দত্তাত্রেয় উপনিষদ্‌

দত্তাত্রেয় উপনিষদ্‌ বা দত্তাত্রেয়োপনিষদ্‌ (সংস্কৃত: दत्तात्रेय उपनिषत्) হল একটি হিন্দুশাস্ত্র। এটি দেবতা দত্তাত্রেয়ের প্রতি উৎসর্গিত। দত্তাত্রেয় উপনিষদ্‌ সংস্কৃত ভাষায় রচিত ১০৮টি উপনিষদের অন্যতম। এটি একটি বৈষ্ণব উপনিষদবিষ্ণুকে এই উপনিষদের রচয়িতা মনে করা হয়। এটি অথর্ববেদের সঙ্গে যুক্ত।[] এখানে ঋষি দত্তাত্রেয়কে বিষ্ণুর একটি অবতার হিসেবে বন্দনা করা হয়েছে এবং দত্তাত্রেয়ের পূজায় ব্যবহৃত মন্ত্রগুলি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।[] দত্তাত্রেয় সম্প্রদায়ের কাছে এই উপনিষদ্‌টি একটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ।

দত্তাত্রেয়
দত্তাত্রেয়, দত্তাত্রেয় উপনিষদ্‌ এই দেবতার প্রতি উৎসর্গিত
দেবনাগরীदत्तात्रेय
IASTDattātreya
নামের অর্থদত্তাত্রেয় নামক দেবতার নাম
রচয়িতাবিষ্ণু
উপনিষদের
ধরন
বৈষ্ণব
সম্পর্কিত বেদঅথর্ববেদ
অধ্যায়ের সংখ্যা

মুক্তিকা ক্রমের ১০৮ উপনিষদের তালিকায় অথর্ববেদ বিভাগের ১১০ সংখ্যায় পাঠ্যটি তালিকাভুক্ত। অ্যান্টোনিও রিগোপলোসের মতে, এটি তান্ত্রিক শাখা থেকে উৎপন্ন এবং থেকে দেবী-উপাসনাকেন্দ্রিক শাক্ত সম্প্রদায়ের বিশেষ প্রভাব লক্ষিত হয়। আই. এম. পি. রিসাইডের মতে, দত্তাত্রেয় সম্প্রদায় দত্তাত্রেয় পূজা জনপ্রিয় করে তোলার পর এই উপনিষদ্‌ রচিত হয়।[]

বিষয়বস্তু

সম্পাদনা

দত্তাত্রেয় উপনিষদ্‌ তিনটি খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, বিষ্ণুকে (নারায়ণ) জিজ্ঞাসা করেন, কীভাবে ‘সংসার সমুদ্র’ অর্থাৎ জন্ম ও মৃত্যুর চক্রের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বিষ্ণু বলেন যে, তিনি স্বয়ং ভগবান দত্তাত্রেয় (দত্ত) এবং দত্তাত্রেয়ের মূর্তিতে তাকে ধ্যান করলে সংসার সমুদ্রের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বিষ্ণুর পরামর্শক্রমে ব্রহ্মা দত্তাত্রেয়ের ধ্যান করে বুঝতে পারেন অনন্ত ও অদ্বিতীয় ব্রহ্ম ব্রহ্মাণ্ড ধ্বংসের পর অবশিষ্টাংশ রূপে পড়ে থাকেন।[][]

