পাখি পরিযান

পাখির নিয়মিত গমনাগমন

পাখি পরিযান বলতে নির্দিষ্ট প্রজাতির কিছু পাখির প্রতি বছর বা কয়েক বছর পর পর একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে বা সময়ে কম করে দু’টি অঞ্চলের মধ্যে আসা-যাওয়াকেই বোঝায়। জীবজন্তুর ক্ষেত্রে মাইগ্রেশন (ইংরেজি: Migration) এর সঠিক পরিভাষা হচ্ছে সাংবাৎসরিক পরিযান।[] যেসব প্রজাতির পাখি পরিযানে অংশ নেয়, তাদেরকে পরিযায়ী পাখি বলে। এ পাখিরা প্রায় প্রতিবছর পৃথিবীর কোনো এক বা একাধিক দেশ বা অঞ্চল থেকে বিশ্বের অন্য কোন অঞ্চলে চলে যায় কোনো একটি বিশেষ ঋতুতে। সে ঋতু শেষে সেগুলো আবার ফিরে যায় যেখান থেকে এসেছিল সেখানে। এমন আসা যাওয়া কখনো এক বছরে সীমিত থাকে না। এ ঘটনা ঘটতে থাকে প্রতি বছর এবং কমবেশি একই সময়ে।

পরিযায়ী পাখির ঝাঁক বেঁধে পরিযান
পরিযায়ী সারস

কিছু প্রজাতির মাছ, স্তন্যপায়ী প্রাণী, এমনকি পোকামাকড়ও ফি-বছর পরিযান ঘটায়। তবে পাখির মতো এত ব্যাপক আর বিস্তৃতভাবে কেউই পরিযানে অংশ নেয় না। পৃথিবীর প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৮৫৫ প্রজাতিই (প্রায় ১৯%) পরিযায়ী।[]

পরিযানের কারণ

সম্পাদনা

পাখি পরিযানের অন্যতম দু’টি কারণ হচ্ছে খাদ্যের সহজলভ্যতা আর বংশবৃদ্ধি। উত্তর গোলার্ধের অধিকাংশ পরিযায়ী পাখি বসন্তকালে দক্ষিণে আসে অত্যধিক পোকামাকড় আর নতুন জন্ম নেয়া উদ্ভিদ ও উদ্ভিদাংশ খাওয়ার লোভে। এ সময় খাদ্যের প্রাচুর্যের কারণে এরা বাসা করে বংশবৃদ্ধি ঘটায়। শীতকালে বা অন্য যে কোনো সময়ে খাবারের অভাব দেখা দিলে এরা দক্ষিণে রওনা হয়।[][]

আবহাওয়াকে পাখি পরিযানের অন্য আরেকটি কারণ হিসেবে ধরা হয়। শীতের প্রকোপে অনেক পাখিই পরিযায়ী হয়। হামিংবার্ডও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে খাবারের প্রাচুর্য থাকলে প্রচণ্ড শীতেও এরা বাসস্থান ছেড়ে নড়ে না।[] আলোর তীব্রতাও এদের পরিযানের অন্যতম কারণ।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

পরিযানের প্রকার

সম্পাদনা

পাখিদের মধ্যে সাধারণত তিন ধরনের পরিযান লক্ষ করা যায়।[] পরিযানের প্রকারগুলো হলো-

 
কতিপয় দীর্ঘদৈর্ঘ্যের পরিযায়ী পাখির পরিযানপথ
  1. স্বল্পদৈর্ঘ্য পরিযান: এ ধরনের পরিযায়ী পাখিগুলো প্রধানত স্থায়ী। তবে খাদ্যাভাব দেখা দিলে এরা তাদের স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্রের আশেপাশে অন্য অঞ্চলে গমন করে। এদের পরিযান অনিয়মিত। চাতক, পাপিয়া, খয়েরিডানা পাপিয়া স্বল্পদৈর্ঘ্যের পরিযায়ী পাখি।
  2. মধ্যদৈর্ঘ্য পরিযান: এ প্রজাতির পাখিরা প্রায়শ পরিযান ঘটায়, তবে পরিযানের বিস্তার স্বল্পদৈর্ঘ্যের পরিযায়ী পাখিদের তুলনায় অনেক বেশি হয়।
  3. দীর্ঘদৈর্ঘ্য পরিযান: এ প্রজাতির পাখিদের পরিযান এক বিশাল এলাকা জুড়ে ঘটে। এ ধরনের পাখিদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে এক বা একাধিক সপ্তাহ লাগে। এসময় এরা হাজার হাজার মাইল দূরত্ব পাড়ি দেয়। নীলশির, লালশির, কালো হাঁস, লেন্জা হাঁস, ক্ষুদে গাংচিল দীর্ঘদৈর্ঘ্যের পরিযায়ী পাখি।[]

