দোয়েল

পাখির প্রজাতি

দোয়েল প্যাসেরিফরম (অর্থাৎ চড়াই-প্রতিম) বর্গের অন্তর্গত একটি পাখি। এর বৈজ্ঞানিক নাম Copsychus saularis।ওরিয়েন্টাল ম্যাগপাই-রবিন হল একটি ছোট প্যাসারিন পাখি যেটিকে আগে থ্রাশ ফ্যামিলি টার্ডিডির সদস্য হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু এখন এটিকে পুরানো বিশ্বের ফ্লাইক্যাচার হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এরা স্বাতন্ত্র্যসূচক কালো এবং সাদা পাখি যাদের লম্বা লেজ রয়েছে যা মাটিতে বা সুস্পষ্টভাবে পার্চ করার সময় সোজা হয়ে থাকে। এই পাখির বাংলা নামটির সঙ্গে ফরাসী ও ওলন্দাজ নামের মিল আছে। ফরাসী ভাষায় একে বলা হয় Shama dayal এবং ওলন্দাজ ভাষায় একে বলা হয় Dayallijster। এটি বাংলাদেশের জাতীয় পাখি। বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলের সর্বত্রই দোয়েল দেখা যায়।

দোয়েল
পুরুষ দোয়েল, থাইল্যান্ড
স্ত্রী দোয়েল, থাইল্যান্ড
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: Animalia
পর্ব: কর্ডাটা
শ্রেণী: পক্ষী
বর্গ: Passeriformes
পরিবার: Muscicapidae
গণ: Copsychus
প্রজাতি: C. saularis
দ্বিপদী নাম
Copsychus saularis
(Linnaeus, 1758)
প্রতিশব্দ

Gracula saularis Linnaeus, 1758

এছাড়াও বাংলাদেশভারতের জনবসতির আশেপাশে দেখতে পাওয়া অনেক ছোট পাখিদের মধ্যে দোয়েল অন্যতম। অস্থির এই পাখিরা সর্বদা গাছের ডালে বা মাটিতে লাফিয়ে বেড়ায় খাবারের খোঁজে।গ্রামীণ অঞ্চলে খুব ভোরে এদের কলকাকলি শোনা যায়।দোয়েল গ্রামের সৌন্দর্য আরও অপরূপ করে তোলে।

বাসস্থান

সম্পাদনা

নাতিশীতোষ্ণ দক্ষিণ এশিয়ায় মূলত: বাংলাদেশ , ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, চীনের দক্ষিণাঞ্চল ও ফিলিপাইনে এদের পাওয়া যায়। সাধারণত কাঠসমৃদ্ধ বন, চাষাবাদকৃত জমির আশেপাশে ও জনবসতিতে মানুষের কাছাকাছি এদের দেখতে পাওয়া যায়।বাংলাদেশে মূলত গ্রামীণ অঞ্চলে এদেরকে দেখা যায়।

সনাক্তকরণ

সম্পাদনা

দোয়েল আকারে ১৫-২০ সেন্টিমিটার বা ৭ - ৮ ইঞ্চি লম্বা। এর লম্বা লেজ আছে যা অধিকাংশ সময় খাড়া করে রাখে। পুরুষ দোয়েলের শরীরের উপরিভাগ ও গলার নিচে কালো রঙের, পেট সাদা। ডানার দুই পাশে সাদা রঙের প্যাঁচ আছ। স্ত্রী-দোয়েলের উপরিভাগ ও গলার নিচ ছাই-রঙা হয়। পেটের অংশ পুরুষ-দোয়েলের মত উজ্জ্বল নয়, বরং কিছুটা ফিকে সাদা।কিন্তু দেখতে অপরূপ সুন্দর!

বংশবিস্তার

সম্পাদনা

দক্ষিণ এশিয়ায় দোয়েলের প্রজননকাল মার্চ থেকে জুলাই; আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জানুয়ারি থেকে জুলাই। প্রজননকাল:দোয়েল বাংলাদেশের জাতীয় পাখি।পুরুষ দোয়েলের শরীরের রঙ উজ্জ্বলতর হয়। গাছের ডালে বসে স্ত্রী দোয়েলকে আকৃষ্ট করার জন্য হরেকরকম সুরে ডাকাডাকি করে। ডিম দেয়ার ৭ আগে এরা গাছের কোটরে বা ছাদের কার্ণিশে বাসা বানায়। সাধারণত ৫/৬টি ডিম দেয়। ডিমের রং ফিকে নীলচে-সবুজ, তার উপর বাদামী ছোপ থাকে। স্ত্রী দোয়েল ডিমে তা দেয়।৮ থেকে ১৬ দিন পরে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। প্রজননকালে পুরুষ দোয়েল আগ্রাসী হয়ে ওঠে। তখন বাসার আশেপাশে অন্য পাখিদের আসতে দেয়না।

স্বভাব-প্রকৃতি

সম্পাদনা

নানা রকম সুরে ডাকাডাকির জন্য দোয়েল সুপরিচিত। অস্থির এই পাখিরা সর্বদা গাছের ডালে বা মাটিতে লাফিয়ে বেড়ায় খাবারের খোঁজে। কীট -পতঙ্গ, ছোট ছোট শুঁও পোকা এদের প্রধান খাদ্য। কখনো কখনো সন্ধ্যার আগে আগে এরা খাবারের খোঁজে বের হয়। পুরুষ দোয়েল স্ত্রী দোয়েলকে আকৃষ্ট করার জন্য মিষ্টি সুরে ডাকাডাকি করে। তবে স্ত্রী দোয়েলও পুরুষ দোয়েলের উপস্থিতিতে ডাকতে পারে।

প্রয়োজন না হলে দোয়েল এক নাগাড়ে বেশি দূর উড়ে না। মাটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে খাদ্য খোঁজে। ধান কিংবা ভাত খাবার জন্য এ পাখি গৃহস্থের গোলাঘর, কিংবা রান্না ঘরেও ঢুকে পড়ে। শীতের সময় দোয়েল পাখি দেখা যায় না বললেই চলে এর কারন হচ্ছে এরা শীতের সময় গান গায় না যার কারণে এই সময় এদের আমাদের নজরে পড়ে না[]

সাংস্কৃতিক তাৎপর্য

সম্পাদনা

বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে দেশী ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে দোয়েল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকদের লেখাতে এই পাখির উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মুদ্রাতে (দুই টাকা) এই পাখির ছবি বহুল ব্যবহৃত। এই পাখির নামে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে দোয়েল চত্বর নামে একটি সড়ক চত্বর আছে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকার মাঝে অবস্থিত।[]

লোকগাথা

সম্পাদনা

দোয়েল নিয়ে বাংলাদেশের যশোরে প্রচলিত একটি গল্প আছে- এক দেশে কুচকুচে কালো এক দধিয়াল বাস করত। তার মতো সাদা দই আর কেউ বানাতে পারত না। তার দই পেলে মানুষ অন্য কারো দই খেত না। অন্য গয়ালরা চেয়েছিল এ দধিয়ালের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দই তৈরির কায়দাটা শিখে নিতে। কিন্তু দধিয়াল বিয়ে করেনি। দেশটির বুড়ো রাজা একদিন অল্প বয়েসী এক সুন্দরীকে বিয়ে করতে চাইলেন। কিন্তু মন্ত্রী চালাকি করে বললেন- মা যশোরেশ্বরী তাকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, কন্যাটিকে স্পর্শ করলে রাজার অমঙ্গল হবে। তাই রাজা ওই সুন্দরীকে বিয়ে করে অন্য এক পুরীতে বন্দি করে রাখলেন। নতুন রানী দই ছাড়া ভাত খাবেন না। মন্ত্রী রাজাকে ওই দধিয়ালের কথা জানালেন। লোকটি কালো হওয়ায় রাজা সন্দেহ না করে রাজি হলেন। দধিয়াল রানীকে রোজ দই দিতেন। তার জাদুকরি দই খেয়ে রানী অমৃতের স্বাদ পেলেন। তাদের মধ্যে প্রেম হল। একদিন এ খবর রাজা জেনে গেলে রানীর কাছে দধিয়ালের যাওয়া বন্ধ করে দেন। অনেকদিন পর একরাতে দধিয়াল দুটি কালো হাঁড়িতে দই নিয়ে রানীর পুরীর সামনে এসে ব্যাকুলভাবে ডাকতে লাগলেন। রানী তার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলেন না। তিনি যশোরেশ্বরীর কাছে প্রার্থনা করলেন। অতঃপর একটি পাখি হয়ে পিক করে ডেকে গাছে গিয়ে বসলেন। দধিয়ালও তখন পাখি হয়ে তার পাশে গিয়ে বসলেন। এরপর দু’জনেই উড়ে অন্য রাজ্যে চলে গেলেন। এরাই দোয়েল, দধিয়াল বা দয়েল পাখি। সেই দইয়ের সাদা আর হাঁড়ির কালো রং এখনও দোয়েলের বুকে দেখা যায়।

দোয়েল পাখি কমে যাওয়ার কারন

সম্পাদনা

শহরে যে ধরনের আলো দেয়া হচ্ছে, সেগুলো মানুষ ও পাখি, উভয়ের শরীরের পক্ষেই ক্ষতিকর। অপরদিকে এই পাখিদের ওয়েটল্যান্ড ও নদী তীরবর্তী বাসস্থানের দ্রুত ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণেও দোয়েল পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। রাসায়নিক পদার্থ অতিরিক্ত নির্গমন বিপজ্জনকভাবে কমিয়ে দিচ্ছে দোয়েলের সংখ্যা।

চিত্রমালা

সম্পাদনা

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. BirdLife International (২০১২)। "Copsychus saularis"বিপদগ্রস্ত প্রজাতির আইইউসিএন লাল তালিকা। সংস্করণ 2012.1প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুলাই ২০১২ 
  2. "বাংলাদেশের জাতীয় পাখি দোয়েলের পরিচিতি, বৈশিষ্ট, স্বাভাব, প্রজননকালীন আচরণ ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব"Familiarity with Animals-FWA। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৯-০৬ 
  3. "দোয়েল চত্বরের তিলোত্তমায় মুগ্ধ পথচারী" (Bengali ভাষায়)। Dhaka। মে ৭, ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১১, ২০২১