বারকরী সম্প্রদায়
বারকরী (আক্ষরিক অর্থে, ‘তীর্থযাত্রী’) হল হিন্দুধর্মের একটি ভক্তিবাদী সম্প্রদায়। ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্য ও উত্তর কর্ণাটক অঞ্চলে এই সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রয়েছে। বারকরীরা পন্ধরপুরের প্রধান দেবতা বিট্ঠল বা বিঠোবার (কৃষ্ণের একটি রূপ) উপাসনা করেন। এই সম্প্রদায়ের সন্ত ও গুরুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জ্ঞানেশ্বর, নামদেব, চোখামেলা, একনাথ ও তুকারাম। এঁদের সকলকেই ‘সন্ত’ উপাধি দ্বারা সম্মানিত করা হয়।
বারকরী সম্প্রদায়ের অনুগামীরা বিঠোবার উপাসনা করেন এবং জীবন সম্পর্কে একটি কর্তব্যকেন্দ্রিক ধারণা পোষণ করেন। তাঁরা নৈতিক আচরণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁরা মদ ও তামাক কঠোরভাবে পরিত্যাগ করে চলেন। সেই সঙ্গে কঠোরভাবে দুগ্ধজাত খাদ্যের উপর নির্ভরশীল হন। তাঁরা মাসে দুইবার একাদশী উপলক্ষ্যে উপবাস করেন। ছাত্রজীবনে তাঁরা ব্রহ্মচারী অবস্থায় থাকেন। বর্ণভেদ প্রথা বা আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে বৈষম্যকে অস্বীকার করে তাঁরা সামাজিক সাম্য ও মানবতার কথা প্রচার করেন। তাঁরা প্রতিদিন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ও হরিপাঠ থেকে পাঠ করেন এবং নিয়মিত ভজন ও কীর্তন গান করেন।
প্রভাব
সম্পাদনাখ্রিস্টীয় ১৩শ শতাব্দীতে ভক্তি আন্দোলনের যুগে বারকরী মতবাদ একটি ‘পন্থে’র (একই ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুগামীদের নিয়ে গঠিত সম্প্রদায়) রূপ পায়। সেই সময় থেকেই বারকরী প্রথা মহারাষ্ট্রের হিন্দু সংস্কৃতির অঙ্গ। বারকরীরা প্রায় ৫০ জন সন্তকবিকে (‘সন্ত’) চিহ্নিত করেন। এঁদের ৫০০ বছরের রচনার একটি সংকলন খ্রিস্টীয় ১৮শ শতাব্দীর এক সন্তজীবনীতে নথিভুক্ত হয়। বারকরীরা বিশ্বাস করেন, এই সন্তেরা একই আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার বহন করছেন।[১]
তীর্থযাত্রা
সম্পাদনাবারকরী মতানুসারীরা প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে পন্ধরপুরে তীর্থযাত্রা করেন। এই সময় তাঁরা সন্তদের পালকি তাঁদের সমাধি স্থল থেকে বহন করে নিয়ে যান। ১৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে তুকারামের কনিষ্ঠ পুত্র নারায়ণ মহারাজ ডুলিতে করে সন্তদের পাদুকা নিয়ে যাওয়ার প্রথা চালু করেন। ১৮২০-এর দশকে তুকারামের উত্তরপুরুষ ও জ্ঞানেশ্বরের ভক্ত তথা সিন্ধিয়াদের সভাসদ হৈবর্তববাবা তীর্থযাত্রার প্রথায় আরও কিছু পরিবর্তন আনেন।[২][৩]
খ্রিস্টীয় ১৪শ শতাব্দীর আগে থেকেই বিট্ঠলের ভক্তদের তীর্থযাত্রার প্রথা চলে আসছে।[৪] বর্তমানে ভক্তেরা মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ৪০টি পালকি নিয়ে তীর্থযাত্রা করেন।[৫] তীর্থযাত্রার আরেকটি তারিখ হল কার্তিক মাসের শুক্লা একাদশী তিথি।
তীর্থযাত্রার সময় ‘রিঙ্গন’ ও ‘ধাবা’ নামে দুটি অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। রিঙ্গন অনুষ্ঠানে ‘মৌলিঞ্চ অশ্ব’ নামে একটি আরোহীবিহীন গপবিত্র ঘোড়া তীর্থযাত্রীদের মাঝখান দিয়ে ছুটে যায়। মনে করা হয়, ডুলিতে যে সন্তের মূর্তি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এই ঘোড়াটি তারই আত্মা। তীর্থযাত্রীরা ঘোড়ার ক্ষুরের থেকে বিক্ষিপ্ত ধুলো তুলে নিয়ে মাথায় মাখেন। ‘ধাবা’ আরেক ধরনের দৌড়বাজির অনুষ্ঠান। এই দৌড়ে সকলেই জয়ী হন। তুকারাম যে অবস্থায় প্রথম পন্ধরপুরের মন্দিরটিকে দেখেছিলেন, তারই স্মরণে এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। উল্লেখ্য, তিনি মন্দিরটি দেখে আনন্দের আতিশায্যে মন্দিরের দিকে দৌড়ে গিয়েছিলেন।[৬]
বারকরীদের জীবনযাত্রা
সম্পাদনাবারকরীরা তুলসী মালা ধারণ করেন। তাঁরা দুগ্ধজাত খাদ্য ও সাত্ত্বিক আহার গ্রহণ করেন। এছাড়া অনেক বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মতো তাঁরাও রান্নায় পিঁয়াজ ও রসুন পরিহার করেন। এই সম্প্রদায়ের অনুগামীরা মদ ও তামাকও পরিহার করে চলেন।[৭]
বিশিষ্ট সন্ত
সম্পাদনাবারকরী সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য সন্তেরা হলেন জ্ঞানেশ্বর, মুকতাই, নামদেব, সেনা নাহবি, চোখামেলা, ভানুদাস, একনাথ, তুকারাম, নরহরি সোনার, সবত মালী, কাহ্নোপাত্র, বহিনাবাই।
তীর্থস্থান
সম্পাদনাবারকরী সম্প্রদায়ের পাঁচটি প্রধান তীর্থস্থান হল পন্ধরপুরের বিঠোবা মন্দির , আলান্দির জ্ঞানেশ্বর সমাধি, দেহুর তুকারাম মহারাজ জন্মস্থান মন্দির, সন্ত তুকারাম বৈকুণ্ঠস্থান মন্দির, সন্ত তুকারাম মহারাজ গাথা মন্দির, পৈঠানের সন্ত জগন্দে মহারাজ মন্দির ও শেগাঁওের শ্রী সন্ত গজানন মহারাজ মন্দির ।
সাহিত্য
সম্পাদনাবারকরী সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য ধর্মগ্রন্থগুলি হল জ্ঞানেশ্বরের জ্ঞানেশ্বরী ও অম্রুতানুভব, তুকারামের তুকারাম গাথা, সোপানদেওর সোপানদেবী, নামদেবের নামদেব-গাথা, একনাথের একনাথী-ভাগবত এবং জ্ঞানেশ্বর ও একনাথের হরিপাঠ।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Schomer, Karine; McLeod, W. H., সম্পাদকগণ (১৯৮৭)। The Sants: Studies in a Devotional Tradition of India। Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা 3–4। আইএসবিএন 9788120802773।
- ↑ "The wari tradition"। Wari Santanchi। ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪।
- ↑ Mokashi, Digambar Balkrishna; Engblom, Philip C (Translator) (১৯৮৭)। Palkhi: An Indian Pilgrimage। Albany: State University of New York Press। পৃষ্ঠা 18। আইএসবিএন 0-88706-461-2।
- ↑ Gethe, Subhash। "Varkari Movement"। সংগ্রহের তারিখ ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪।
- ↑ Hindu.com ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১ অক্টোবর ২০০৭ তারিখে and page 21 of VidyaOnline.net ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে
- ↑ Mokashi, Digambar Balkrishna; Engblom, Philip C (Translator) (১৯৮৭)। Palkhi: An Indian Pilgrimage। Albany: State University of New York Press। পৃষ্ঠা 264। আইএসবিএন 0-88706-461-2।
- ↑ Dikshit, S H (১৯৭১)। Varkari। Wai Maharashtra: Marathi Vishwakosh। সংগ্রহের তারিখ ৩ এপ্রিল ২০১৫।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
আরও পড়ুন
সম্পাদনা- Iwao, Shima (জুন–সেপ্টেম্বর ১৯৮৮)। "The Vithoba Faith of Maharashtra: The Vithoba Temple of Pandharpur and Its Mythological Structure" (পিডিএফ)। Japanese Journal of Religious Studies। Nanzan Institute for Religion and Culture। 15 (2–3): 183–197। আইএসএসএন 0304-1042। ২০০৯-০৩-২৬ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা।