বগাকাইন হ্রদ

বাংলাদেশের হ্রদ
(বগালেক থেকে পুনর্নির্দেশিত)

বগাকাইন হ্রদ বা বগা লেক বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উচ্চতার স্বাদু পানির একটি হ্রদ[] বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে বগাকাইন হ্রদের অবস্থান কেওকারাডং পর্বতের গা ঘেষে, রুমা উপজেলায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ১,২৪৬ ফুট (৩৮০ মিটার) (কিওক্রাডাং-এর উচ্চতা ৩,১৭২ ফুট)। ফানেল বা চোঙা আকৃতির[] আরেকটি ছোট পাহাড়ের চুড়ায় বগা হ্রদের অদ্ভুত গঠন অনেকটা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মতো।

বগাকাইন হ্রদ
বগাকাইন হ্রদ
অবস্থানরুমা উপজেলার পূর্ব দিকে
স্থানাঙ্ক২২°০২′৩০″ উত্তর ৯২°২৪′১৬″ পশ্চিম / ২২.০৪১৬৭° উত্তর ৯২.৪০৪৪৪° পশ্চিম / 22.04167; -92.40444
ধরনআবদ্ধ হ্রদ
প্রাথমিক অন্তর্প্রবাহশঙ্খ নদী
অববাহিকার দেশসমূহবাংলাদেশ
পৃষ্ঠতল অঞ্চল১৫ একর
গড় গভীরতা৩৮ মিটার (১২৫ ফুট)
পৃষ্ঠতলীয় উচ্চতা২,৪০০ ফুট

অবস্থান

সম্পাদনা

রুমা উপজেলার পূর্ব দিকে শঙ্খ নদীর তীর থেকে ২৯ কিলোমিটার অভ্যন্তরে অবস্থিত একটি মৌজার নাম 'নাইতং মৌজা'। এই মৌজার পলিতাই পর্বতশ্রেণীর অন্তর্গত একটি পাহাড়ের চূড়ায় হ্রদটি অবস্থিত।[]

 
বগাকাইন হ্রদ প্যনোরামা

উৎপত্তি ও গঠন

সম্পাদনা
 
বগাকাইন হ্রদ - নীল পানি

বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিকগণের মতে বগাকাইন হ্রদ মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ কিংবা মহাশূন্য থেকে উল্কাপিণ্ডের পতনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে আবার ভূমিধ্বসের কারণেও এটি সৃষ্টি হতে পারে বলে মত প্রকাশ করেছেন। এটি ভুবন স্তরসমষ্টির (Bhuban Foundation) নরম শিলা দ্বারা গঠিত। বাংলাপিডিয়া অনুযায়ী এর পানি বেশ অম্লধর্মী এবং একারণে এতে কোনো শ্যাওলা বা অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ নেই, এবং কোনো জলজ প্রাণীও এখানে বাঁচতে পারেনা বলা হলেও[] ২০০৯-এর তথ্যসূত্রে জানা যায় বগা হ্রদের পানি অত্যন্ত সুপেয়, এবং হ্রদের জলে প্রচুর শ্যাওলা, শালুক, শাপলা ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ এবং প্রচুর মাছ এমনকি বিশালাকার মাছ রয়েছে।[]

ইতিহাস

সম্পাদনা

বগাকাইন হ্রদ সৃষ্টি নিয়ে বম, মারমা, ম্রো, খুমি ও ত্রিপুরাদের পৌরাণিক কাহিনি বা কিংবদন্তি রয়েছে। এমন একটি পৌরাণিক কাহিনি হল বগাহ্রদের পাশে একটি বম পাড়া (বগামুখপাড়া) এবং একটি মুরং পাড়া আছে। স্থানীয় আদিবাসীরা বম, মুরং বা ম্রো, তঞ্চংগ্যা এবং ত্রিপুরাসহ অন্যান্য আদিবাসী। স্থানীয় আদিবাসীদের উপকথা অনুযায়ী, অনেক কাল আগে পাহাড়ের গুহায় একটি ড্রাগন বাস করতো। বম ভাষায় ড্রাগনকে "বগা" বলা হয়। ড্রাগন-দেবতাকে তুষ্ট করতে স্থানীয়রা গবাদী পশু উৎসর্গ করতেন। কিন্তু একবার কয়েকজন এই ড্রাগন দেবতাকে হত্যা করলে চূঁড়াটি জলমগ্ন হ্রদে পরিণত হয় এবং গ্রামগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে। যদিও এই উপকথার কোনো বাস্তব প্রমাণ নেই, তবুও উপকথার আগুন উদগীরণকারী ড্রাগন বা বগা এবং হ্রদের জ্বালামুখের মতো গঠন মৃত আগ্নেয়গিরির ধারণাটির সাথে মিলে যায়।[]

অপর এক পৌরাণিক কাহিনীতে বলা হয়েছে বগা লেক ছিল একটি সমৃদ্ধ ম্রো গ্রাম। গ্রামের পাশে একটি সুড়ঙ্গে বড় আকারের সাপ থাকত। এক দিন ওই সাপ গ্রামবাসী ধরে খেয়ে ফেলে। ওই সাপ খাওয়ায় নাগরাজার প্রতিশোধের কারণে গ্রামবাসীসহ গ্রামটি দেবে গিয়ে বগা লেকের সৃষ্টি হয়। এখনো অনেক বম, ম্রোর বিশ্বাস, হ্রদের গভীরে থাকা নাগরাজ লেজ নাড়ালে হ্রদের পানি ঘোলাটে হয়ে ওঠে।[]

সাধারণ বর্ণনা

সম্পাদনা

এই হ্রদটি তিনদিক থেকে পর্বতশৃঙ্গ দ্বারা বেষ্টিত। এই শৃঙ্গগুলো আবার সর্বোচ্চ ৪৬ মিটার উঁচু বাঁশঝাড়ে আবৃত। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৫৭ মিটার ও ৬১০ মিটার উচ্চতার মধ্যবর্তী অবস্থানের একটি মালভূমিতে অবস্থিত। এর গভীরতা হচ্ছে ৩৮ মিটার (১২৫ ফুট)। এটি সম্পূর্ণ আবদ্ধ হ্রদ— এ থেকে পানি বের হতে পারে না এবং কোনো পানি ঢুকতেও পারে না। এর আশেপাশে পানির কোনো দৃশ্যমান উৎসও নেই। তবে হ্রদ যে উচ্চতায় অবস্থিত তা থেকে ১৫৩ মিটার নিচে একটি ছোট ঝর্ণার উৎস আছে যা বগা ছড়া নামে পরিচিত। হ্রদের পানি কখনও পরিষ্কার আবার কখনওবা ঘোলাটে হয়ে যায়। কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন এর তলদেশে একটি উষ্ণ প্রস্রবণ রয়েছে। এই প্রস্রবণ থেকে পানি বের হওয়ার সময় হ্রদের পানির রঙ বদলে যায়।[]

পর্যটন

সম্পাদনা

স্থানীয় অধিবাসীদের ধারণা এই হ্রদের আশেপাশে দেবতারা বাস করে। এজন্য তারা এখানে পূজা দেন।[] তবে রহস্যময় উপকথা এবং অকল্পনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বগাকাইন হ্রদকে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রেকিং এবং ক্যাম্পিং এলাকায় পরিণত করেছে। বিশেষ করে কিওক্রাডাং যেতে হলে বগাকাইন হ্রদে যাত্রাবিরতি ছাড়া গত্যন্তর নেই। তবে এখানকার যাতায়াত ব্যবস্থা বেশ দুর্গম; অত্যন্ত দুর্গম পথে পায়ে হাঁটা ছাড়া গত্যন্তর নেই।[] অতি সম্প্রতি (২০১০) রুমা থেকে সরাসরি বগামুখপাড়ায় জীপ (চান্দের গাড়ি বা চাঁদের গাড়ি) চালু হয়েছে। তবে এ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আর বুনো জীবনের লোভে ঝিরির পথ নামের আরেকটা পথ ব্যবহার করে থাকেন। বগাকাইন হ্রদে একটি সেনা ক্যাম্প এবং দুটি থাকার জায়গা রয়েছে, যার একটি স্থানীয় বমদের দ্বারা চালিত, আর অন্যটি সরকার-চালিত। রয়েছে একটি স্কুল ও একটি গির্জাও। বর্তমানে পর্যটকদের যথেচ্ছ আচরণে হ্রদটির প্রাণবৈচিত্র্য এবং নিকট-অরণ্যের প্রাণবৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখিন।

গ্যালারি

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. এস. এম. মাহফুজুর রহমান; সিফাতুল কাদের চৌধুরী। "বগাকাইন হ্রদ"। বগাকাইন হ্রদ (সিডি)। বাংলাপিডিয়া (২য় সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। 
  2. সাঈদ সৌম্য (জুন ২৮, ২০০৯)। "ড্রাগনের ঘর বগা হ্রদ"দৈনিক সমকাল। ঢাকা। ২৮ জুন ২০১০ তারিখে মূল (ওয়েব) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জুন ৩০, ২০১০ 
  3. "বগা লেকের পানি হঠাৎ ঘোলা কেন?"www.prothomalo.com। ২০২০-০২-০৩। Archived from the original on ২০২০-০২-০৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০২-০৩ 

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা