জয়নগরের মোয়া

কনকচূড় ধানের খই ও খেজুর গুড় দিয়ে তৈরী একটি অতি জনপ্রিয় মোয়ার প্রকারভেদ


জয়নগরের মোয়া হল কনকচূড় ধানের খই, খেজুর গুড় ও গাওয়া ঘিয়ের তৈরী একটি অতি জনপ্রিয় মোয়া জাতীয় মিষ্টান্ন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জয়নগর শহর এই মিষ্টান্নটির জন্য খুব বিখ্যাত। জয়নগর শহরের পূর্ণচন্দ্র ঘোষ ওরফে বুঁচকিবাবু এবং নিত্যগোপাল সরকারকে জয়নগরের মোয়ার বাণিজ্যিক বিপণনের পথিকৃৎ বলে ধরা হয়। পরবর্তীতে কলকাতা সহ সমগ্র দক্ষিণবঙ্গেই এটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। এটি একটি জনপ্রিয় মরসুমী (শীতকালীন) মিষ্টান্ন। মাঝে মাঝে এতে সহজলভ্য উপাদান ও সুগন্ধিও যুক্ত করা হয়।[] এই মোয়া শিল্পের সাথে কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির প্রায় এক লক্ষ মানুষ জড়িত।[]

জয়নগরের মোয়া
ভৌগোলিক নির্দেশক
জয়নগরের মোয়া
ধরনপশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত মিষ্টান্ন
অঞ্চলজয়নগর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ
দেশ ভারত
নথিবদ্ধ২৩ মার্চ ২০১৫; ৯ বছর আগে (23 March 2015)
উপাদানকনকচূড় ধানের খই, নলেন গুড় ও গাওয়া ঘি
প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইটhttp://ipindiaservices.gov.in/GirPublic/Application/Details/382

ইতিহাস

সম্পাদনা

জনশ্রুতি অনুসারে জয়নগরের মোয়ার আবিষ্কারক হল জয়নগর শহরের নিকটবর্তী বহরু গ্রামের জনৈক যামিনীবুড়ো।[] একটি অনুষ্ঠানে তিনি নিজের খেতে উৎপাদিত কনকচূড় ধানের খই ও নলেন গুড় দিয়ে মোয়া প্রস্তুত করে পরিবেশন করেন। সেই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন যুগাবতার শ্রীচৈতন্যদেব স্বয়ং। তিনি মোয়া খেয়ে খুব সুখ্যাতি করেছিলেন।[] ক্রমে এই মোয়া জয়নগর শহরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। জয়নগরের মোয়া প্রস্তুতকারকরা তখন থেকেই ব্যবসায়িক ভিত্তিতে এই মোয়া তৈরী করতে থাকেন। ১৯২৯ সালে জনৈক পূর্ণচন্দ্র ঘোষ ওরফে বুঁচকিবাবু এবং নিত্যগোপাল সরকার জয়নগর শহরে তাদের মোয়া তৈরীর কারখানা ও দোকান স্থাপন করেন।[][][]

উপাদান

সম্পাদনা

জয়নগরের মোয়ার প্রধান উপাদান কনকচূড় ধানের খই, নলেন গুড় ও গাওয়া ঘি। এছাড়াও ক্ষীর, পেস্তা, কাজুবাদাম, কিসমিস ও পোস্ত ব্যবহার করা হয়। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার কুলপি, কাকদ্বীপ ও নামখানা অঞ্চলের প্রায় ৪০০ বিঘা জমিতে কনকচূড় ধানের চাষ হয়। নলেন গুড়ের উৎস খেজুর গাছ। শীতকালে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন শিউলিরা। সব চেয়ে উৎকৃষ্ট মানের রস পাওয়া যায় জিরেন কাঠ অর্থাৎ যে খেজুর গাছকে কয়েকদিন বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে এমন গাছ থেকে। জিরেন কাঠ থেকে রস সংগ্রহ করে তিন দিন রাখা হয়।[] তারপর সেই রস ঢিমে আঁচে জ্বাল দিয়ে তৈরী হয় নলেন গুড়।

 
জয়নগরের মোয়ার ভৌগোলিক উপদর্শন প্রশংসাপত্র

জয়নগরের মোয়া অনেক ধরনের উপাদান যুক্ত করে তৈরি করা হয়। এতে খেজুরের গুড়, কনকচুর খই, এলাচি, পেস্তা-কাজু-কিশমিশ ও গাওয়া ঘি (গরুর দুধে তৈরি) মিশানো হয়। এই মিষ্টি শীতকালে (নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারিতে) তৈরি করা হয়।[] সেইসময় জয়নগর শহর ও তার আশেপাশের প্রায় ২৫০ টি মিষ্টির দোকানে জয়নগরের মোয়া তৈরি করা হয়। জয়নগরের মোয়া উৎপাদনে শ্রী কৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার একমাত্র পুরাতন দোকান যা ১৯২৯ সালে জয়নগরের মোয়ার বিক্রয় শুরু করে। এই জয়নগরের মোয়া ভারতের ভৌগোলিক স্বীকৃতি বহন করে।[][]

বর্তমান অবস্থা

সম্পাদনা

বর্তমানে জয়নগরের মোয়া ব্যবসা অন্যান্য মিষ্টির ব্যবসার সাথে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং এটি অলাভজনক ব্যবসা হিসাবে ধরা হয়। সেখানকার লোকজনের দাবি যে, জয়নগরের মোয়াতে নকল উপাদান ব্যবহার করা হয়।[] জয়নগরের মোয়া উৎপাদনের উপাদান সমূহ অনেক দুর্লভ হয়ে গেছে কারণ জয়নগরের মোয়া শুধুমাত্র কনকচুর খই দিয়ে তৈরি করার নিয়ম যা বর্তমানে তেমন মাঠ পর্যায়ে উৎপাদন করা হয় না। আর খেজুর গাছের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। তাই এটি তৈরিতে নকল / বিকল্প দ্রব্য সামগ্রী ব্যবহার করা হয় যার ফলে জয়নগরের মোয়ার মৌলিকত্ব হারিয়ে যাচ্ছে।[]

বিতর্ক

সম্পাদনা

সাম্প্রতিককালে জয়নগরের মোয়ার প্রধান দুই উপাদান কনকচূড় ধান ও নলেন গুড়ের উৎপাদন কমে যাওয়ায় জয়নগরের মোয়ার উৎপাদনও কমেছে। জয়নগরের মোয়ার সেই বাজার দখল করেছে সস্তা দামের নকল জয়নগরের মোয়া। নকল মোয়াতে নলেন গুড়ের পরিবর্তে থাকে পায়েস ও রাসায়নিক সুগন্ধী এবং কনকচূড় ধানের খইয়ের পরিবর্তে থাকে নিম্নমানের খই।[] অসাধু ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে নকল জয়নগরের মোয়া তৈরী হচ্ছে খোদ জয়নগর শহরেই এবং তার পাশাপাশি কলকাতার উপকন্ঠে বজবজ, টালিগঞ্জকালীঘাটে[] সুদৃশ প্যাকেটে এই নকল মোয়া পাড়ি দিচ্ছে দিল্লী, মুম্বই, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ, বেঙ্গালুরুতে। প্রকৃত জয়নগরের মোয়া প্রস্তুতকারীদের মতে নকল জয়নগরের মোয়া স্বাদে আসল জয়নগরের মোয়ার ধারেকাছেও নয়। কিন্তু সস্তা ও সহজলভ্য হওয়ার কারণে এই নকল মোয়া বাজার দখল করে ফেলেছে। এর ফলে সাধারণ ক্রেতারা প্রকৃত জয়নগরের মোয়ার স্বাদ পাচ্ছেন না। তারা নকল মোয়ার নিকৃষ্ট স্বাদের উপর ভিত্তি করেই জয়নগরের মোয়া সম্বন্ধে নিজেদের মতামত তৈরী করছেন যার ফলে প্রকৃত জয়নগরের মোয়ার সুনাম নষ্ট হচ্ছে।[] ক্রেতাকে আসল মোয়া সম্বন্ধে সচেতন করতে ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে বহড়ু হাইস্কুলের মাঠে জয়নগরের মোয়ার মেলা বসে।[] নকল মোয়ার সাথে পার্থক্য বোঝাতে প্রত্যেকটি স্টলে মোয়ার পাশাপাশি কনকচূড় ধানের খই ও নলেন গুড় রাখা হয়।[]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. চক্রবর্তী, মনতোষ (১৪ জানুয়ারি ২০১৩)। "Don't go by flavour, it's not Joynagarer moa"টাইম্‌স্‌ অফ্‌ ইন্ডিয়া। বেনেট কোলম্যান। সংগ্রহের তারিখ ২৬ জানুয়ারি ২০১৬ 
  2. "মোয়ার ঐতিহ্য রক্ষায় কর্মশালা জয়নগরে"আনন্দবাজার পত্রিকা। এবিপি গ্রুপ। ২১ জানুয়ারি ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ২৬ জানুয়ারি ২০১৬ 
  3. মুখোপাধ্যায়, পলাশ। "মনমোহিনী মোয়া"আবেক্ষণ। ২০ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৬ জানুয়ারি ২০১৬ 
  4. "করোনা দাপট রুখে এবারও বিশ্ব-যোগে জয়নগরের মোয়া"। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-২৯ 
  5. "মোয়ার সেকাল, মোয়ার একাল"বেঙ্গল টাইমস। বেঙ্গল টাইমস। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫। ২৮ মার্চ ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৬ জানুয়ারি ২০১৬ 
  6. Mukherji, Udit Prasanna। "Joynagar moa may be patented"। The Times of India, 15 March 2009। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ ডিসেম্বর ২০১৪ 
  7. "Application for registration of a geographical indication by Joynagar Moa Nirmankari Society" (পিডিএফ)। ২০১৬-০৩-০৪ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ ডিসেম্বর ২০১৪ 
  8. "খাঁটি মোয়া"আনন্দবাজার পত্রিকা। এবিপি গ্রুপ। ১৫ জানুয়ারি ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ২৬ জানুয়ারি ২০১৬