামরায় মন্দির বিষ্ণুপুরের প্রসিদ্ধ টেরাকোটা শৈলীতে নির্মিত একটি মন্দির। মন্দিরটি চৌকো, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ১১.৪ মিটার। মন্দিরের চারদিকের খিলানগুলি সুন্দর কারুকার্যময় স্তম্ভের ওপর নির্ভর করে নির্মিত হয়ে ফাঁকা দালানের মতো অংশের সৃষ্টি করেছে। এই দালানের ভেতরে মন্দিরের গর্ভগৃহটি অবস্থিত। গর্ভগৃহের দরজা টেরাকোটা শৈলীতে ফুল ও বিভিন্ন প্রকার নকশা দ্বারা সাজানো। মন্দিরের ছাদ চৌকো ও উত্তলাকার। ছাদের চার প্রান্তে চারটি শিখর বা শীর্ষ বর্তমান। ওড়িশার স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত এই শিখরগুলি প্রত্যেকটি প্রতিসম। ছাদের ঠিক মাঝে একটি অষ্টভূজাকৃতি শিখর বা গম্বুজ বর্তমান। এই অংশে মন্দিরের উচ্চতা ১০.৭ মিটার। মন্দিরের বাইরের ও ভেতরের দেওয়ালে রাসলীলা, রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী এবং বিভিন্ন কারুকার্যের দৃশ্য আছে।[৪][৫] | |
মদনমোহন মন্দির | মদনমোহন | ১৬৯৪ | মল্লরাজা দুর্জন সিংহ এই একরত্ন ইষ্টক নির্মিত মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরটির ছাদ চৌকো ও বাঁকানো, কিনারা বাঁকযুক্ত ও মধ্যে গম্বুজাকৃতি শীর্ষ বর্তমান। মন্দিরের দেওয়ালে কৃষ্ণলীলা, দশাবতার ও অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনীর বিভিন্ন দৃশ্য ভাস্কর্যের মাধ্যমে রূপায়িত। মন্দিরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ১২.২ মিটার এবং উচ্চতা ১০.৭ মিটার।[৪] | |
রাধালালজিউ মন্দির | রাধা ও কৃষ্ণ | ১৬৫৮ | মল্লরাজা বীর সিংহ দ্বারা নির্মিত এই মন্দিরটি চৌকো বেদীর ওপর অবস্থিত। এই মন্দিরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ১২.৩ মিটার এবং উচ্চতা ১০.৭ মিটার।[৪] | |
রাধাশ্যাম মন্দির | রাধা ও কৃষ্ণ | | | ১৭৫৮ | মল্লরাজা চৈতন্য সিংহ মাকড়া পাথরের এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ১২.৫ মিটার এবং উচ্চতা ১০.৭ মিটার। মন্দিরের শিখরটি গম্বুজাকৃতির। মন্দিরের দেওয়ালে পুরাণরামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনীর স্থাপত্য লক্ষণীয়। মন্দিরের প্রবেশদ্বারে ইটের নহবতখানা আছে। পূর্বদিকে ওড়িশার স্থাপত্যরীতি অনুসারে নির্মিত তুলসীমঞ্চ ও নাটমঞ্চ বর্তমান। [৪] |
নন্দলাল মন্দির | নন্দলাল | সপ্তদশ শতাব্দী | চৌকো বেদীর ওপরে নির্মিত একচালা মন্দিরটির বাঁকানো ছাদ এক শিখর বিশিষ্ট। [৪] | |
কালাচাঁদ মন্দির | কালাচাঁদ | ১৬৫৬ | মল্লরাজা রঘুনাথ সিংহ মাকড়া পাথরের এই একচালা মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের সামনের দিকে পঙ্খের অলঙ্করণে কৃষ্ণলীলা ও পুরাণের কাহিনী দেখা যায়। [৪] | |
মদনগোপাল জীউ মন্দির | মদনগোপাল | ১৬৬৫ | মল্লরাজা বীর সিংহের পত্নী রাণী শিরোমণি দেবী মাকড়া পাথরের পাঁচচালা মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। [৪] | |
রাধাগোবিন্দ মন্দির | রাধা ও কৃষ্ণ | ১৭২৯ | মল্লরাজা কৃষ্ণ সিংহ ঝামা পাথরের একচালা মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। [৪] | |
রাধা মাধব মন্দির | রাধা ও কৃষ্ণ | ১৭৩৭ | মল্লরাজা গোপাল সিংহের পুত্রবধূ চূড়ামণিদেবী মাকড়া পাথরের এই একচালা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। [৪] | |
