বাংলা সংস্কৃতিতে ভূত

বাংলা সংস্কৃতি ও লোককাহিনীতে শয়তান ও ভূতের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

বাংলা সংস্কৃতিতে ভূত বা বাংলা লোকসাহিত্যে ভূত একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পুরাতন এবং নতুন উভয় বাংলা রূপকথায় প্রায়ই ভূতের ধারণা ব্যবহার করা হয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও প্রায়ই ভূতের উদাহরণ পাওয়া যায়। বিশ্বাস করা হয়, ভূত হল সেই সব অশরীরি আত্মা যারা মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে শান্তি খুঁজে পায়নি (যাদের অতৃপ্ত আত্মাও বলা হয়ে থাকে) বা পৃথিবীতে অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে (যেমন খুন, আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনা)। এছাড়াও বিশ্বাস করা হয়, অন্যান্য জীবজন্তু বা প্রাণীও তাদের মৃত্যুর পরে ভূতে পরিণত হতে পারে। বাংলায় ভূতকে মাঝে মাঝে প্রেতাত্মা (সংস্কৃত) হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। প্রেতাত্মার নারীবাচক শব্দকে পেত্নী হিসেবে এবং পুরুষবাচক শব্দকে প্রেত বলা হয়ে থাকে।

রাজার দরবারে একটি রাক্ষসীকে (এক ধরনের প্রেত) দেখানো ছবি। এটি ঠাকুরমার ঝুলি (১৯০৭) থেকে নেয়া।

বিভিন্ন ধরনের ভূত

সম্পাদনা

বাংলা সংস্কৃতিতে অনেক ধরনের ভূতের বিশ্বাস রয়েছে; তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো,

  • পেত্নী: পেত্নী হলো মেয়ে ভূত যার বেঁচে থাকতে কিছু অতৃপ্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল এবং অবিবাহিতভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। পেত্নী শব্দটি সংস্কৃত প্রেতিনী শব্দ থেকে এসেছে (পুরুষবাচক শব্দ প্রেত)। এসব ভূত সাধারণত যে কোন আকৃতি ধারণ করতে পারে, এমনকি পুরুষের আকারও ধারণ করতে পারে। এরা সাধারণত বেঁচে থাকতে কোন অপরাধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে এবং মৃত্যুর পর অভিশপ্ত হয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করে। পেত্নীরা সাধারণত ভীষণ বদমেজাজী হয়ে থাকে এবং কাউকে আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত স্পষ্টতই মানুষের আকৃতিতে থাকে। পেত্নীদের আকৃতিতে একটিই সমস্যা রয়েছে, তা হলো তাদের পাগুলো পিছনের দিকে ঘোরানো। তাদেরকে চেনার একটিই উপায় আছে এবং সেটা হলো তাদের পা দেখে। যদিও এরা সাধারণ নারীর বেশ ধরে থাকতে পারে কিন্তু তারপরও তাদের পাগুলো পেছনের দিকে ঘোরানো থাকে অর্থাৎ মানুষের বেশ ধরে থাকা অবস্থাতেও তাদের এবং পায়ের পাতা ও আঙুল পেছনের দিকে ঘোরানো থাকে।
 
