নিকিতা খ্রুশ্চেভ
নিকিতা সের্গেইভিচ খ্রুশ্চেভ (রুশ: Никита Сергеевич Хрущёв, [nʲɪˈkʲitə sʲɪrˈɡʲejɪvʲɪtɕ xrʊˈɕːɵf] (; জন্ম: ১৫ এপ্রিল ১৮৯৪ - মৃত্যু: ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১) তৎকালীন রুশ সাম্রাজ্যের কালিনোভকা এলাকায় জন্মগ্রহণকারী রুশ রাজনীতিবিদ ছিলেন। )শীতল যুদ্ধের সময় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছেন। যৌবনে খনিশ্রমিক এবং পরবর্তীতে রাশিয়ার গৃহযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে কাজ করেছেন। লাজার কাগানোভিচের সহায়তায় খ্রুশ্চেভ সোভিয়েত সরকারের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আরোহণ করেন। তিনি যোসেফ স্তালিনের সহচর হিসেবে হাজারো ব্যক্তিকে গ্রেফতারে সহায়তা করেন। স্তালিন তাকে ইউক্রেনে দলীয় প্রধান হিসেবে মনোনীত করেন এবং সেখানে দমননীতি চালিয়ে যান। ১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরিতে ইউরি আন্দ্রোপভের সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে হাঙ্গেরীয় যোদ্ধাদের আন্দোলন শুরু হলে সামরিক হস্তক্ষেপ গ্রহণ করেন ও আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেন।[১]
নিকিতা খ্রুশ্চেভ Никита Хрущёв | |
---|---|
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সচিব | |
কাজের মেয়াদ ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৩ – ১৪ অক্টোবর, ১৯৬৪ | |
রাষ্ট্রপতি | ক্লিমেন্ত ভরোশলভ লিওনিদ ব্রেজনেভ আনাস্তাস মিকয়ান |
প্রিমিয়ার | গেওর্গি মালেনকোভ নিকোলাই বুলগানিন নিজ |
পূর্বসূরী | যোসেফ স্তালিন |
উত্তরসূরী | লিওনিদ ব্রেজনেভ |
সোভিয়েট ইউনিয়নের মন্ত্রী পরিষদের প্রধান | |
কাজের মেয়াদ ২৭ মার্চ, ১৯৫৮ – ১৪ অক্টোবর, ১৯৬৪ | |
ফার্স্ট ডেপুটি | ফ্রল কোজলভ অ্যালেক্সি কোসিগিন দিমিত্রি আস্তিনোভ লাজার কাগানোভিচ আনাস্তাস মিকোয়ান |
পূর্বসূরী | নিকোলাই বুলগানিন |
উত্তরসূরী | আলেক্সি কোসেগিন |
রুশ এসএফএসআরের সেন্ট্রাল কমিটি ব্যুরোর চেয়ারম্যান | |
কাজের মেয়াদ ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৬ – ১৬ নভেম্বর, ১৯৬৪ | |
ডেপুটি | আন্দ্রে কিরিলেঙ্কো |
পূর্বসূরী | পদ সৃষ্ট |
উত্তরসূরী | লিওনিদ ব্রেজনেভ |
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | কালিনোভকা, দিমিত্রিয়েভস্কি, কুর্স্ক গভার্নরেট, রুশ সাম্রাজ্য | ১৫ এপ্রিল ১৮৯৪
মৃত্যু | সেপ্টেম্বর ১১, ১৯৭১ মস্কো, রুশ সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন | (বয়স ৭৭)
জাতীয়তা | সোভিয়েত |
রাজনৈতিক দল | সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি |
দাম্পত্য সঙ্গী | ইয়েফ্রোসিনিয়া খ্রুশ্চেভা (১৯১৬–১৯১৯, মৃত্যু) মারুসিয়া খ্রুশ্চেভা (১৯২২, বিবাহ-বিচ্ছেদ) নিনা খ্রুশ্চেভা (১৯২৩–১৯৭১, বিধবা) |
ধর্ম | নেই (নাস্তিকবাদী) |
স্বাক্ষর |
খ্রুশ্চেভ ১৯৫৩ সালে গেওর্গি মালেনকোভকে ক্ষমতাচ্যুত করে তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সচিব হিসেবে ১৯৫৩-১৯৬৪ সাল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৫৮-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। খ্রুশ্চেভ স্তালিনবাদ বিরোধীতার জন্য আংশিক দায়ী ছিলেন। এছাড়াও, তিনি সোভিয়েত মহাকাশযান পরিকল্পনার শুরুর দিকে এর অগ্রগতিতে বাঁধা দিয়েছেন। অনেক অভ্যন্তরীণ নীতি-নির্ধারণ এবং স্বাধীন পুণর্গঠনেও অংশ নেন তিনি। ফলে, দলীয় সহকর্মীরা ১৯৬৪ সালে তাকে অপসারণ করে প্রথম সচিব হিসেবে- লিওনিদ ব্রেজনেভ ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আলেক্সি কোসেগিনকে স্থলাভিষিক্ত করে।
জীবন ও জীবিকা নির্বাহ
সম্পাদনা১৮৯৪ সালের ১৫ এপ্রিল রাশিয়ার কুমুটুভস্কি জেলার কালিনোভকা গ্রামে জন্ম নেন। গ্রামটি বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেনের সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত।[২][৩][৪] তার বাবা সার্গেই খ্রুশ্চেভ এবং মা জেনিয়া খ্রুশ্চেভ ছিলেন রাশিয়ার দারিদ্রপীড়িত ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারের লোক। তাদের সংসারে নিকিতা খ্রুশ্চেভের চেয়ে ২ বছরের ছোট ‘ইরিনা’ নামে একটি কন্যা সন্তানও ছিল।[২][৪]
খ্রুশ্চেভ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ-কর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। পূর্বাঞ্চলীয় ইউক্রেনে রেলওয়েম্যান, খনি শ্রমিক এবং ইটের ভাটায় শ্রমিকের কাজে অংশ নিয়েছেন তিনি। ডনবাসের তুলনায় কুরস্ক এলাকায় মজুরী বেশি থাকায় কালিনোভকায় পরিবারকে রেখে চলে যান। যখন তার হাতে যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ সঞ্চয় হতো তখন তিনি তার পরিবারের সাথে যোগ দিতেন।[৫]
খ্রুশ্চেভের শিক্ষক মিসেস লিদিয়া শেভচেঙ্কো পরবর্তীতে বলেছিলেন যে, তিনি অত্যন্ত দারিদ্র্যপীড়িত গ্রাম হিসেবে কালিনোভকাকে এর আগে দেখেননি।[৬] নিকিতা অল্প বয়সেই রাখাল বালক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বিদ্যালয়মুখী হয়েছেন সর্বমোট চার বছর। তন্মধ্যে গ্রামের চার্চের পাঠশালা এবং শেভচেঙ্কো’র নিয়ন্ত্রণাধীন কালিনোভকা’র স্টেট স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। খ্রুশ্চেভ শৈশবের স্মৃতিচারণ করে বলেছেন যে লিদিয়া শেভচেঙ্কো ছিলেন একজন মুক্তচিন্তার অধিকারী যিনি গ্রামবাসীদেরকে চার্চে অনুপস্থিত দেখে কষ্ট পেতেন এবং যখনই তার ভাই পরিদর্শনে আসতেন তখন তিনি সাম্রাজ্যবাদী সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ বই-পুস্তক বিতরণ করতেন। তিনি নিকিতাকে পড়াশোনা চালিয়ে যাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু, পারিবারিকভাবে আর্থিক নিরাপত্তা না থাকায় পড়াশোনার অনুমতি পাননি নিকিতা খ্রুশ্চেভ।[৭]
১৯০৮ সালে সার্গেই খ্রুশ্চেভ জুজুভকা’র শহর ডনবাসে স্থানান্তরিত হন। চৌদ্দ বছর বয়সী নিকিতা ঐখানেই অবস্থান করেন। অবশ্য জেনিয়া খ্রুশ্চেভা এবং তার কন্যা ফিরে যান।[৮] জুজুভকা ১৯২৪ সালে স্তালিনো এবং ১৯৬১ সালে ডোনটস্ক নামে পরিবর্তিত হয়। শহরটি তৎকালীন রুশ সাম্রাজ্যের শিল্পাঞ্চল এলাকায় অবস্থিত।[৮] বিভিন্ন জায়গায় অল্প কিছুদিন কাজ করার পর নিকিতাকে তার পিতা-মাতা শিক্ষানবীশ ধাতব মিস্ত্রী হিসেবে খুঁজে পান। শিক্ষানবীশকাল শেষ হবার পর কিশোর খ্রুশ্চেভ একটি প্রতিষ্ঠানে আহুত হন।[৯]
লেনা স্বর্ণখনিতে গণহত্যায় নিহতদের পরিবারের জন্য অর্থ সংগ্রহের অভিযোগে নিকিতা চাকরি হারান। পুণরায় তিনি রুটচঙ্কোভো'র কাছাকাছি আরেকটি খনিতে চাকরি পান।[১০] সেখানে তিনি প্রাভদা পত্রিকা সংগ্রহ করে জনগণকে সংগঠিত করে পড়ার জন্য সাহায্য করতেন।[১১] পরে তিনি বলেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অধিক মজুরীর দিকে তিনি আকৃষ্ট ও ধাবিত হয়েছিলেন কিন্তু অভিবাসিত হতে পারেননি।[১২] ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার সময় খ্রুশ্চেভ তখন পুরোপুরি দক্ষ ধাতব পদার্থের শ্রমিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। দশটি খনির দায়িত্বে নিয়োজিত ওয়ার্কশপে কর্মরত অবস্থায় উচ্চতর বেতন, কাজের ভালো শর্তাবলী এবং যুদ্ধ বন্ধের প্রশ্নে বেশ কয়েকটি ধর্মঘটের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন খ্রুশ্চেভ।[১৩]
১৯১৪ সালে রুটচেঙ্কোভো খনি উত্তোলনকারী অপারেটরের কন্যা ইয়েফ্রোসিনিয়া পিজারেভাকে বিয়ে করেন তিনি। ১৯১৫ সালে তাদের ঘরে ‘জুলিয়া’ নাম্নী এক কন্যা এবং ১৯১৭ সালে ‘লিওনিদ’ নামে এক পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়।[১৪]
দলীয় কার্যাবলী
সম্পাদনাডনবাসের বছরগুলোয়
সম্পাদনাএক বন্ধুর অনুপ্রেরণায় খ্রুশ্চেভ পূর্বেকার কর্মক্ষেত্র ডনবাস অঞ্চলের রুটচেঙ্কোভো খনিতে ১৯২১ সালে রাজনৈতিক সংক্রান্ত সহকারী পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন।[১৫] সেখানে তখনো কিছু বলশেভিকদের আবাসস্থল ছিল। ঐ সময় লেনিনের নতুন অর্থনৈতিক তত্ত্ব বা নীতি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। তা হলো - কিছু মানদণ্ডের ভিত্তিতে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান কিংবা মালিকানাধীন সংস্থাগুলো পরিচালিত হবে যা বলশেভিকদের চিন্তাধারার সাথে মিলে যায়।[১৫] কিন্তু নিকিতা খ্রুশ্চেভ রাজনৈতিক সংক্রান্ত দায়িত্ববোধ থেকে বিচ্যুত হয়ে যুদ্ধের বছরগুলোতে থেমে থাকা খনিগুলোতে পূর্ণোদ্যমে উৎপাদন চালু করতে উঠে-পড়ে লেগে যান। তিনি যুদ্ধের কারণে বন্ধ খনির মেশিনগুলো চালু করতে সহায়তা করেন এবং পুরনো খনিগুলো পরিদর্শনে ভ্রমণ করেন। খ্রুশ্চেভ রুটচেঙ্কোভো খনি পরিচালনায় পুরোপুরি সফলকাম ছিলেন। ফলে ১৯২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে কাছাকাছি পাস্তুখভ খনি পরিচালনার জন্য প্রস্তাবনা পান। কিন্তু এ প্রস্তাব নাকচ করে দেন তিনি। তিনি জুজুভকায় নতুন প্রতিষ্ঠিত দন্তেস্ক ন্যাশনাল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে সম্পৃক্ত হবার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে সেখানে যেতে নিষেধ করেন। যেহেতু তিনি মাত্র চার বছর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেছেন তাই তিনি রাবফাকের টেকনিকাম প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন যা ছিল অল্পশিক্ষিত ছাত্রদেরকে উচ্চ বিদ্যালয়ের স্তরে নিয়ে যেতে সাহায্য করা।[১৬] রাবফাক অর্জনের পর খ্রুশ্চেভ রুটচেঙ্কোভো খনিতে তার কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন।[১৭] তার একজন শিক্ষক পরে খ্রুশ্চেভ সম্পর্কে মূল্যায়ন করেন যে, তিনি একজন দূর্বল প্রকৃতির ছাত্র ছিলেন।[১৬] বরঞ্চ তিনি অগ্রগামী ব্যক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টিতেই অধিকতর সফলকাম ছিলেন। ১৯২২ সালে রাবফাকে ভর্তির পরপরই নিকিতা সমগ্র টেকনিকাম প্রোগামে কমিউনিস্ট পার্টির সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন এবং জুজুভকায় পার্টির সদস্য হিসেবে গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য হন। তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য লিওন ট্রটস্কি’র সমর্থক ছিলেন যা ছিল যোসেফ স্তালিনের প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া পার্টির গণতন্ত্রের বিপক্ষে। এ সমস্ত কার্যকলাপের ফলে তিনি খুব কম সময়ই পড়াশোনায় সময় ব্যয় করেছেন কিংবা মনোযোগী হতে পেরেছেন এবং পরে নিকিতা খ্রুশ্চেভ দাবী করেছেন যে তিনি রাবফাক পড়াশোনার পর্বটি সমাপণ করেছেন। ফলে, এটি অস্পষ্ট রয়ে যায় যে কোনটি সত্য ছিল![১৮]
১৯২২ সালে মারুসিয়া নাম্নী জনৈক মহিলার প্রেমে পড়েন খ্রুশ্চেভ এবং দ্বিতীয় পত্নী হিসেবে তাকে গ্রহণ করেন। কিন্তু তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক খুব দ্রুত ভেঙ্গে যায়। পরবর্তীতে তিনি মারুসিয়াকে সাহায্য করেন যখন তাদের কন্যা সন্তান গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিবাহ-বিচ্ছেদের পর খ্রুশ্চেভ আবারো নিনা পেট্রোভনা কুখারচুক নাম্নী এক উচ্চ শিক্ষিত পার্টি সংগঠকের কন্যার প্রেমে পড়েন। তারা উভয়েই স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ঘর-সংসার করতে থাকেন এবং তারা ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বিয়ের পিঁড়িতে বসেননি। তাদের সংসারে দু’টো সন্তান - পুত্র হিসেবে ১৯৩৫ সালে সার্গেই খ্রুশ্চেভ এবং কন্যা হিসেবে ১৯৩৭ সালে এলিনা জন্মগ্রহণ করে।[১৯]
১৯২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে স্তালিনো’র নিকটে পেট্রোভো-ম্যারিনস্কি নিয়ে গঠিত রাইকোম বা জেলায় পার্টির সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। রাইকোম হচ্ছে ৪০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট এলাকা। খ্রুশ্চেভ ধারাবাহিকভাবে নিজ সাম্রাজ্যকে তুলে ধরেন এবং যে-কোন ক্ষুদ্র বিষয়েও তিনি গভীর আগ্রহ দেখাতেন।[২০] ১৯২৫ সালের শেষদিকে মস্কোতে অনুষ্ঠিত চতুর্দশ সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিতে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন।[২১]
কাগানোভিচের সাহচর্য্যে
সম্পাদনা১৯১৭ সালের শুরুর দিকে খ্রুশ্চেভ লাজার কাগানোভিচের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ১৯২৫ সালে কাগানোভিচ ইউক্রেনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হয়েছিলেন।[২২] খ্রুশ্চেভ দ্রুততার সাথে তার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে উৎসাহিত হয়েছিলেন। ১৯২৬ সালের শেষদিকে স্তালিনো পার্টির নির্দেশনায় ২য় পদধারী ব্যক্তি ছিলেন তিনি। টাউবম্যানের মতে, খ্রুশ্চেভের প্ররোচনায় নয়মাসের মধ্যে প্রধানের পদ থেকে কনস্টান্টিন মোইসেঙ্কোকে বিতাড়িত করেন। [২২] কাগানোভিচ ইউক্রেনের সাবেক রাজধানী খারকোভে নিকিতা খ্রুশ্চেভকে ইউক্রেনে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রধানের দায়িত্ব অর্পণ করে স্থানান্তর করেন।[২৩] ১৯২৮ সালে খ্রুশ্চেভ কিয়েভে স্থানান্তরিত হন। সেখানে তিনি পার্টির সংগঠনে ২য় পদমর্যাদার অধিকারী হন।[২৪] ১৯২৯ সালে নিকিতা আবারো তার শিক্ষালাভের বিষয় নিয়ে দৃষ্টিতে পড়েন। খ্রুশ্চেভ পড়াশোনা সম্পন্ন না করলেও পার্টিতে তার ভূমিকা সমুজ্জ্বল ছিল।[২৫] যখন বিদ্যালয়ের পার্টির সদস্যগণ জেলা পার্টির সম্মেলনে একদল ডানপন্থী পাঠায় তখন প্রাভদা বিস্ময় প্রকাশ করেছিল।[২৬] খ্রুশ্চেভ খুব দ্রুত পার্টির উঁচুসারির নেতা হতে লাগলেন। প্রথমে বাউম্যান জেলায় এবং পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় জেলা হিসেবে ক্রাজনোপ্রেজেনেনস্কি জেলায় পার্টি প্রধান হন।
১৯৩২ সালের মধ্যে মস্কোর পার্টি সংগঠনে খ্রুশ্চেভ দ্বিতীয় পদমর্যাদার অধিকারী হন যা ছিল কাগানোভিচের পরপরই। ১৯৩৪ সালে তিনি নগরের পার্টি প্রধান হন এবং পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন।[২৫][২৭] জীবনীকার উইলিয়াম টম্পসনের মতে খ্রুশ্চেভ পার্টির মধ্যে সবচেয়ে নিচেরসারিতে থেকেও যতোটা না স্তালিনের সাহচর্য্য পেয়েছেন, তারচেয়ে বেশি পেয়েছেন কাগানোভিচের তরফে।[২৮] মস্কো নগরে সংগঠনের প্রধান হিসেবে খ্রুশ্চেভের নেতৃত্বে মস্কো মেট্রো’র নির্মাণ কার্য চলে যদিও এর সামগ্রিক দায়িত্বে ছিলেন কাগানোভিচ। পূর্বঘোষিত সময়সীমা হিসেবে ৭ নভেম্বর, ১৯৩৪ তারিখে মস্কো মেট্রো চালুর ঘোষণা দেয়ায় পরিখা নির্মাণে যাবতীয় ঝুঁকি গ্রহণসহ প্রচুর সময় ব্যয় করেন নিকিতা। আকস্মিকভাবে দুর্ঘটনা ঘটায় মেট্রোটি ১ মে, ১৯৩৫ তারিখ পর্যন্ত চালু না হওয়া সত্ত্বেও নিকিতা খ্রুশ্চেভ নির্মাণকার্যে তার অসাধারণ ভূমিকার জন্য অর্ডার অব লেনিন পুরস্কার গ্রহণ করেন।[২৯] পরবর্তী বছরে তিনি পার্টি প্রধান হিসেবে মস্কো ওব্লাস্ট প্রদেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।[২৫]
গ্রেফতার ও গণহত্যায় সম্পৃক্ততা
সম্পাদনাস্তালিনের দপ্তরে প্রাপ্ত দলিল-দস্তাবেজে ঘেঁটে দেখা যায় যে, খ্রুশ্চেভ ১৯৩২ সালের শুরুর দিকে সভায় উপস্থিত ছিলেন। স্তালিন এবং খ্রুশ্চেভের মধ্যে খুব দ্রুত সুন্দর সম্পর্ক বৃদ্ধি পেতে থাকে। খ্রুশ্চেভ একনায়কতন্ত্রকে বেশ পছন্দ করতেন এবং খুব দামী পোশাক পড়ে অনানুষ্ঠানিক সভায় প্রবেশ করতেন। স্তালিনের ‘ডাচা’য় নিমন্ত্রিত হতেন তিনি নিয়মিতভাবে। স্তালিন তার অধীনস্থ খ্রুশ্চেভের কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্ত্থনা ও সংবর্ধনা পেতেন।[৩০] ১৯৩৪ সালের শুরুতে স্তালিন সাজানো বিচারের মাধ্যমে নির্দয়ভাবে হত্যাযজ্ঞ আরম্ভ করলেন। ১৯৩৬ সালে বিচারকার্য্যে খ্রুশ্চেভ তার সমর্থন ব্যক্ত করেন।[৩১] মস্কো ওব্লাস্টে খ্রুশ্চেভ তার অনেক বন্ধু ও সহকর্মীর হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন।[৩২] কর্মজীবনের শুরুতে তার সাথে যারা কর্মরত ছিলেন তাদেরকে গ্রেফতারে সহায়তা করেন।[৩৩] পার্টির নিয়ম অনুযায়ী খ্রুশ্চেভ গ্রেফতারের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন নিতেন এবং তার বন্ধু কিংবা সহকর্মীদের রক্ষা করার জন্য অল্প কিছু করতেন কিংবা কিছুই করতেন না।[৩৪] দলীয় নেতৃবৃন্দ শত্রু নির্ধারণের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যা বরাদ্দ দিতেন এবং গ্রেফতার করাতেন।[৩৪] জুন, ১৯৩৭ সালে পলিটব্যুরো ৩৫,০০০ শত্রুকে মস্কো থেকে গ্রেফতার করে। তন্মধ্যে ৫ হাজার ব্যক্তিকে প্রাণদণ্ড দেয়। দু’সপ্তাহ পর নিকিতা খ্রুশ্চেভ পলিটব্যুরো’র আদেশ পেলে তিনি যোসেফ স্তালিন বরাবরে ৪১,৩০৫ জন আসামী এবং ধনাঢ্য কৃষক বা ‘কুলক’দেরকে গ্রেফতারের সংবাদ পাঠান। এতগুলো বন্দীর মধ্যে প্রায় ৮,৫০০ জনকে হত্যা করা হয়।[৩৪] স্তালিন খ্রুশ্চেভকে ব্যক্তিগতভাবে অভিযোগকরণসহ তার দৃষ্টিসীমায় থাকতে এবং তার সম্মতির জন্য অপেক্ষা করতে বলেছিলেন।[৩৫] খ্রুশ্চেভ ১৯৩৮ সালে পলিটব্যুরো’র সদস্য হবার জন্য প্রার্থী হয়েছিলেন এবং মে, ১৯৩৯ সালে পূর্ণাঙ্গ সদস্য হিসেবে তাতে মনোনীতও হন।[৩৬] ১৯৩৭ সালের শেষদিকে স্তালিন খ্রুশ্চেভকে কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হিসেবে ইউক্রেনে নিযুক্ত করেন। অতঃপর তিনি ১৯৩৮ সালের জানুয়ারি মাসে মস্কো থেকে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে চলে যান।[৩৭] খ্রুশ্চেভের প্রত্যাবর্তনের পরপরই গ্রেফতার কার্যক্রম পুরোদমে চলতে থাকে।[৩৮] ইউক্রেনের পলিটব্যুরো সংগঠনের ব্যুরোর সকল সদস্যের মধ্যে এবং সচিব হিসেবে মাত্র একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সকল সরকারি কর্মকর্তা এবং রেড আর্মির কমান্ডারদেরকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়।[৩৯] খ্রুশ্চেভের প্রত্যাবর্তনের কয়েক মাস পর গ্রেফতারকৃত সকল ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।[৪০]
১৯৩৯ সালে চতুর্দশ ইউক্রেনের পার্টি কংগ্রেসের ভাষণে নিকিতা খ্রুশ্চেভ বলেন,
কমরেডগণ, আমরা অবশ্যই জনগণের সকল শত্রুর মুখোশ খুলে দেব এবং নিষ্ঠুর চিত্তে তাদেরকে ধ্বংস করব। কিন্তু আমরা অবশ্যই একজন সৎ বলশেভিকেরও ক্ষতি হতে দেব না। আমরা অবশ্যই অপবাদকারীদের বিরুদ্ধে আমরণ সংগ্রাম পরিচালনা করে যাব।[৩৯]
মহান দেশপ্রেমের যুদ্ধে
সম্পাদনাপোল্যান্ডের অঙ্গরাজ্য দখল
সম্পাদনাসোভিয়েত সেনাবাহিনী পোল্যান্ডের পূর্বাঞ্চল ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ তারিখে দখল করে। তখন নিকিতা খ্রুশ্চেভ স্তালিনের নির্দেশনায় ঐ সেনাদলের নেতৃত্ব দেন। দখলকৃত এলাকাগুলো প্রাচীন ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে জানা যায় এবং বর্তমানে তা ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। অনেক অধিবাসীই পোল্যান্ড-সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেকার চুক্তির ফলে সোভিয়েত সেনাদলকে অনিচ্ছাকৃতভাবে স্বাগতঃ জানাতে বাধ্য হয়। তারা ভেবেছিল যে ভবিষ্যতে তারা হয়তো স্বাধীন হবে। ক্রুশ্চেভের ধারণা ছিল - দখলকৃত এলাকাগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের ভোটের জন্য কাজে লাগবে। যখন নতুন অধিবেশন শুরু হয় তখন সোভিয়েতদের আবেদন সুপ্রিম কোর্টে মঞ্জুর হয়। ইউক্রেনের সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট প্রজাতন্ত্র ১ নভেম্বর, ১৯৩৯ তারিখে পশ্চিম ইউক্রেনকে তাদের প্রজাতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করে।[৪১]
জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ
সম্পাদনাজুন, ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে জার্মানদের অধিগ্রহণ হিসেবে অপারেশন বার্বারোসা পরিচালিত হয়। তখনও খ্রুশ্চেভ কিয়েভে তার পদে নিয়োজিত ছিলেন।[৪২] স্তালিন রাজনৈতিক সহযোদ্ধা হিসেবে নিকিতাকে নিযুক্ত করেন। মস্কোতে তিনি একদল ফ্রন্টের অভ্যন্তরীণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন যার প্রধান কাজই ছিল স্থানীয় সামরিক কমান্ডারদের সাথে রাজনৈতিক নেতাদের একত্রিত করা। স্তালিন খ্রুশ্চেভকে নিয়োগ দেন সামরিক কমান্ডারদেরকে কড়াকড়ির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। এর ফলে কমান্ডাররা তার মাঝে স্তালিনের প্রভাব দেখতে পান।[৪৩] জার্মানদের অভিযানের ফলে খ্রুশ্চেভ সৈন্যদলের সাথে একযোগে কাজ করেন। প্রথমে প্রতিরক্ষা কার্যক্রম এবং পরে শহরকে রক্ষা করার প্রাণান্তঃকর চেষ্টা করেন। স্তালিনের নির্দেশক্রমে শহরকে যে-কোনভাবে রক্ষা করার জন্য রেড আর্মি মোতায়েন করা হয়। কিন্তু ১৯৪১ সালের কিয়েভের যুদ্ধে জার্মান সেনাদল কর্তৃক শহরটি অবরুদ্ধ হয়। জার্মানরা জানায় তারা ৬ লক্ষ ৫৫ হাজার লোককে বন্দী করে। সোভিয়েতদের মতে ৬,৭৭,০৮৫ জনের মধ্যে ১,৫০,৫৪১ জন ব্যক্তি পলায়নের মাধ্যমে আত্মরক্ষা করতে পেরেছিল।[৪৪] প্রাথমিক তথ্যাবলীতে খ্রুশ্চেভের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। মার্শাল গিওর্গী জুকভের মতে, ১৯৫৭ সালে খ্রুশ্চেভ এ বিষয়ে স্তালিনকে কিয়েভে সেনাদল প্রত্যাহার করতে উদ্বুদ্ধ করেননি।[৪৫] এছাড়াও, খ্রুশ্চেভ স্মৃতিচারণ করে বলেন - তিনি এবং মার্শাল সিমন বুদুন্নী প্রস্তাব দিয়েছিলেন মস্কো থেকে মার্শাল সিমন টিমোশেঙ্কো আদেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত সোভিয়েত বাহিনীকে তাদের অবস্থান ধরে রাখার জন্য।[৪৬] অন্যদিকে খ্রুশ্চেভের শুরুরদিকের জীবনীকার মার্ক ফ্রাঙ্কল্যান্ড বলেছেন, রেড আর্মির দায়িত্ব প্রদান করায় নেতার প্রতি খ্রুশ্চেভের বিশ্বাসে ভাঙ্গনের পরিবেশ সৃষ্টি করে বিচলিত করেছিল।[৪৭]
১৯৪২ সালে খ্রুশ্চেভ দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন দেখাশোনা করেন। তিনি এবং টিমোশেঙ্কো প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন যে খারকোভ এলাকায় বড় ধরনের পাল্টা আক্রমণ করার জন্য। যোসেফ স্তালিন এ পরিকল্পনার একটি অংশ অনুমোদন করেন। এতে ছয় লক্ষ চল্লিশ হাজারেরও অধিক রেড আর্মির সদস্য আক্রমণে জড়িত ছিলেন। জার্মানরা খারকোভ আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য ফাঁদ পাতে। ১২ মার্চ, ১৯৪২ সালে সোভিয়েত আক্রমণ ফলপ্রসূ হিসেবে দেখা দেয়। কিন্তু পাঁচ দিনের মধ্যেই জার্মান বাহিনীর আক্রমণে সোভিয়েতবাসী এবং রেড আর্মির সদস্যগণ সমূহ বিপদের মধ্যে পড়ে। স্তালিন পাল্টা আক্রমণের চিন্তাধারাকে প্রত্যাখ্যান করলে রেড আর্মিকে জার্মানরা ঘিরে রাখে। সোভিয়েত ইউনিয়নের দুই লক্ষ সাতষট্টি হাজার সৈন্য আটক হয়। তন্মধ্যে দু’লক্ষেরও অধিক অধিবাসী ছিল। স্তালিন টিমোশেঙ্কোকে পদাবনমন করেন এবং পুনরায় খ্রুশ্চেভকে মস্কোতে ডেকে পাঠান।[৪৮]
খ্রুশ্চেভ ১৯৪২ সালের আগস্টে নগরের জন্য যুদ্ধ নামে পরিচিত স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে স্তালিনগ্রাদ ফ্রন্টে যোগ দেন।[৪৯] উক্ত নগরের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত জেনারেল ভ্যাসিলি চুইকোভের মতে, "স্তালিনগ্রাদের প্রতিরক্ষায় তার তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল না। কিন্তু তার সংক্ষিপ্ত ভূমিকাই তাকে পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীত্বে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে"। মৃত্যু পরবর্তীতে যুদ্ধে তার ভূমিকার জন্য তিনি গর্ববোধ করেছেন।[৫০] মস্কোয় স্তালিনের সাথে সাক্ষাৎ শেষে তিনি স্তালিনগ্রাদে থেকে গেলেন এবং কমপক্ষে একজনকে হত্যা করেছেন। তিনি জার্মানদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণের প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন। ঝুকোভ এবং অন্যান্য জেনারেলদের পরিকল্পনা নিয়ে গড়া হয়েছিল অপারেশন ইউরেনাস। এ পরিকল্পনায় সোভিয়েত সেনাদের অবস্থান, ব্যুহ তৈরী এবং জার্মানদের ধ্বংস করা ছিল অন্যতম। পরিকল্পনার বিষয়বস্তু অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে রক্ষা করা হয়। অপারেশন ইউরেনাস পরিচালনার পূর্বে খ্রুশ্চেভ সোভিয়েত সৈন্যদের প্রস্তুতিপর্ব, নীতি-নৈতিকতা, নাজি বন্দীদেরকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করা এবং কিছু গুজব তৈরী করাসহ বিভিন্ন বিষয়াদিতে অনেক সময় ব্যয় করেন।[৪৯]
সন্তানের বিমান দূর্ঘটনায় মৃত্যু
সম্পাদনাস্তালিনগ্রাদে ফিরে আসার কিছুদিন পরই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যায় জড়িয়ে পড়েন নিকিতা খ্রুশ্চেভ। তার ছেলে লিওনিদ যুদ্ধ বিমানের পাইলট ছিলেন। ১১ মার্চ, ১৯৪৩ তারিখে যুদ্ধ বিমানটিতে গুলিবর্ষণের ফলে নিহত হয় লিওনিদ। পরবর্তীতে অবশ্য লিওনিদের মৃত্যুরহস্য নিয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে। একটি মতে জানা যায়, বিমান দূর্ঘটনায় লিওনিদ পতিত হলে প্রথমে আটক ও পরে জার্মানদেরকে সহায়তা করেন। যখন লিওনিদ পুনরায় সোভিয়েত সেনাদের হাতে ধরা পড়েন তখন নিকিতা খ্রুশ্চেভ যোসেফ স্তালিনের কাছ থেকে জীবন ভিক্ষা চেয়েও তাকে বাঁচাতে পারেননি। স্তালিনের আদেশে লিওনিদ খ্রুশ্চেভকে হত্যা করা হয়।[৫১] সোভিয়েত দলিল-দস্তাবেজে যদিও সহায়ক কোন প্রামাণ্য দলিল নেই, তবুও কয়েকজন ইতিহাসবিদদের অভিমত যে লিওনিদ খ্রুশ্চেভের তথ্যাদি যুদ্ধের পর হস্তান্তরিত হয়েছে।[৫২]
পরবর্তী বছরে লিওনিদ খ্রুশ্চেভের উইংমেট বলেছেন যে তিনি ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমানের অংশবিশেষ দেখেছিলেন কিন্তু এ বিষয়ে কোন প্রতিবেদন দাখিল করেননি। নিকিতা খ্রুশ্চেভের জীবনীকার টাওবমেনের ধারণা, সম্ভাব্য কারণ হতে পারে যে একজন পলিটব্যুরো সদস্যের পুত্রের মৃত্যুকে বিতর্কিত না করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। [৫৩] ১৯৪৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে লিওনিদের স্ত্রী লিউবা খ্রুশ্চেভাকে গোয়েন্দাগিরির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। লিউবাকে পাঁচ বছরের জন্য শ্রম শিবিরে প্রেরণ করা হয়। অন্য সম্বন্ধীয় পুত্র হিসেবে তোলিয়াকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেয়া হয়। লিওনিদের কন্যা জুলিয়া নিকিতা খ্রুশ্চেভ ও তার স্ত্রীর হেফাজতে বড় হয়।[৫৪]
ক্ষমতায় আরোহণ
সম্পাদনাইউক্রেনে ফিরে আসা
সম্পাদনাদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে সমস্ত ইউক্রেন জার্মান সৈন্যদের হাতে কুক্ষিগত হয়। ১৯৪৩ সালের শেষদিকে খ্রুশ্চেভ নিজ এলাকা ইউক্রেনে ফিরে আসেন। সকল কল-কারখানা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং কৃষিখাতে মারাত্মক সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। ইউক্রেনের দশ লক্ষাধিক লোক শ্রমিক কিংবা যুদ্ধ বন্দী হিসেবে জার্মানিতে আটক ছিল। যারা অবশিষ্ট ছিলেন তারা অপর্যাপ্ত ঘর-বাড়ীর অভাবে কষ্টকরভাবে দিন অতিবাহিত করেন।[৫৫] প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজন যুদ্ধে প্রাণ হারায়।[৫৬] খ্রুশ্চেভ ইউক্রেনের পুণর্গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নেন। কিন্তু সোভিয়েত পদ্ধতির কারণে তার কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়।[৫৭] যখন রাশিয়া কর্তৃক পুনরায় ইউক্রেন করায়ত্ত্ব হয় তখন ১৯ থেকে ৫০ বছর বয়সী প্রায় সাত লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ব্যক্তিকে বাধ্যতামূলকভাবে রেড আর্মিতে অংশগ্রহণ করানো হয়।[৫৮]
স্তালিনের শেষ বছরগুলোয়
সম্পাদনামানসিক অবসাদগ্রস্ত স্তালিনের কাছ থেকে পুনরায় মস্কোতে ফিরে আসার সংবাদ পান খ্রুশ্চেভ।[৫৯] খ্রুশ্চেভ আবারো দলের প্রধান হিসেবে মস্কো নগর এবং প্রদেশগুলোর দায়িত্ব নেন। নিকিতা খ্রুশ্চেভের জীবনীকার টাউবেন মনে করেন, তার ফিরে আসার কারণ হতে পারে গেওর্গি মালেনকোভ এবং নিরাপত্তা প্রধান ল্যাভরেন্টি বেরিয়া’য় মধ্যেকার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। তারা উভয়েই স্তালিনের সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী হিসেবে সর্বত্র নাম উচ্চারিত হতো বেশি।[৬০]
খ্রুশ্চেভতার কৃষি-নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনার দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু তার দীর্ঘ বিবরণী মার্চ, ১৯৫১ সালে প্রাভদা’য় প্রকাশিত হলেও স্তালিন তা অনুমোদন দেননি। সাময়িকীটি খুব দ্রুত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে খ্রুশ্চেভের বক্তব্যটি ছিল একটি প্রস্তাবনা, নীতি নয়। এপ্রিলে পলিটব্যুরো তার এ প্রস্তাবনাকে নাকচ করে দেয়।
ঘুম থেকে জেগে উঠার পর ১ মার্চ, ১৯৫৩ তারিখে স্তালিন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। বারো ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও তার অবস্থা অপরিবর্তিত থেকে যায়। খ্রুশ্চেভ এবং তার সহকর্মীরা নতুন সরকার গঠনে মিলিত হন। ৫ মার্চে স্তালিন মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে খ্রুশ্চেভ এবং অন্যান্য উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা স্তালিনের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকেন। বেরিয়া কক্ষ থেকে দৌঁড়ে বেরিয়ে এসে তার গাড়ীর খোঁজসহ চিৎকার করতে থাকেন।[৬১]
খ্রুশ্চেভ স্তালিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন,
স্তালিন বলতেন, যারা তার মতবাদকে বিশ্বাস করতো না তারা জনগণের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হবেন। জনগণ চাইতেন পুরনো নিয়ম পুণর্বহাল রাখা হোক। তাই ঐ জনগণের শত্রুরা আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করতে চাইতেন। ফলে, হাজার হাজার সৎ লোক শাস্তিভোগ করেছেন। প্রত্যেকেই ঐদিনগুলোতে ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতেন।[৬২]
ক্ষমতার সংঘাত
সম্পাদনা৬ মার্চ, ১৯৫৩ তারিখে জোসেফ স্তালিনের মৃত্যুসংবাদ প্রচার করা হয়। মন্ত্রিপরিষদের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে মালেনকোভের নাম ঘোষিত হয়।[৬৩] খ্রুশ্চেভ, মালেনকোভ প্রমূখদের প্রচারণা বেরিয়া’র বিরুদ্ধে ছিল। তারা ভাবতেন, বেরিয়া সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখল করার জন্য পরিকল্পনা করছেন।[৬৪] খ্রুশ্চেভ স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন যে, বেরিয়া ছুরি হাতে তাদেরকে হত্যা করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন বলে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।[৬৫] ২৬ জুন, ১৯৫৩ তারিখে বেরিয়া প্রেসিডিয়ামের সভায় গ্রেফতার হন। বেরিয়া’র বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল এবং সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীলতা আনয়ণের অভিযোগ আনা হয়। গোপন বিচারের মাধ্যমে ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বেরিয়া ও তার পাঁচ সহযোগীকে ফাঁসি দেয়া হয়। ক্ষমতার যুদ্ধে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে বেরিয়াই সর্বশেষ ব্যক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নে নিজের প্রাণ বিসর্জন দেন।[৬৬] খ্রুশ্চেভ দেখলেন যে প্রেসিডিয়াম সংঘাতময় অবস্থানে রয়েছে, পার্টি এবং এর কেন্দ্রীয় কমিটি আবারো শক্তিশালী হয়ে উঠবে।[৬৭] খ্রুশ্চেভ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে উচ্চ পর্যায়ের দলীয় নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন এবং তার সমর্থকদেরকে স্থানীয় পর্যায়ে দলের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। এতে করে তার সমর্থকেরা কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসতে সক্ষম হয়।[৬৮] ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমদিকে মালেনকোভের স্থলে প্রেসিডিয়াম মিটিংয়ে বসেন খ্রুশ্চেভ। অক্ষর অনুযায়ী খ্রুশ্চেভের অবস্থান ছিল মালেনকোভের আগে। ক্ষমতায় বসার পর খ্রুশ্চেভের প্রভাব দিনদিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনকি, তার প্রতিনিধি হিসেবে গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবিতেও প্রধান হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়।[৬৯]
উদারতা এবং শিল্প-সাহিত্য
সম্পাদনাক্ষমতাচ্যুত হবার পর নিকিতা খ্রুশ্চেভ বরিস পাস্তরনায়েকের ‘ডক্টর জিভাগো’ উপন্যাসটির একটি সংখ্যা রাখেন। উপন্যাসটি সম্পর্কে পড়ে তিনি বলেন যে, আমরা এই বইটি নিষিদ্ধ করি নাই। আমি এটি নিজের পড়ার জন্য রেখেছি। বইটিতে সোভিয়েত বিরোধী বক্তব্য কোন কিছুই নেই।[৭০] নিকিতা খ্রুশ্চেভ বিশ্বাস করতেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ পশ্চিমা জীবনধারার সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে। পশ্চিমাদের উচ্চাকাঙ্খা ও জীবনধারার ফলে সোভিয়েত নাগরিকদের ভয়ের তেমন কিছুই নেই।[৭১]
স্তালিন বহিঃর্বিশ্বের কিছু পর্যটকদেরকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণের জন্য এবং এর পাশাপাশি কিছু সোভিয়েতবাসীকে বিশ্বের অন্যত্র ভ্রমণের জন্য অনুমোদন দিয়েছিলেন।[৭২] ১৯৫৭ সালে নিকিতা খ্রুশ্চেভ প্রায় ৭ লক্ষ সোভিয়েত নাগরিককে বিশ্বের অন্যত্র ভ্রমণের জন্য এবং বিদেশীদেরকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিদর্শনের জন্য অনুমোদন দেন।[৭২] একই সালে খ্রুশ্চেভের দিক-নির্দেশনায় ৬ষ্ঠ বিশ্ব যুব ও ছাত্র অনুষ্ঠান ঐ বছরের গ্রীষ্মে মস্কোতে আয়োজন করা হয়। তিনি কমসোমোলের কর্মকর্তাদেরকে নির্দেশ দেন যে, "বিদেশী অতিথিদের প্রতি নমনীয় হয়ে আমাদের আলিঙ্গন করতে হবে"।[৭৩]
চীনের সাথে সম্পর্ক
সম্পাদনা১৯৫৩ সালে সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিনের মৃত্যুর পর চৌ এন-লাই মস্কো ভ্রমণ করেন ও শবযাত্রায় যোগ দেন। গেওর্গি মালেনকোভ এবং লাভরেন্তি বেরিয়া’র সাথে তিনিও চৌ এন-লাইকে স্বাগতঃ জানান। তারা সবাই স্তালিনের কফিন বহন করেছিলেন। লাইয়ের সফরের প্রেক্ষাপটে ১৯৫৪ সালে খ্রুশ্চেভ গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ৫ম বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে চীন ভ্রমণ করেছিলেন।[৭৪][৭৫]
১৯৬০-এর দশকে অন্যতম সমাজতান্ত্রিক দেশ চীনের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের কম বন্ধুত্বসূলভ পরিবেশ ও সম্পর্ক বজায় ছিল।[৭৬] এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে যে, চীনা নেতা মাও সে তুং স্তালিনকে যথেষ্ট পছন্দ করতেন। খ্রুশ্চেভের পশ্চিমা ঘেঁষা নীতি মাও সে তুং পছন্দ করতে পারেননি। এছাড়াও, ঐ সময়ে নিকিতা খ্রুশ্চেভ স্তালিনবিরোধী নীতি বিষয়ে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন।[৭৭]
অপসারণ ও অবসর গ্রহণ
সম্পাদনা১৯৬৪ সালের মার্চ মাসের শুরুতে সুপ্রিম সোভিয়েত প্রধান লিওনিদ ব্রেজনেভ নিকিতা খ্রুশ্চেভের অপসারণের ব্যাপারে সহকর্মীদের সাথে আলাপ-আলোচনা করতে শুরু করেন।[৭৮] ১৪ অক্টোবর, ১৯৬৪ তারিখে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা একযোগে খ্রুশ্চেভের পদত্যাগ নিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। দলীয় সদস্যদের একমত পোষণের কারণে অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও কার্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিতে বাধ্য হন খ্রুশ্চেভ। এরফলে, লিওনিদ ব্রেজনেভ প্রথম সচিব ও পরবর্তীকালে মহাসচিব হিসেবে এবং আলেক্সি কোসেগিন নিকিতা খ্রুশ্চেভের বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন।[৭৯]
ক্ষমতাচ্যুত হবার পর খ্রুশ্চেভ প্রতি মাসে পাঁচশত রুবল হিসেবে অবসরকালীন ভাতা পেতেন। এছাড়াও, আবাসন এবং ডাচায় আজীবন বসবাসেরও নিশ্চয়তা পান তিনি।[৮০] ক্ষমতা থেকে চলে আসার পর থেকেই নিকিতা খ্রুশ্চেভ গভীর অবসাদে ভুগতে থাকেন।[৮১] তিনি খুব কমসংখ্যক দর্শনার্থীর সাথে দেখা করতেন। তার দেহরক্ষী সকল অতিথির তালিকা তৈরী করতেন এবং কখন তারা এলেন কিংবা চলে গেলেন তার সমূদয় তথ্য নিকিতাকে দিতেন।[৮২] ১৯৬৫ সালে খ্রুশ্চেভ এবং তার স্ত্রী বাড়ী ছাড়ার নির্দেশ পান ও ডাচা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে একটি এ্যাপার্টমেন্টে উঠেন। সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ তার জন্য বরাদ্দকৃত অবসরকালীন ভাতাও ৪০০ রুবলে কমিয়ে দেয়। তা স্বত্ত্বেও নিকিতার অবসরকালীন জীবন বেশ ভালভাবে ও স্বাচ্ছন্দ্যেই কেটে যায়।[৮৩][৮৪]
তার অবসাদ উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে। খ্রুশ্চেভের চিকিৎসক ঘুমের ঔষধ এবং উপশমকারী ঔষধ গ্রহণের জন্য পরামর্শ দিলেন। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও তার এক নাতীকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী কি অবস্থায় আছেন জিজ্ঞাসা করা হলে সে জানায় দাদা কাঁদছেন।[৮৫]
তিনি ৩০ খণ্ডের সোভিয়েত এনসাইক্লোপেডিয়ায় স্থান পাননি। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে মহান দেশপ্রেমের যুদ্ধের অন্যতম নায়ক এবং বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও এতে নিকিতা খ্রুশ্চেভের নামকে ঊহ্য রাখা হয়।[৪৭]
দেহাবসান
সম্পাদনাজীবনের শেষ দিনে খ্রুশ্চেভ তার জামাতা ও ঘনিষ্ঠ সহচর আলেক্সি আদজুবেইয়ের সাথে দেখা করেন। তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন যে, তুমি সুকঠিন সংঘাতময় সময় পার করে এসেছ এবং আমার সাথে কেন্দ্রীয় কমিটিতে কাজ করেছ। আমরা চীরস্মরণীয় হয়ে থাকব![৮৬] ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ তারিখে হৃদজনিত কারণে মস্কোর একটি হাসপাতালে ধরাধাম ত্যাগ করেন নিকিতা খ্রুশ্চেভ। তাকে মস্কোর নিকটবর্তী নোভোডেভিচি কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। ক্রেমলিন ওয়ালে তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত কিংবা সমাধিও দেয়া হয়নি। কবরস্থানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় এবং তার মৃত্যু সংবাদ গোপন করে রাখা হয়। মাত্র কয়েকজন শিল্পী এবং লেখক নিকিতা খ্রুশ্চেভের পরিবারের নিকটজনদের সাথে কবরপার্শ্বে ছিলেন।[৮৭]
প্রাভদা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ মাত্র একটি বাক্যে শেষ করে। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো যথোপযুক্তভাবে তার মৃত্যুকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে প্রচার করে।[৮৮] বিখ্যাত নিউইয়র্ক টাইমস্ পত্রিকার মস্কো প্রতিনিধি হ্যারী স্কার্জ খ্রুশ্চেভ সম্বন্ধে লিখেছেন, মি. ক্রুশ্চেভ দরজা খুলেছেন আবার জানালাগুলোকে পাথরের মতো কঠিনও করেছেন। তিনি মুক্ত বাতাস এবং চিন্তাধারায় স্বচ্ছ ছিলেন। পরিবর্তনের সময় ইতোমধ্যেই দেখা যাচ্ছে যা পূর্বে একেবারেই অখণ্ডনীয় ও অপরিবর্তনীয় ছিল।[৮৯]
স্বীকৃতি
সম্পাদনাজানুয়ারি, ১৯৫৮ সংখ্যায় বিখ্যাত সাময়িকী টাইম ম্যাগাজিন কর্তৃপক্ষ খ্রুশ্চেভকে পূর্ববর্তী বছরের টাইম বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাদের প্রচ্ছদ চিত্রে স্থান করে। স্মরণীয় যে, ১৯৫৭ সালটি ছিল স্পুৎনিক ১ মহাকাশে উৎক্ষেপিত বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহের বছর যা ৪ অক্টোবর, ১৯৫৭ সালে উৎক্ষেপণ করা হয়।
নিবন্ধে উল্লেখ করা হয় যে, নিকিতা খ্রুশ্চেভ হচ্ছেন এমন একজন খাটো, মোটা ও শক্ত এবং টাকপড়া, বাচাল ও তুখোড় শাসক যিনি ১৯৫৭ সালে অন্য যে কোন লোকের তুলনায় শ্রেষ্ঠ ও প্রতিরোধী।[৯০]
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক্রিস্টোফার অ্যান্ড্রু ও ভাসিলি মিট্রোখিন, দ্য মিট্রোখিন আর্কাইভ: দ্য কেজিবি ইন ইউরোপ এন্ড দি ওয়েস্ট, গার্ডনার্স বুকস (২০০০), আইএসবিএন ০-১৪-০২৮৪৮৭-৭.
- ↑ ক খ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ২। সোভিয়েত যুগের প্রতিবেদনে তার জন্ম তারিখ ১৭ এপ্রিল (প্রাচীন ধাঁচে ৫ এপ্রিল) তবে সাম্প্রতিককালে তার জন্মসনদে ১৫ এপ্রিল তারিখের বিষয়টি জীবনীকারেরা মেনে নিয়েছেন।
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ২০
- ↑ ক খ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১৮
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ২–৩
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ২৭
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ২৬
- ↑ ক খ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৩০
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ৬–৭
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৩৭–৩৮
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ৮
- ↑ কার্লসন ২০০৯, পৃ. ১৪১
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ৮–৯
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৩৮–৪০
- ↑ ক খ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৫২
- ↑ ক খ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৫৫
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ১৪
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৫৬–৫৭
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ১৫–১৬
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ১৬–১৭
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৬৩
- ↑ ক খ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৬৪–৬৬
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৬৬
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৬৮
- ↑ ক খ গ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৭৩
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ৩১–৩২
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৭৮
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ৩৩–৩৪
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৯৪–৯৫
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১০৫–০৬
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৯৮
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৯৯
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৯৯–১০০
- ↑ ক খ গ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১০০
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১০৪
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ৬৯
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১১৪–১৫
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১১৬
- ↑ ক খ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১১৮
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ৬০
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১৩৫–৩৭
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১৪৯
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১৫০
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১৬৩
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১৬২–৬৪
- ↑ খ্রুশ্চেভ ২০০৪, পৃ. ৩৪৭
- ↑ ক খ Whitman, Alden (১৯৭১-০৯-১২), "Khrushchev's human dimensions brought him to power and to his downfall", The New York Times, সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৯-২৫ (fee for article, but available free here)
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১৬৪–৬৮
- ↑ ক খ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১৬৮–৭১
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ৮১
- ↑ Birch, Douglas (২০০৮-০৮-০২), "Khrushchev kin allege family honor slurred", USAToday, সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৮-১৪
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ৮২
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১৫৮
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১৫৮–৬২
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ৮৬
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১৭৯
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১৮০
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১৮১
- ↑ খ্রুশ্চেভ ২০০৬, পৃ. ১৮–২২
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ২১০
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ২৩৬–৪১
- ↑ খ্রুশ্চেভ ২০০৬, পৃ. ১৬৭–৬৮
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ১১৪
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ১২১
- ↑ খ্রুশ্চেভ ২০০৬, পৃ. ১৮৬
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ১২৩
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ১২৫–২৬
- ↑ টবম্যান ও ২০০৩ ২০০৩, পৃ. 259.
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ২৬৪
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৬২৮
- ↑ Zubok 2007, পৃ. 175.
- ↑ ক খ Zubok 2007, পৃ. 172.
- ↑ Zubok 2007, পৃ. 174.
- ↑ Barnouin and Yu 117
- ↑ Spence 525
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৪৭০–৭১
- ↑ Zubok 2007, পৃ. 136.
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৬১৫
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১৬
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ১৬–১৭
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৬২২
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৬২২–২৩
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ২৭৮
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৬২৩
- ↑ টবম্যান ২০০৩, পৃ. ৬২৩–২৪
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ২৮১
- ↑ টম্পসন ১৯৯৫, পৃ. ২৮২–৮৩
- ↑ কার্লসন ২০০৯, পৃ. ২৯৯
- ↑ Schwartz, Harry (১৯৭১-০৯-১২), "We know now that he was a giant among men", The New York Times, সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৯-২৫ (fee for article)
- ↑ "Time magazine proclaimed Khrushchev Man of the Year, collect: January 6, 2012"। মার্চ ৩, ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৯।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- Nikita Khrushchev Archive at marxists.org
- The CWIHP at the Wilson Center for Scholars: The Nikita Khrushchev Papers
- Obituary, The New York Times, September 12, 1971, Khrushchev's Human Dimensions Brought Him to Power and to His Downfall
- The Case of Khrushchev's Shoe ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৩ নভেম্বর ২০০৬ তারিখে, by Nina Khrushcheva (Nikita's great-granddaughter), New Statesman, Oct. 2, 2000
- Modern History Sourcebook: Nikita S. Khrushchev: The Secret Speech—On the Cult of Personality, 1956 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৮ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে
- "Tumultuous, prolonged applause ending in ovation. All rise." Khrushchev's "Secret Report" & Poland
- Thaw in the Cold War: Eisenhower and Khrushchev at Gettysburg, a National Park Service Teaching with Historic Places (TwHP) lesson plan
- Khrushchev photo collection