পরিযান প্রক্রিয়া

সম্পাদনা

দীর্ঘ যাত্রায় পাখিরা কীভাবে পথ চেনে, সে এক রহস্য। দেখা গেছে, পথ চেনাতে অভিজ্ঞ পাখিরাই ঝাঁকের সামনের দিকে থাকে। নতুনরা থাকে পেছনে। এ ক্ষেত্রে পাখিরা উপকূলরেখা, পাহাড়শ্রেণি, নদী, সূর্য, চাঁদ, তারা ইত্যাদির মাধ্যমেই পথ খুঁজে নেয় বলে ধারণা করা হয়। যেসব পাখি একা ভ্রমণ করে, তাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, জীবনে প্রথমবার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলেও তারা গন্তব্যে পৌঁছে যায়। এ জন্য বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রই পাখিদের পথ চেনায়।[]

 
কানঠুটি

পরিযায়ী পাখির বিভ্রান্তিমূলক নাম

সম্পাদনা
 
চাতক

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, টেলিভিশনে, বই-পুস্তকে অনেকে পরিযায়ী পাখিদেরকে অজ্ঞতাবশত অতিথি পাখি, গেস্ট বার্ড, ভিনদেশি পাখি বা বিদেশি পাখি হিসেবে অভিহিত করে। আবার বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখি বললেই ধরে নেওয়া হয় কেবল শীতকালে আসা হাঁস আর রাজহাঁসকে। এ হিসেবে কালেম, ডাহুক বা পাতি সরালিকেও শীতের পাখি হিসেবে অভিহিত করা হয়, যদিও এরা বাংলাদেশের নির্ভেজাল স্থানীয় বাসিন্দা প্রজাতির পাখি। পরিযায়ী পাখিমাত্রই যে হাঁসজাতীয় ও জলচর পাখি, এমনটা নয়। পরিযায়ী পাখির এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে খঞ্জনা (Wagtails), চটক (Flycatchers), মাঠ চড়ুই (Larks), কসাই পাখি (Shrikes), গাঙচিল, বিভিন্ন শিকারি পাখি ইত্যাদি।[] তাছাড়া পরিযায়ী পাখি বসন্তে বা শরৎকালেও আসতে-যেতে পারে।[]

রোগের বিস্তার

সম্পাদনা
 
কালো হাঁস

পরিযায়ী পাখিরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বিপজ্জনক রোগের জীবাণু বহন করার জন্য অনেকাংশে দায়ী। এ পাখিরা বহু বছর ধরে নির্দিষ্ট কিছু জীবাণু বহন করে বলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঐ জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে। ফলে এরা অনেকটা ঐ জীবাণুর বাহক হিসেবে কাজ করে এবং অন্যত্র জীবাণু ছড়িয়ে দেয়। প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন কোনো প্রজাতি পরিযায়ী প্রজাতির সংস্পর্শে আসলে সাথে সাথে আক্রান্ত হয়। পশ্চিম নীল ভাইরাস (West Nile Virus) এবং এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস (যার জন্য বার্ড ফ্লু রোগ হয়) এমনই দু’টি জীবাণু। সিট্টাকোসিস (Psittacosis) পরিযায়ী পাখিবাহিত একটি রোগ।[][]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. বাংলাদেশের পাখি, রেজা খান, বাংলা একাডেমি, ঢাকা (২০০৮), পৃ. ২৩।
  2. [১] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৩ আগস্ট ২০১৩ তারিখে, BirdLife International এ পাখি পরিযান বিষয়ক নিবন্ধ।
  3. [২], Migration, All about birds.
  4. Lincoln, F. C. (১৯৭৯)। Migration of Birds.। Fish and Wildlife Service. Circular 16'.। 
  5. [৩], Migratory Patterns, All about birds.
  6. [৪], পরিযায়ী পাখি, মনিরুল খান, দৈনিক কালের কণ্ঠ।
  7. ড. খান, আলী রেজা (২০১৯). আমাদের পরিযায়ী পাখি বা মাইগ্রেটরি বার্ড!. মহাবৃত্ত (সংখ্যা ৪: অক্টোবর-ডিসেম্বর), ঢাকা
  8. [৫], Migration and the spread of disease, All about birds.
  9. "সাক্ষাৎকার: প্রফেসর কাজী জাকের হোসেন"নেচার স্টাডি সোসাইটি অফ বাংলাদেশ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]

আরও দেখুন

সম্পাদনা