জোড় মন্দির শ্রেণী | ১৭২৬ | মল্লরাজা গোপাল সিংহ মাকড়া পাথরের এই মন্দিরগুলির প্রতিষ্ঠা করেন। দুটি বড় ও একটি ছোট মন্দির নিয়ে এটি জোড় মন্দির শ্রেণী নামে পরিচিত। [৪] | ||
মৃন্ময়ী মন্দির | মৃন্ময়ী | ৯৯৭ | মল্লরাজা জগৎমল্ল এই মন্দির তৈরী করেন। এই মন্দিরের পিছনে মল্লরাজাদের রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ বর্তমান। এই মন্দিরে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। [৪] | |
যুগলকিশোর মন্দির | কৃষ্ণ ও বলরাম | অষ্টাদশ শতাব্দী | গৌড়ীয় স্থাপত্যে পাশাপাশি অবস্থিত মন্দির দুটি নির্মিত হয়েছে। [৪] | |
মহাপ্রভু মন্দির | অষ্টাদশ শতাব্দী | উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মন্দিরটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। [৪] | ||
মল্লেশ্বর মন্দির | মল্লেশ্বর | ১৬২২ | মল্লরাজা বীর সিংহ মাকড়া পাথরের এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। [৪] |
বিষ্ণুপুরের অন্যন্য প্রাচীন স্থাপত্য
সম্পাদনাস্থাপত্য | চিত্র | নির্মাণকাল | বর্ণনা |
বড় পাথর দরজা | সপ্তদশ শতাব্দী | মাকড়া পাথরের তৈরী খিলান সজ্জিত এই প্রবেশপথটি মল্লরাজা বীর সিংহ তৈরী করেন। এটি বিষ্ণুপুরের প্রাচীন দুর্গের উত্তরদিকের প্রবেশ পথ। তোরণের মধ্যে প্রবেশ পথের দুই দিকে সৈন্য সমাহারের উপযোগী দুই তল বিশিষ্ট দালান বর্তমান। [৪] | |
ছোট পাথর দরজা | সপ্তদশ শতাব্দী | মাকড়া পাথরের তৈরী এই প্রবেশপথটি মল্লরাজা বীর সিংহ তৈরী করেন। [৪] | |
পাথরের রথ | সপ্তদশ শতাব্দী | দ্বিতল রথটি মাকড়া পাথরের তৈরী। এর নিচের অংশ রাসমঞ্চের অনুরূপ এবং উপরের দিকটি বিষ্ণুপুরের অন্যান্য মন্দিরের মতো তৈরী করে হয়েছে। [৪] | |
গুমগড় | সপ্তদশ শতাব্দী | মল্লরাজা বীর সিংহ গুমগড়ের প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্থাপত্যটি কি কাজে ব্যবহৃত হত, সে বিষয়ে বহুমত রয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে, এটি ছিল রাজবাড়ীর জলের ট্যাঙ্ক। [৪] | |
লালবাঈ মহল | মল্লরাজা রঘুনাথ সিংহ নর্তকী লালবাঈয়ের রূপে অনুরক্ত হয়ে রাজ অন্তঃপুরের বাইরে লালবাঈয়ের বসবাসের জন্য এই ভবন নির্মাণ করে দেন। বর্তমানে এটি উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। [৪] |
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ বিষ্ণুপুর, এস এস বিশ্বাস, ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ, নতুন দিল্লি, ১৯৯২, পৃ. ২৩-২৪
- ↑ ক খ মল্লভূম বিষ্ণুপুর, মনোরঞ্জন চন্দ্র, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৪, পৃ. ৬২২-২৮
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা মন্দির: ডার্করুম থেকে আলোয়, ঋত্বিক মল্লিক, প্রকাশন বিভাগ, কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক, ভারত সরকার, নতুন দিল্লি, ২০১০, পৃ. ২২
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড ঢ ণ ত থ দ ধ ন মন্দির নগরী বিষ্ণুপুর, বিশ্বজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, মুদ্রক - মিনার্ভা অফসেট, বিষ্ণুপুর
- ↑ India, ডরলিং কিন্ডার্স্লে লিমিটেড, লন্ডন, আইএসবিএন ০-৭৫১৩-৩৩৫৬-৫