দত্তাত্রেয়ের বিভিন্ন মন্ত্র কথিত হয়েছে। তন্ত্রে দেবতার একাক্ষর মন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ। দত্তাত্রেয়ের ‘দং’ মন্ত্রটিকে হংস এবং সকল জীবের আত্মা বলা হয়েছে। এই মন্ত্রের সম্প্রসারিত রূপ ‘দাং’ মন্ত্রটিকে পরব্রহ্ম বলা হয়েছে। ‘দং’ ও ‘দ্রং’ বীজমন্ত্রদুটি দত্তাত্রেয় পূজায় জনপ্রিয়। ‘ওঁ শ্রীঁ হ্রীঁ ক্লীঁ গ্লৌঁ দ্রাং’ – এই ষড়ক্ষরী মন্ত্রটিও দেওয়া হয়েছে। এই মন্ত্রটিতে তান্ত্রিক ও শাক্ত প্রভাব লক্ষিত হয়। ‘হ্রীঁ’ বীজের মাধ্যমে দত্তাত্রেয়ের শক্তির উল্লেখ করা হয়েছে। ‘শ্রীঁ’ বিষ্ণুর পত্নী লক্ষ্মীর বীজ। সেই সূত্রে লক্ষ্মী হলেন দত্তাত্রেয়ের শক্তি। এরপর অষ্টাক্ষরী মন্ত্র ‘দ্রাং দত্তাত্রেয়েয় নমঃ’ উল্লেখ করা হয়েছে। এটির অর্থ ‘দ্রাং দত্তাত্রেয়কে প্রণাম’। এই গ্রন্থের মতে দত্তাত্রেয়ায় শব্দের অর্থ সচ্চিদানন্দ এবং নমঃ শব্দের অর্থ আনন্দ। এরপর দ্বাদশাক্ষরী ও ষোড়শাক্ষরী দুটি মন্ত্র আছে। এগুলি হল যথাক্রমে ‘ওঁ আঁ হ্রীঁ ক্রোঁ এহি দত্তাত্রেয় স্বাহা’ ও ‘ওঁ ঐঁ ক্রোঁ ক্লীঁ ক্লৌঁ হ্রঁ হ্রীঁ হ্রৌঁ সৌঃ দত্তাত্রেয়ায় স্বাহা’। দুটি মন্ত্রেই শাক্ত প্রভাব দেখা যায়। এই মন্ত্রগুলিতে শিবশক্তির মতো দত্তাত্রেয় ও লক্ষ্মীর সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। এই মন্ত্রগুলির ছন্দ বৈদিক ছন্দ গায়ত্রী, ঋষি সদাশিব (যিনি এই মন্ত্র রচনা করেছেন বলে মনে করা হয়) এবং মন্ত্রের দেবতা দত্তাত্রেয়।[][][]

এরপর ‘দত্তাত্রেয় হরে কৃষ্ণ...’ বলে অনুষ্টুপ ছন্দে একটি মন্ত্র রয়েছে। এখানে দত্তাত্রেয়কে বিষ্ণুর অন্যান্য নাম হরিকৃষ্ণ নামে বন্দনা করা হয়েছে। এই মন্ত্রে দত্তাত্রেয়কে নগ্ন ঋষি ও আনন্দমত্ত মৌনী মুনি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে তাকে শিশু ও পিশাচ বলা হয়েছে। শেষে তাকে জ্ঞানসমুদ্র ও মহৎ গুরু রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এটিই দত্তাত্রেয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় মন্ত্র।[]

দ্বিতীয় খণ্ডে দত্তাত্রেয়ের মালামন্ত্র ‘ওঁ নমো ভগবতে দত্তাত্রেয়ায়...’ বর্ণিত হয়েছে। এটি জপের মন্ত্র। একটি স্তোত্রে বলা হয়েছে দত্তাত্রেয়কে স্মরণ মাত্রেই অতি সহজেই তুষ্ট করা যায়। তিনি সকল ভয় হরণ করেন, মহাজ্ঞান প্রদান করেন এবং চৈতন্য ও আনন্দে বাস করেন। আগের মতোই এখানে তাকে শিশু, উন্মত্ত ও দানব বলে বর্ণনা করা হয়েছে।[] তাকে ঋষি অত্রি ও তার স্ত্রী অনসূয়ার পুত্র এবং এক মহাযোগী ও অবধূত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তাকে সকল মন্ত্র, তন্ত্র ও শক্তির মূর্তি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে তিনি ভক্তের হৃদয়ের সব ইচ্ছা পূর্ণ করেন, জাগতিক বন্ধন ও গ্রহের ফের নষ্ট করেন, দুঃখ ও দারিদ্র হরণ করেন, রোগ আরগ্য করেন এবং মনে মহানন্দ দেন।[]

শেষ খণ্ডে ঔপনিষদ্‌ সাহিত্যের প্রথানুসারে এই গ্রন্থ পাঠের ফল বর্ণিত হয়েছে। যিনি বিদ্যা ও এই গ্রন্থের সব কটি পবিত্র মন্ত্র শিক্ষা করেন, তিনি অসংখ্যবার গায়ত্রী মন্ত্র, শ্রীরুদ্রচমকম্‌ স্তোত্র ও ওঁ জপের ফল ভোগ করেন এবং সকল পাপ মুক্ত হন।[]

টীকা ও কালনিরূপণ

সম্পাদনা

দত্তাত্রেয় উপনিষদ্‌ ছাড়াও জাবালা উপনিষদ্‌ এবং দুটি সন্ন্যাস এবং দুটি যোগ উপনিষদে (শাণ্ডিল্য উপনিষদ্‌ সহ) দত্তাত্রেয়ের উল্লেখ আছে।[] জাবালা উপনিষদ্‌ বাদে দত্তাত্রেয় উপনিষদ্‌ সহ বাকি সবকটিই পরবর্তীকালের রচনা বলে মনে করা হয়। এগুলি মধ্যযুগে খ্রিস্টীয় ১৪শ-১৫শ শতাব্দী নাগাদ রচিত। দত্তাত্রেয় উপনিষদ্‌ শাক্ত উপনিষদ্‌গুলির মতো একটি সাম্প্রদায়িক উপনিষদ্‌।[] এনসাইক্লোপিডিয়া অফ হিন্দুইজম অনুসারে, পরবর্তীকালের উপনিষদ্‌গুলি প্রকৃত উপনিষদ্ নয়। কারণ, এই মর্যাদা গবেষকরা শুধুমাত্র মুখ্য উপনিষদ্‌গুলিকেই দিয়ে থাকেন। দত্তাত্রেয় উপনিষদ্‌কে সাম্প্রদায়িক ও তান্ত্রিক উপনিষদ্‌ বলা হয়। মনে করা হয়, সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনার প্রচারে এই ধরনের উপনিষদ্‌গুলি উপনিষদ্‌ নামটির যথেচ্ছ অপপ্রয়োগ করেছে।[১০]

পাদটীকা

সম্পাদনা
  1. Farquhar, John Nicol (১৯২০), An outline of the religious literature of India, H. Milford, Oxford university press, পৃষ্ঠা 364, আইএসবিএন 81-208-2086-X 
  2. Roshen Dalal (অক্টোবর ২০১১)। Hinduism: An Alphabetical Guide। Penguin Books India। পৃষ্ঠা 113। আইএসবিএন 978-0-14-341421-6 
  3. Rigopoulos pp. 69–70
  4. Rigopoulos pp. 70–4
  5. "Dattatreya Upanishad"। ২৩ মে ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ জানুয়ারি ২০১৫ 
  6. Tattvāloka। Sri Abhinava Vidyatheertha Educational Trust। ২০০৩। 
  7. Rigopoulos pp. 74–6
  8. Rigopoulos p. 77
  9. Kashmiri Scholars Contribution to Knowledge and World Peace: Proceedings of National Seminar by Kashmir Education Culture & Science Society (K.E.C.S.S.), New Delhi। APH Publishing। ১ জানুয়ারি ২০০৮। পৃষ্ঠা 103–। আইএসবিএন 978-81-313-0402-0 
  10. Nagendra Kumar Singh (১৯৯৯)। Encyclopaedia of Hinduism। Centre for International Religious Studies : Anmol Publications। পৃষ্ঠা 3। আইএসবিএন 978-81-7488-168-7 

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা