তরঙ্গ

স্থির সাম্যাবস্থায় পুনঃপুন স্পন্দন

তরঙ্গ বা ঢেউ হলো এক ধরনের কম্পনরত আন্দোলন যা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে শক্তি সঞ্চারিত করে[][]। মাধ্যম ব্যতিরেকে তরঙ্গ শূন্যস্থান দিয়েও সঞ্চারিত হতে পারে। এ ধরনের তরঙ্গ হলো তাড়িতচ্চৌম্বক তরঙ্গ এবং মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। জড় মাধ্যমের কণার আন্দোলনের ফলে বা কোনো বস্তুর কলাকৌশলের ফলে যে তরঙ্গ সৃষ্টি হয় তাকে যান্ত্রিক তরঙ্গ বলে। এই তরঙ্গ মাধ্যমের কণার কোন স্থায়ী ঘটায় না, বরং এই তরঙ্গ মাধ্যমের কণাগুলোর স্পন্দন বা কম্পন দ্বারা সঞ্চালিত হয়।সুতরাং যান্ত্রিক তরঙ্গের সঞ্চালনের জন্য মাধ্যমটি স্থিতিস্থাপক এবং অবিচ্ছিন্ন হওয়া প্রয়োজন।

পানির উপরিতলে তরঙ্গ

তরঙ্গ বেগ : নির্দিষ্ট দিকে, প্রতি সেকেন্ড সময়ে তরঙ্গ যে দূরত্ব অতিক্রম করে, তাকে ঐ তরঙ্গের তরঙ্গ বেগ বলে।

পদার্থবিজ্ঞানে তরঙ্গ সঞ্চালনকারী কোনো কম্পনশীল কণার একটি পূর্ণ কম্পন সম্পন্ন হতে যে সময় লাগে সেই সময়ে তরঙ্গ যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বলে এটি তরঙ্গের একই ফেজ এর পরপর সংশ্লিষ্ট বিন্দুর মধ্যে দূরত্ব।যেমন দুটি সংলগ্ন ক্রেস্ট, ট্রফ বা শূন্য ক্রসিং উভয়ই ট্রাভেলিং তরঙ্গের একটি বৈশিষ্ট্য এবং সেইসাথে অন্যান্য স্থানিক তরঙ্গের একটি নিদর্শন।  তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিপরীত দিককে স্থানিক কম্পাঙ্ক বলে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য সাধারণত গ্রিক অক্ষর ল্যাম্বডা (λ) দ্বারা চিহ্নিত হয়। তরঙ্গদৈর্ঘ্য শব্দটি কখনও কখনও মড্যুলেটেড তরঙ্গ এবং বিভিন্ন সাইনোসয়েডের হস্তক্ষেপ দ্বারা গঠিত মডুলেটেড তরঙ্গ বা তরঙ্গের সাইনোসয়েডাল খামেও প্রয়োগ করা হয়। উচ্চতর কম্পাঙ্কবিশিষ্ট তরঙ্গগুলির ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্য থাকে এবং নিম্ন কম্পাঙ্কবিশিষ্ট তরঙ্গগুলির দীর্ঘতর তরঙ্গদৈর্ঘ্য থাকে।

যে মাধ্যম দিয়ে তরঙ্গ চলাচল করে, সেই মাধ্যমের উপর তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্ভর করে। (উদাহরণস্বরূপ, ভ্যাকুয়াম, বায়ু বা জল)। তরঙ্গের উদাহরণ হল শব্দ তরঙ্গ, আলোকতরঙ্গ, জলতরঙ্গ এবং পর্যায়ক্রমিক বৈদ্যুতিক তরঙ্গ(যা একটি কন্ডাক্টর)। একটি শব্দ তরঙ্গ বায়ুর একটি পরিবর্তনের ফলে চাপ, আলো এবং অন্যান্য ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন এবং চৌম্বক ক্ষেত্র পরিবর্তিত হয়। জলের তরঙ্গ হল জলের পৃষ্ঠের উচ্চতার তারতম্য। একটি স্ফটিক জালির কম্পন এ, পারমাণবিক অবস্থান পরিবর্তিত হয়।

তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা কম্পাঙ্কের পরিসরকে বর্ণালী বলা হয়।বর্ণালী নামের উৎপত্তি দৃশ্যমান আলোর বর্ণালী থেকে। এখন সমগ্র ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রাম প্রয়োগ এর পাশাপাশি একটি শব্দ বর্ণালী বা কম্পন বর্ণালী প্রয়োগ করা যেতে পারে।

তরঙ্গ পাদঃ তরঙ্গর ঋনাত্তক দিকে তরঙ্গদৈঘ্যর সর্বাদিক সরনের বিন্দু কে অই তরঙ্গর তরঙ্গ পাদ বলে। কোনে একটা তরঙ্গর তরঙ্গ শীর্ষ এবং তরঙ্গ পাদ কখনোই সমদশা হতে পারবে না। কারন সমদশা হলে তরঙ্গ সৃষ্টি হতেই পারবে না। কারন এরা পরস্পর বিপরীত দশা সমপন্ন

বৈশিষ্ট্য

সম্পাদনা
 
পানিতে ঝাঁপ দিলে পানির উপরিতলে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়

তরঙ্গের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যগুলো থাকে তা হলো:[]

  • তরঙ্গের সৃষ্টি হয় মাধ্যমের কণার স্পন্দন বা কম্পনের ফলে। কিন্তু এর প্রভাবে মাধ্যমের কণা স্থানান্তরিত হয় না শুধুমাত্র মাধ্যমের ভিতর দিয়ে তরঙ্গাকারে আন্দোলন সঞ্চারিত হয়।
  • তরঙ্গের বেগ ও মাধ্যমের কণাগুলোর স্পন্দনের বেগ আলাদা। মাধ্যমের সব জায়গায় তরঙ্গের বেগ একই থাকে কিন্তু মাধ্যমের কণাগুলো বিভিন্ন বেগে স্পন্দিত হয়। সাম্যাবস্থানে কণাগুলোর বেগ সবচেয়ে বেশি।
  • সব তরঙ্গই শক্তি ও তথ্য সঞ্চারণ করে।
  • তরঙ্গের বিস্তার,কম্পন, তরঙ্গদৈর্ঘ্য আছে।
  • তরঙ্গ অগ্রগামী বা স্থির হতে পারে।
  • তরঙ্গ আড় বা লম্বিক অর্থাৎ অনুপ্রস্থ বা অনুদৈর্ঘ্য বরাবর হতে পারে।
  • এর প্রতিফলন, প্রতিসরণ,ব্যতিচার,অপবর্তন ঘটে।
  • তরঙ্গের প্রবাহের অভিমুখ বা দিক আছে।

তরঙ্গের প্রকারভেদ

সম্পাদনা

সরল ছন্দিত তরঙ্গ তরঙ্গশীর্ষ বা চূড়া এবং তরঙ্গপাদ বা তল দ্বারা বৈশিষ্টায়িত। এই তরঙ্গ সাধারণত দুই ধরনের, অনুপ্রস্থ তরঙ্গ ও অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ। যে তরঙ্গের সঞ্চালনের দিক মাধ্যমের কণাগুলোর স্পন্দনের দিকের সাথে সমকোণে থাকে তাকে অনুপ্রস্থ তরঙ্গ বলা হয়। যেমন তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গ বা সুতার মধ্যে দিয়ে সঞ্চারিত তরঙ্গ। অন্যদিকে অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গে তরঙ্গ সঞ্চালনের দিক মাধ্যমের কণাগুলোর স্পন্দনের দিকের সাথে সমান্তরালে থাকে। এর উদাহরণ হলো শব্দ তরঙ্গ।

 
A = পানির গভীরে.
B = অগভীর পানিতে। উপরিতলের একটি বস্তুর উপবৃত্তাকার গতি গভীরতা কমার সাথে সাথে সমান হয়ে আসে
1 = তরঙ্গ সঞ্চারণের দিক
2 = তরঙ্গশীর্ষ
3 = তরঙ্গপাদ

আদর্শ অবস্থায় সব তরঙ্গই কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো হলোঃ

  • প্রতিফলন - প্রতিফলক তলে আপতিত হওয়ার পর তরঙ্গের অভিমুখ পরিবর্তিত হয় এবং আপতন কোণ সর্বদা প্রতিফলন কোণের সমান হয়।
  • প্রতিসরণ - এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে প্রবেশ করার সময় তরঙ্গের বেগের পরিবর্তন হয়।
  • অপবর্তন (Diffraction) - একই তরঙ্গমুখের বিভিন্ন অংশ থেকে নির্গত গৌণ তরঙ্গসমূহের উপরিপাতনের ফলে অপবর্তনের সৃষ্টি হয়। কোন প্রতিবন্ধকের ধার ঘেঁষে বা সরু চিরের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় জ্যামিতিক ছায়া অঞ্চলের মধ্যে আলো বেঁকে যাওয়ার ঘটনাকে আলোর অপবর্তন বলে।
  • ব্যতিচার (Interference) - একই উৎস থেকে নির্গত দুটি সুসঙ্গত তরঙ্গমুখ থেকে প্রাপ্ত তরঙ্গের উপরিপাতনের ফলে ব্যতিচার সৃষ্টি হয়।
  • বিচ্ছুরণ -

উদাহরণ

সম্পাদনা
 
সমুদ্রের ঢেউ পাথরের উপরে আছড়ে পড়ছে

গাণিতিক বর্ণনা

সম্পাদনা
 
সম বিস্তারের একটি তরঙ্গ
 
একটি তরঙ্গ (নীল রঙের) এবং এর মোড়কের (লাল রঙের)

'তরঙ্গদৈর্ঘ্য হচ্ছে পরপর দুটি তরঙ্গশীর্ষের (বা তরঙ্গপাদের)মধ্যবর্তী দূরত্ব। এটি গাণিতিকভাবে   দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।

তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সাথে তরঙ্গসংখ্যা কে ( ) গাণিতিকভাবে নিম্নলিখিত উপায়ে সম্পর্কযুক্ত করা যায়:

 
 
সরল ছন্দিত স্পন্দন

পর্যায়কাল ( ) হলো একটি পূর্ণ স্পন্দন সম্পন্ন করতে একটি তরঙ্গ সঞ্চারকারী কণার যে সময় লাগে। কম্পাঙক (  বা  ) হচ্ছে একটি তরঙ্গ সঞ্চারকারী কণা এক সেকেন্ডে যতগুলো পূর্ণ কম্পন সম্পন্ন করতে পারে সেই সংখ্যা। এর একক হার্জ। এদের মধ্যে গাণিতিক সম্পর্ক হলো:

 

সুতরাং পর্যায়কাল এবং কম্পাঙ্ক পরস্পরের ব্যস্তানুপাতিক।

স্থির তরঙ্গ

সম্পাদনা
 
স্থির মাধ্যমে স্থির তরঙ্গ

স্থির তরঙ্গ হলো এমন একটি তরঙ্গ যা সঞ্চারণশীল নয়, বরং স্থির। স্থির তরঙ্গ সৃষ্টি হতে পারে এমন ক্ষেত্রে যখন তরঙ্গের মাধ্যমটি তরঙ্গের বিপরীত দিকে সঞ্চারণশীল থাকে অথবা কোন স্থির মাধ্যমে দুটি বিপরীতমূখী তরঙ্গের উপরিপাতনের ফলে। তরঙ্গ সংজ্ঞা :- কোনো স্থিতিস্থাপক কণাগুলো সমষ্টিগত কম্পনের ফলে তৈরি শব্দের যে আলোড়ন কণাগলোকে স্থানচ্যুত না করে একস্থান থেকে অন্যস্থানে শক্তি সঞালিত করে তাকে তরঙ্গ বলে ।

তরঙ্গ মাধ্যম

সম্পাদনা

যে জড় মাধ্যম দ্বারা তরঙ্গ সঞ্চারিত হয় তাকে তরঙ্গ মাধ্যম বলা যায়। তরঙ্গ মাধ্যমকে নিম্নলিখিত ভাবে প্রকারান্তর করা যায়ঃ

  • সীমিত মাধ্যম এবং অসীম মাধ্যম
  • সরলরৈখিক মাধ্যম যদি মাধ্যমের যে কোন বিন্দুতে অবস্থিত ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গের বিস্তার যোগ করা যায়।
  • হোমোজেনিয়াস বা সম মাধ্যম মাধ্যমের কণাগুলোর বৈশিষ্ট্য স্থানভেদে পরিবর্তিত হয় না।
  • আইসোট্রপিক মাধ্যম
  1. চ্যাং, রেমন্ড (২০১৭)। কেমিস্ট্রি। ম্যাকগ্র-হিল। 
  2. জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত মাধ্যমিক পদার্থ বিজ্ঞান, পরিমার্জিত সংস্করণ ডিসেম্বর ২০০৮ পৃষ্ঠা ১০৪
  3. জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত মাধ্যমিক পদার্থ বিজ্ঞান, পরিমার্জিত সংস্করণ ডিসেম্বর ২০০৮ পৃষ্ঠা ১০৬
  4. Hartle, JB (২০০৩)। Gravity: An Introduction to Einstein's General RelativityAddison-Wesley। পৃষ্ঠা 332আইএসবিএন 978-981-02-2749-4 

বিবলিওগ্রাফি

সম্পাদনা
  • Campbell, M. and Greated, C. (1987). The Musician’s Guide to Acoustics. New York: Schirmer Books.
  • French, A.P. (১৯৭১)। Vibrations and Waves (M.I.T. Introductory physics series)। Nelson Thornes। আইএসবিএন 0-393-09936-9ওসিএলসি 163810889 
  • Hall, D. E. (১৯৮০), Musical Acoustics: An Introduction, Belmont, California: Wadsworth Publishing Company, আইএসবিএন 0534007589 .
  • Hunt, F. V. (১৯৯২) [1966], Origins in Acoustics, New York: Acoustical Society of America Press, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ৩ জুলাই ২০০৯ .
  • Ostrovsky, L. A.; Potapov, A. S. (১৯৯৯), Modulated Waves, Theory and Applications, Baltimore: The Johns Hopkins University Press, আইএসবিএন 0801858704 .
  • Vassilakis, P.N. (2001). Perceptual and Physical Properties of Amplitude Fluctuation and their Musical Significance. Doctoral Dissertation. University of California, Los Angeles.

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা