চন্দ্রাবতী
চন্দ্রাবতী ষোড়শ শতাব্দী[১] অর্থাৎ মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি মহিলা কবি৷ এই বিদুষী নারী অন্যান্য কাব্য ছাড়াও পিতার আদেশে বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে, মৈমনসিংহ গীতিকার এক কবি নয়ানচাঁদ ঘোষ চন্দ্রাবতী চরিতকথা রচনা করেন।[২]
চন্দ্রাবতী | |
---|---|
জন্ম | ১৫৫০ (আনুমানিক) |
মৃত্যু | ১৬০০ (আনুমানিক) |
পেশা | কবি, শিব সাধিকা |
পরিচিতির কারণ | মলুয়া(কাব্য) দস্যু কেনারামের পালা |
পিতা-মাতা |
|
জন্ম ও পরিবার
সম্পাদনাতার পিতা মনসা মঙ্গল কাব্যের অন্যতম রচয়িতা বংশীদাস ভট্টাচার্য এবং মাতার নাম সুলোচনা বা অঞ্জনা৷ দীনেশচন্দ্র সেনের মতে তিনি আনুমানিক ১৫৫০ সালে জন্মেছিলেন।[৩][৪] নিবাস অধুনা বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার পাতুয়ার বা পাটোয়ারী গ্রামে৷ জীবনকাল ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ। স্বরচিত রামায়ণের ভূমিকায় চন্দ্রাবতী আত্মপরিচয় দিয়েছেন:[২]
“ধারাস্রোতে ফুলেশ্বরী নদী বহি যায়।
বসতি যাদবানন্দ করেন তথায়॥
ভট্টাচার্য্য বংশে জন্ম অঞ্জনা ঘরণী।
বাঁশের পাল্লায় তাল-পাতার ছাউনী॥
... ... ... ..... .... ...... ...... ... .... ...
বাড়াতে দারিদ্র-জ্বালা কষ্টের কাহিনী।
তার ঘরে জন্ম নিলা চন্দ্রা অভাগিনী॥
সদাই মনসা-পদ পূজি ভক্তিভরে।
চাল-কড়ি কিছু পাই মনসার বরে॥
... ... ... ... ... ... .... ... .... .... ....
শিব-শিবা বন্দি গাই ফুলেশ্বরী নদী।
যার জলে তৃষ্ণা দূর করি নিরবধি॥
বিধিমতে প্রণাম করি সকলের পায়।
পিতার আদেশে চন্দ্রা রামায়ণ গায়॥”
সাহিত্যকর্ম
সম্পাদনামৈমনসিংহ গীতিকায় তার নিজের রচিত ‘মলুয়া’ গীতিকাব্যে এবং তার জীবনী অবলম্বনে পরবর্তী সময়কার কবি নয়ানচাঁদ ঘোষ রচিত ‘চন্দ্রাবতী’ পালায় তার কথা পাওয়া যায়৷ তার জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়ে রচিত লোকগাথা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলা সহ গোটা পূর্ববঙ্গের মানুষের মুখে মুখে ফিরে এসেছে৷ তার রচিত রামায়ণ কিছুকাল আগেও ময়মনসিংহ তথা ভাটি-বাংলার মেয়েরা বিবাহ উপলক্ষে গান করতো। চন্দ্রাবতী নিজের কাব্য ছাড়াও পিতা বংশীদাসের মনসামঙ্গল কাব্যের অনেকাংশ রচনা করেছিলেন।
চন্দ্রাবতীর রচিত কাব্যগুলি হল[৩];
- মলুয়া,
- দস্যু কেনারামের পালা (মনসার ভাসান, রচনাকাল: ১৫৭৫ শকাব্দ),
- রামায়ণ(অসমাপ্ত)।
ড. দীনেশচন্দ্র সেন ১৯৩২ সালে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ প্রকাশ করেন। লৌকিক মানবিক ও কিছু মৌলিক উপাদান সংযোগের ফলে এই রামায়ণ কাব্যটি বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। দীনেশচন্দ্রের মতে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার মেঘনাদবধ কাব্যের সীতা-সরমার কথোপকথনের অংশটি ‘চন্দ্রাবতীর রামায়ণ’ থেকে গ্রহণ করেছিলেন।[২][৫]
চন্দ্রাবতীর লোকগাথা
সম্পাদনাবাল্যকালে চন্দ্রাবতীর বন্ধু ও খেলার সাথী ছিলেন জয়ানন্দ[১] বা জয়চন্দ্র চক্রবর্তী নামের এক অনাথ বালক৷ ফুলেশ্বরী নদীর এপারে পাতুড়িয়া পল্লীতে চন্দ্রাবতীর বাস আর জয়চন্দ্রের নিবাস ওপারের সুন্ধা গ্রামে৷ জয়চন্দ্র তার মাতুলগৃহে পালিত৷ দ্বিজ বংশীদাসের অনেক রচনায় এই দুজনার রচিত ছোট ছোট অনেক পদ রয়েছে৷ পুষ্পবনে শিবপূজার ফুল তোলার সময় চন্দ্রার সঙ্গে জয়চন্দ্রের পরিচয় ও শখ্যতা ঘটে। ক্রমশ কৈশোর উত্তীর্ণ হলে দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন বলে স্থির করেন। বিবাহের দিনও স্থির হয়৷ শাস্ত্রবিৎ পণ্ডিত জয়চন্দ্র ইতোমধ্যে অন্য এক রমনীর প্রেমে পড়ে যান৷ স্থানীয় মুসলমান শাসনকর্তা বা কাজীর মেয়ে আসমানীর অসামান্য রূপে মুগ্ধ হয়ে ব্রাহ্মণ জয়চন্দ্র আসমানীকে একাধিক প্রেমপত্র লেখেন৷ এই ত্রিকোণ প্রেমের ফলাফল হয় মারাত্মক৷
আসমানীর পিতা কাজী জয়চন্দ্রকে আসমানীর সঙ্গে তার বিবাহ দিতে সম্মত হন৷ জয়চন্দ্র নিজ ইচ্ছায় হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নিজের নাম পরিবর্তন করে জয়নাল রাখেন। ঘটনাটি ঘটে যেদিন জয়চন্দ্র ও চন্দ্রাবতীর বিবাহের দিন স্থির হয়েছিল সেই দিন৷ সেদিন সন্ধ্যাবেলা চন্দ্রাবতী বিবাহের সাজে পিত্রালয়ে বসে ছিলেন৷ তখনই সংবাদ পেলেন জয়চন্দ্র ধর্মান্তরিত হয়ে অন্যত্র বিবাহ করেছেন৷ ঘটনার আকস্মিকতায় চন্দ্রা হতভম্ব হয়ে পড়েন–
“না কাঁদে না হাসে চন্দ্রা নাহি কহে বাণী।
আছিল সুন্দরী কন্যা হইল পাষাণী॥
মনেতে ঢাকিয়া রাখে মনের আগুনে।
জানিতে না দেয় কন্যা জ্বলি মরে মনে॥”
এরপর শুরু হয় চন্দ্রাবতীর বিরহ-বিধুর জীবন৷ শোকবিহ্বলতা কাটাতে তিনি পিতার কাছে অনুমতি নেন যে সারা জীবন অবিবাহিত থেকে তিনি শিবের সাধনায় আত্মনিবেদন করবেন৷ তার পিতা তার জন্য ফুলেশ্বরী নদীর তীরে একটি শিব মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন৷ সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ শাস্ত্রজ্ঞানী চন্দ্রাবতীর কৈশোরকাল থেকেই ছিল৷ তিনি বাকী জীবন বীতস্পৃহভাবে শান্তমনে শিবের উপাসনা ও সাহিত্যচর্চা করে কাটাবেন বলে স্থির করেন৷ ইতোমধ্যে বেশ কিছুকাল পরে জয়চন্দ্র বুঝতে পারেন যে, আসমানীর প্রতি তার টানটা ছিল মোহ মাত্র৷ মনের থেকে তিনি চন্দ্রাবতীকেই প্রকৃত ভালোবাসেন৷ অনুতপ্ত জয়চন্দ্র স্থির করেন যে চন্দ্রাবতীকে তার মনের কথা জানাবেন৷ তিনি চন্দ্রাবতীকে একটি পত্র লিখে পাঠান,
“শুনো রে প্রাণের চন্দ্রা তোমারে জানাই।
মনের আগুনে দেহ পুড়্যা হইছে ছাই॥
..................... .........................
শিশু কালের সঙ্গী তুমি যৌবন কালের মালা।
তোমারে দেখিতে মন হইয়াছে উতলা॥
..................... .........................
ভাল নাহি বাস কন্যা এ পাপিষ্ঠ জনে।
জন্মের মতন হইলাম বিদায় ধরিয়া চরণে॥
একবার দেখিয়া তোমা ছাড়িব সংসার।
কপালে লিখেছে বিধি মরণ আমার॥”
পত্র পড়ে চন্দ্রাবতীর সংকল্পিত ব্রহ্মচর্য, অবিচলিত সংযম ও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। অশ্রুসিক্ত বদনে তিনি পিতার কাছে বিধান চাইলেন। কন্যার মানসিক শিথিলতা মেটাতে বংশীদাস তাকে সান্ত্বনা দিলেন,
“তুমি যা লইয়াছো মাগো সেই কাজ কর।
অন্য চিন্তা মনে স্থান নাহি দিও আর॥”
জয়চন্দ্রকে পত্রদ্বারা নিষেধ করে চন্দ্রাবতী যোগাসনে বসে মনের সমস্ত অর্গল রুদ্ধ করলেন, তার চোখের জল শুকিয়ে গেল। শিব-ধ্যানে আত্মহারা হয়ে তিনি সমস্ত জাগতিক জ্ঞান লুপ্ত হলেন। [২]
এক সন্ধ্যায় জয়চন্দ্র ও চন্দ্রাবতীর বিচ্ছেদ হয়েছিল; অপর সন্ধ্যায় সেই বিচ্ছেদ মুছে গিয়ে মিলন হবে দুজনার — এই আশায় জয়চন্দ্র রওনা দিলেন পাতুয়ার/পাটোয়ারী গ্রামে৷ জয়চন্দ্র যখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছলেন তখন সূর্যাস্ত হয়ে গেছে, তখন দিন ও রাত্রির সন্ধিক্ষণ৷ শিব মন্দিরের ভেতর দ্বার রুদ্ধ করে সন্ধ্যারতি ও তপজপে নিজেকে নিবদ্ধ করেছেন চন্দ্রাবতী৷ জয়চন্দ্র মন্দিরের দ্বারে এসে কয়েকবার ডাকলেন চন্দ্রাবতীকে৷ কিন্তু দ্বার রুদ্ধ থাকায় এবং একাগ্রমনে ধ্যানে নিমগ্ন থাকায় সেই শব্দ প্রবেশ করল না চন্দ্রাবতীর কানে৷ ব্যর্থ প্রেমিক জয়চন্দ্র তখন লালবর্ণের সন্ধ্যামালতী ফুল দিয়ে মন্দিরের দ্বারে চারছত্রের একটি পদে চন্দ্রাবতী ও ধরাধামকে চিরবিদায় জানিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করেন৷
“শৈশব কালের সঙ্গী তুমি যৌবন কালের সাথী।
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী॥
পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলে সম্মত।
বিদায় মাগী চন্দ্রাবতী জনমের মত॥”
অনেক পরে মন্দির থেকে বেরিয়ে চন্দ্রাবতী বুঝতে পারেন যে দেবালয় কলুষিত হয়েছে৷ দ্বার পরিষ্কার করার জন্য তিনি কলসী কাঁখে জল আনতে যান পার্শ্ববর্তী ফুলেশ্বরী (স্থানীয় নাম ফুলিয়া) নদীতে৷ ঘাটে পৌঁছেই চন্দ্রাবতী বুঝলেন সব শেষ৷ ফুলেশ্বরীর জলে নিজেকে নিমগ্ন করে প্রাণত্যাগ করেছেন জয়চন্দ্র৷ প্রাণহীন দেহ ভাসছে ফুলেশ্বরীর জলে৷ এই অবস্থায় নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না চন্দ্রাবতী৷ তিনিও অচিরে প্রেমিকের সাথে পরলোকে চিরমিলনের কামনায় ফুলেশ্বরীর জলে ডুবে প্রাণত্যাগ করেন।
“একেলা জলের ঘাটে সঙ্গে নাই কেহ।
জলের উপরে ভাসে জয়চন্দ্রের দেহ॥
দেখিতে সুন্দর কুমার চাঁদের সমান।
ঢেউ-এর উপরে ভাসে পৌর্ণ মাসী চাঁদ॥
আঁখিতে পলক নাই! মুখে নাই বাণী।
পারেতে দাঁড়াইয়া দেখে উন্মত্তা কামিনী॥”
জয়চন্দ্রের গ্রাম সুন্ধা খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ তবে ইতিহাসের স্মৃতি বিজড়িত পাতুয়ার/পাটোয়ারী গ্রাম আজও আছে৷ কিশোরগঞ্জ শহর থেকে উত্তর-পূর্ব্ব দিকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে৷ আর আছে ফুলেশ্বরী নদীর ধারে চন্দ্রাবতীর পূজিত শিব মন্দির৷
জন সংস্কৃতিতে চন্দ্রাবতী
সম্পাদনাগীত ও পালা: ষোড়শ শতক হতে ময়মনসিংহে ঘরে ঘরে চন্দ্রাবতীর পালা ও গীত পঠিত হয়েছে। তাঁর রামায়ণ গান পশ্চিমবঙ্গের অনেক স্থানে পঠিত ও মহিলাদের দ্বারা গীত হয়েছে।[৪]
নাটক: কবি নয়ান চাঁদের ‘চন্দ্রাবতী পালা’ অবলম্বনে কুষ্টিয়ার বোধন থিয়েটার ও ঢাকার সংস্কার নাট্যদল ‘চন্দ্রাবতী কথা’ ও ‘গীতি চন্দ্রাবতী’ নামক দুইটি মঞ্চ নাটকে কবি চন্দ্রাবতীর জীবনালেখ্য পরিবেশন করে।[৩][৬]
চলচ্চিত্র: কবি নয়ান চাঁদের ‘চন্দ্রাবতী পালা’ অবলম্বনে এন রাশেদ চৌধুরীর পরিচালনায় ‘চন্দ্রাবতী কথা’ নামক পূর্ণ্যদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।[৭]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ কে এই লোককবি চন্দ্রাবতী, সুস্মিতা চক্রবর্ত্তী, প্রথম আলো, ১২ এপ্রিল ২০১৯, পৃষ্ঠা ৩
- ↑ ক খ গ ঘ বাংলার পুরনারী, দীনেশচন্দ্র সেন, অরুণা প্রকাশন সংস্করণ: ২০১১, কলকাতা - ৭০০০০৯, পৃষ্ঠা: ১২২-১৪১
- ↑ ক খ গ "'গীতি চন্দ্রাবতী'র কথা"। সমকাল। ২০১৯-১০-১০। ২০১৯-১২-০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১২-০৯।
- ↑ ক খ "চন্দ্রাবতী - বাংলাপিডিয়া"। bn.banglapedia.org। ২০১৪-০৫-০৫। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১২-০৯।
- ↑ সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত; বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান; ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭; পৃষ্ঠা-১৫৭।
- ↑ "চন্দ্রাবতীর অমর প্রেমগাথা - কালি ও কলম"। কালি ও কলম। ২০১৭-০১-০৩। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১২-০৯।
- ↑ "কলকাতায় 'চন্দ্রাবতী কথা'র বিশ্ব প্রিমিয়ার"। চ্যানেল আই অনলাইন। ২০১৯-১০-৩০। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১২-০৯।