শাঁকচুন্নি
  • শাঁকচুন্নি: শাঁকচুন্নি শব্দটি সংস্কৃত শব্দ শঙ্খচূর্ণী থেকে এসেছে। এটা হলো হিন্দু বিবাহিত মহিলাদের ভূত, যারা বিশেষভাবে তৈরি বাঙ্গালি শুভ্র পোশাক শাড়ি পরিধান করে এবং হাতে শঙ্খ বা শাঁখা পরিধান করে। শাঁখা হলো বাঙ্গালি বিবাহিত হিন্দু মহিলাদের প্রতীক। শাকচুন্নিরা সাধারনত ধনী বিবাহিতা মহিলাদের উপর ভর করে বা আক্রমণ করে যাতে করে তারা নিজেরা সেই মহিলার মত জীবন যাপন করতে পারে ও বিবাহিত জীবন উপভোগ করতে পারে। লোকগাথা অনুসারে তারা শেওড়া গাছে বসবাস করে।
  • চোরাচুন্নি: চোরাচুন্নি অত্যন্ত দুষ্ট ভূত। এরা মানুষের অনিষ্ট করে থাকে। সাধারণত কোন চোর মৃত্যুবরণ করলে চোরাচুন্নিতে পরিণত হয়। পূর্ণিমা রাতে এরা বের হয় এবং মানুষের বাড়িতে ঢুকে পড়ে অনিষ্ট সাধন করে। এদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাড়িতে গঙ্গাজল ছিটানোর (হিন্দু সংস্কৃতিতে গঙ্গা জলকে পবিত্র জল হিসেবে বিবেচনা করা হয়) ব্যবস্থা করা হয়।
  • পেঁচাপেঁচি: এ ধরনের ভূত সচরাচর দেখা যায় না। পেঁচাপেঁচি ভূত ধারণাটি পেঁচা থেকে এসেছে। এর স্ত্রীবাচক হলো পেঁচি। এরা জোড়া ধরে থাকে ও জোড়ায় শিকার করে থাকে। বাংলার বিভিন্ন জঙ্গলে এদের দেখা যায় বলে বিশ্বাস করা হয়। এরা সাধারণত জঙ্গলে দুর্ভাগা ভ্রমণকারীদের পিছু নেয় এবং সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় ভ্রমণকারীকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে ও শিকারের মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়।
  • মেছোভূত: এ ধরনের ভূতেরা মাছ খেতে পছন্দ করে। মেছো শব্দটি বাংলা মাছ থেকে এসেছে। মেছো ভূত সাধারণত গ্রামের কোনো পুকুরপাড়ে বা জলাশয়ের ধারে, যেখানে বেশি মাছ পাওয়া যায়, সেখানে বসবাস করে। মাঝে মাঝে তারা গেরস্থের রান্নাঘর বা জেলেদের নৌকা থেকেও মাছ চুরি করে খায়। বাজার থেকে কেউ মাছ কিনে গাঁয়ের রাস্তা দিয়ে ফিরলে এটি তার পিছু নেয় এবং নির্জন বাঁশঝাড়ে বা বিলের ধারে ভয় দেখিয়ে আক্রমণ করে মাছ ছিনিয়ে নেয়।
  • দেও: এ ধরনের ভূত পুকুর-ডোবা, নদী এবং বিভিন্ন জলাশয়ে বসবাস করে। এরা লোকজনকে জলে ফেলে ডুবিয়ে মারে বলে বিশ্বাস করা হয়। জলাশয়ে স্নান করতে আসা মানুষদের একা পেলে এরা নীচ থেকে তাদের পা টেনে ধরে জলের গভীরে নিয়ে যায়। এতে করে সেই ব্যক্তি শ্বাসরোধ হয়ে মারা যায়।
  • নিশি: ভূতদের মধ্যে অন্যতম ভয়ংকর হলো নিশি। অন্যান্য ভূত সাধারণত নির্জন এলাকায় মানুষকে একা পেলে আক্রমণ করে। কিন্তু নিশি গভীর রাতে শিকারকে তার প্রিয় মানুষের কন্ঠে নাম ধরে ডাকে এবং বাইরে বের করে নিয়ে যায়। নিশির ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ সম্মোহিত হয়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে; আর কখনো ফিরে আসে না। মনে করা হয় তারা নিজেরাও নিশিতে পরিণত হয়। কিছু কিছু তান্ত্রিক অন্যের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নিশি পুষে থাকে। লোককাহিনী অনুসারে নিশিরা কোন মানুষকে তিনবারের বেশি ডাকতে পারে না। তাই গ্রাম বাংলায় মনে করা হয় যে কারো উচিত রাতে তিনবারের বেশী ডাকলেই ঘর থেকে বের হওয়া। এতে করে নাকি নিশির আক্রমণের ভয় থাকে না।
  • মামদো ভূত: হিন্দু বিশ্বাস মতে, এটি মুসলমান ব্যক্তিদের আত্মা। এদের শরীরের গঠন অদ্ভূত। কোমরের নীচ থেকে ক্রমান্বয়ে সরু হয়ে গেছে। এদের কোন পা নেই এবং এরা বাতাসে ভেসে থাকে। এদের কারোর মাথায় টুপি এবং লম্বা লম্বা দাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। এরা সাধারণত কবরস্থানে ও আশে-পাশে থাকা বড় ও ঘন গাছ-পালায় বসবাস করে এবং সেখান দিয়ে কেউ গেলে এরা তাদের বিভিন্ন ভাবে ভয় দেখায় বলে লোককথা প্রচলিত রয়েছে।
  • গেছোভূত: গেছো ভূত গাছে বসবাস করে। গেছো শব্দটি গাছ (বৃক্ষ) শব্দ থেকে এসেছে। লোকগাথা অনুসারে যেসব মানুষ গাছের ডালে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে, তাদের আত্মা সেই গাছেই থেকে যায় এবং গেছো ভূতে পরিণত হয়। তবে তারা বিভিন্ন গাছেই বসবাস করে থাকে। বড় ও ঝাঁকালো গাছপালা এদের প্রিয় আশ্রয়স্থল। এরা বিভিন্ন ভাবে মানুষকে ভয় দেখায়। এদের সম্পর্কে অতি প্রচলিত ধারণটি হচ্ছে, রাতে যখন কোন ব্যক্তি একা পথ দিয়ে হেঁটে যায়, তখন এরা গাছে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে থাকে। ফলে সেই ব্যক্তিটি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কারো কারো অভিমত অনুসারে এদের শরীরের গঠন অনেকটা বানরের মতো এবং এরা তালগাছে থাকে। আবার কারো কারো ভাষ্য মতে (যারা দেখেছে) এরা তালগাছ থেকে এমন ভাবে নিচে নেমে আসে যেমন করে টিকটিকি দেওয়ালে চলাফেরা করে অর্থাৎ মাথা নিচের দিকে ও পা উপরের দিকে রেখে গাছ বেয়ে নেমে আসে।
 
ব্রহ্মদৈত্য
  • জোকা ভূতঃ এ ধরনের ভূত পুকুর-ডোবা, নদী এবং বিভিন্ন জলাশয়ে বসবাস করে। ভালো জোকা (ধনজোকা) হলে অন্য় ব্যক্তিদের ধন-সম্পত্তি দান করে থাকে বলে শোনা যায়। এদের উচ্চতা কম হয়, গায়ের রঙ সাধারনত কালো হয়।
  • ব্রহ্মদৈত্য: এধরনের ভূত সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং এরা সাধারণত কারো ক্ষতি করে না। এ ধরনের ভূতরা হলো ব্রাহ্মণের ভূত। সাধারণত এরা সাদা ধুতি ও পৈতা পরিহিত অবস্থায় বিচরণ করে। এদেরকে পবিত্র ভূত হিসেবে গণ্য করা হয়। তারা অত্যন্ত দয়ালু ও মানুষকে অনেক উপকার করে থাকে। বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে এদের চরিত্র চিত্রায়িত হয়।
  • আলেয়া: রাতের অন্ধকারে জলাভূমিতে বা খোলা প্রান্তরে আলেয়া দেখা যায়। মাটি হতে একটু উঁচুতে আগুনের শিখা জ্বলতে থাকে। লোককথায় একে ভৌতিক আখ্যা দেওয়া হলেও বিজ্ঞানীরা মনে করে গাছপালা পচনের ফলে যে মার্শ (মিথেন জাতীয়) গ্যাসের সৃষ্টি হয় তা থেকে আলেয়ার উৎপত্তি। এর ফলে জেলেরা ভুল বুঝে সহ্য ক্ষমতা হারিয়ে মৃত্যুবরণ করে।
  • বেঘোভূত: এরা হলো সেইসব মানুষের আত্মা যারা বাঘের আক্রমণে মৃত্যুবরণ করেছে বলে বিশ্বাস করা হয়। সাধারণত সুন্দরবন এলাকায় এধরনের ভূতের কথা বেশি প্রচলিত কারণ বাঘের অভয়ারণ্য হলো সুন্দরবন। এসব ভুতেরা জঙ্গলে মধু আহরণে আগত গ্রামবাসীদের ভয় দেখায় এবং বাঘের সন্নিকটে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে এরা গ্রামবাসীদের ভয় দেখানোর জন্য বাঘের স্বরে ডেকে উঠে।[]
  • স্কন্ধকাটা/কন্ধকাটা/ কবন্ধ: এই ভূতেরা মাথাবিহীন হয়ে থাকে। সচরাচর এরা হলো সেইসব লোকের আত্মা যাদের মৃত্যুর সময় মাথা কেটে গেছে যেমন, রেল দুর্ঘটনা, হত্যা, অপঘাত, বা অন্য কোন দুর্ঘটনা। এ শ্রেণীর ভূতেরা সবসময় তাদের হারানো মাথা খুঁজে বেড়ায় এবং অন্য মানুষকে আক্রমণ করে তাদের দাসে পরিণত করে ও তার মাথা খুঁজার কাজে নিয়োগ করে।
  • কানাভুলো: এ শ্রেণীর ভূতেরা পথিকের গন্তব্য ভুলিয়ে দিয়ে ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয় এবং অচেনা স্থানে নিয়ে আসে। মাঝে মাঝে মানুষ একই রাস্তায় বারবার ঘোরপাক খেতে থাকে। এই ভূতরা কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর পর তার শিকারকে মেরে ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে শিকার তার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এধরনের ভূতদের রাতে গ্রামের মাঠের ধারে পথের মধ্যে দেখা যায়। শিকার সবসময় একাকী থাকে বা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
  • ডাইনী: ডাইনী মূলত কোন আত্মা নয়, এরা জীবিত নারী। বাংলা লোকসাহিত্যে সাধারনত বৃদ্ধ মহিলা যারা কালো জাদু বা ডাকিনীবিদ্যাতে পারদর্শী তাদেরকেই ডাইনি বলা হয়ে থাকে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, ডাইনীরা গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ধরে নিয়ে তাদের হত্যা করে এবং তাদের হাড়, মাংস ও রক্ত খেয়ে ১০০ বছর বেঁচে থাকে।
  • ঝেঁয়ো পেত্নী: সাধারণত ঝাউগাছে এরা নিজেদের লুকিয়ে রাখে। ভরসন্ধ্যাবেলায় পথিক যদি একা একা সেই ঝাউবন বা জঙ্গল পেরুতে যায়, তখন তাকে ধরে ঝাউয়ের মগডালে চড়িয়ে দেয় এ জাতীয় পেত্নীরা।
  • ডাকিনী: ডাইনি বুড়িদের অনুগতশ্রেণির ভূত। পাতিহাঁস খেতে খুব ভালোবাসে এরা। থাকে পুকুর বা দীঘির ধারে কোনো তাল বা নারিকেল গাছে। রাতদুপুরে অল্পবয়সী মেয়ের বেশে ঘুরে বেড়ানো এদের অন্যতম অভ্যাস।
  • গোভূতঃ গলায় দড়িতে জড়িয়ে অপঘাতে গরু মরে এই ধরনের ভূত হয়ে থাকে। স্কন্ধকাটার মতো এদেরও মাথা থাকে না। গভীর রাতে প্রচন্ড খুড়ের শব্দ করে এরা রাস্তা ধরে ছুটতে থাকে। বাংলাদেশের কোথাও কোথাও এদের গল্প প্রচলিত রয়েছে।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ আগস্ট ২০১৫ 

আরও দেখুন

সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা