ঘরজামাই একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারণা, যা বাংলাদেশ এবং ভারতের কিছু অঞ্চলে ব্যবহৃত হয়। এটি সাধারণত স্বামীর পরিবারের বাড়িতে স্ত্রী’র স্বামীকে নির্দেশ করে। এই প্রথাটি বাংলা সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়, যা বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্কের জটিলতা এবং পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন করে। ঘরজামাইয়ের প্রথা প্রাচীন বাংলা সমাজের গঠন ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে বিবেচিত। এটি মূলত পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোর বিরুদ্ধে নারীর অবস্থানকে শক্তিশালী করার একটি উপায় হিসেবেও বিবেচিত। ঐতিহ্যগতভাবে, স্ত্রী’র পরিবারের দিকে স্বামীর দৃষ্টি ও দায়িত্ব বৃদ্ধি করে। এই প্রথার মাধ্যমে নারীর পরিবারে স্বামী থাকলে সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধি পায় এবং সামাজিক বন্ধনকে শক্তিশালী করে।[][][]

ব্যুৎপত্তি

সম্পাদনা

শব্দটি ঘরজামাই দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত : ঘর এবং জামাইঘর শব্দটি সংস্কৃত শব্দ গৃহ (गृह)[] থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যার অর্থ 'বাড়ি', এবং জামাই শব্দটি সংস্কৃত শব্দ জামাতৃ[] (जामातृ) থেকে এসেছে, যার অর্থ 'জামাই'। সুতরাং, ঘরজামাই বলতে বোঝায় এমন জামাই যিনি স্ত্রীর বাড়িতে বাস করেন।

সংজ্ঞা

সম্পাদনা

একজন ব্যক্তি যিনি তার স্ত্রীর বাড়িতে বাস করেন তাকে ঘরজামাই বলা হয়। সাধারণত তিনি স্ত্রীর পরিবারের সাথে বসবাস করেন বা তাদের উপর নির্ভরশীল থাকেন।[][][] ভারতীয় সমাজে এই শব্দটি একটি সামাজিক কলঙ্ক বহন করে, কারণ ঐতিহ্যগতভাবে স্বামীকে পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করতে হয় এবং স্ত্রীর পরিবারের উপর নির্ভর করা নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। আধুনিক ব্যবহারে, জামাইয়ের আর্থিক অবস্থাও বিবেচনায় নেওয়া হয়; উদাহরণস্বরূপ, যদি জামাই জমি বা অন্য সম্পত্তির মালিক হন, তাহলে তাকে ঘরজামাই বলে বিবেচনা করা হয় না। বিভিন্ন সংজ্ঞা বিদ্যমান। এই বিষয়ে সিরিয়াস ও হালকা-চিত্তের চলচ্চিত্র ও টিভি ধারাবাহিকও তৈরি হয়েছে।[]

সামাজিক প্রভাব

সম্পাদনা

ঘরজামাইয়ের মাধ্যমে নারীর সামাজিক অবস্থানকে উন্নীত করা হয়। এতে স্বামী তার স্ত্রী’র পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করেন এবং স্ত্রী’র পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়।[১০] ঘরজামাই হওয়ার ফলে পণ ও অর্থনৈতিক সুবিধার বিষয়টি আরও জটিল হয়ে ওঠে। এটি পরিবারগুলির মধ্যে আর্থিক সহযোগিতা এবং সম্পর্কের ভিত্তিতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। এই প্রথা নারীর পরিবারের প্রতি স্বামীর দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি করে, যা সমাজে পরিবর্তন ও উন্নতির একটি সূচক। এটি মহিলাদের পরিবারের প্রতি সামাজিক সম্মানের উদাহরণ হিসেবে কাজ করে। বাংলা সাহিত্য, গান, এবং লোককাহিনীতে ঘরজামাইয়ের উল্লেখ ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়। এটি বিভিন্ন কবি ও সাহিত্যিকদের কাজে ফুটে উঠেছে, যেখানে সামাজিক সম্পর্ক, প্রেম, এবং পারিবারিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, অনেক গান ও নাটকে এই প্রথার মাধ্যমে পরিবারিক মূল্যবোধ এবং সামাজিক সংঘাত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।[১১]

পারিবারিক দ্বন্দ্ব

সম্পাদনা

কিছু পরিবারে ঘরজামাইকে সমান গুরুত্ব দেয়া হয় না, যা নারীর অবস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে, যদি পরিবারটি পুত্রের পরিবারকে বেশি গুরুত্ব দেয়। ঘরজামাইয়ের চাপ স্বামীদের উপর মানসিক চাপ, স্বামীদের মধ্যে কখনও কখনও আত্মবিশ্বাসের অভাব, কখনও কখনও এই প্রথা পরিবারে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।[১২]

আধুনিক প্রেক্ষাপটে যুগে, ঘরজামাইয়ের প্রথার মধ্যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আধুনিক সমাজে, অনেক যুবক এই প্রথাকে গ্রহণ করতে ইতস্তত হতে পারে, এবং স্বামী-স্ত্রীর সমতা ও স্বাধীনতার ধারণা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে, ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এখনও এই প্রথার গুরুত্ব রয়েছে এবং এটি সংস্কৃতির একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।[১৩]

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে

সম্পাদনা

চলচ্চিত্র

সম্পাদনা
বছর ভাষা চলচ্চিত্র অভিনেতা
১৯৫৯ তেলুগু ইললারিকাম আক্কিনেনি নাগেশ্বর রাও
১৯৬১ হিন্দি সসুরাল রাজেন্দ্র কুমার
১৯৬৫ তামিল কুঝান্দাইয়ুম দেইবামুম জয়শংকর
১৯৬৬ তেলুগু লেটা মনাসুলু হরণাথ
১৯৬৭ হিন্দি রাম অউর শ্যাম প্রাণ
১৯৬৮ হিন্দি দো কলিয়ান বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়
১৯৬৮ হিন্দি আশীর্বাদ অশোক কুমার
১৯৬৮ হিন্দি নীল কমল মেহমুদ
১৯৬৯ হিন্দি ধরতি কহে পুকার কে সঞ্জীব কুমার
১৯৬৯ হিন্দি পয়সা ইয়া প্যার বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়
১৯৭৩ হিন্দি ফাগুন ধর্মেন্দ্র
১৯৭৪ মালায়ালম সেতুবন্ধনাম প্রেম নাজির
১৯৭৪ হিন্দি বিদাই জিতেন্দ্র
১৯৭৬ কন্নড় মাক্কালা ভাগ্য বিশ্ণুবর্ধন
১৯৭৬ হিন্দি তপস্যা অসরানি
১৯৮১ হিন্দি নাখুদা রাজ কিরণ
১৯৮২ হিন্দি দুলহা বিকতা হ্যায় রাজ বব্বর
১৯৮২ হিন্দি খুদ-দার বিনোদ মেহরা
১৯৮২ হিন্দি কামচোর সুরেশ ওবেরয়
১৯৮৩ হিন্দি রিশতা কাগজ কা সুধীর
১৯৮৩ হিন্দি অভতার গুলশন গ্রোভার
১৯৮৩ হিন্দি মজদুর রাজ বব্বর
১৯৮৬ হিন্দি পিছু কারো ফারুক শেখ
১৯৮৭ হিন্দি প্যার কে কাবিল ঋষি কাপুর
১৯৮৮ হিন্দি বিবি হো তো অ্যাসি কাদের খান
১৯৮৯ তেলুগু আটাকু ইয়ামুদু আম্মাইকি মোগুডু চিরঞ্জীবী
১৯৮৯ হিন্দি জয়সি কারনি ওয়াইসি ভার্নি শক্তি কাপুর
১৯৮৯ হিন্দি বিল্লু বাদশাহ সুমিত সাইগাল
১৯৮৯ হিন্দি চাঁদনী অনুপম খের
১৯৮৯ তামিল মাপ্পিল্লাই রজনীকান্ত
১৯৯০ হিন্দি ঘর হো তো অ্যাসা কাদের খান
১৯৯০ হিন্দি জামাই রাজা অনিল কাপুর
১৯৯২ হিন্দি ঘর জামাই মিঠুন চক্রবর্তী
১৯৯৩ হিন্দি আসু বানে অঙ্গারেয় অনুপম খের
১৯৯৪ হিন্দি লাডলা অনিল কাপুর
১৯৯৬ হিন্দি সৌতেলা ভাই রাজ বব্বর
১৯৯৬ হিন্দি নমক প্রীতম ওবেরয়গুলশন গ্রোভার
১৯৯৭ হিন্দি ইয়েস বস আদিত্য পাঁচোলি
১৯৯৮ বাঙালি জামাই নং. ১ রঞ্জিত মালিক
২০০০ হিন্দি বেটি নং. ১ প্রেম চোপড়া
২০০১ হিন্দি জুবেইদা বিনোদ শরওয়াত
২০০১ হিন্দি এক রিশতা: দ্য বন্ড অফ লাভ মনীষ বেহল
২০০১ হিন্দি লাভ কে লিয়ে কুছ ভি করেগা সাইফ আলী খান
২০০১ হিন্দি কিউ কি... মাই ঝূত নেহি বোলতা শরদ কাপুর
২০০৮ বাঙালি ঘর জামাই প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়
২০০৯ হিন্দি চল চলে চল অসরানিমনোজ যোশী
২০০৯ হিন্দি এক: দ্য পাওয়ার অফ ওয়ান জসপাল ভাট্টিসঞ্জয় মিশ্র
২০১০ পাঞ্জাবি ইক কুড়ি পাঞ্জাব দি আমরিন্দর গিল
২০১৩ পাঞ্জাবি লাকি দি আনলাকি স্টোরি বিন্নু ঢিল্লন
২০১৬ হিন্দি কি অ্যান্ড কা অর্জুন কাপুর
২০১৯ পাঞ্জাবি মুন্ডা হি চাইদা রবি অঞ্জা
২০১৯ হিন্দি ঝূঠা কহিন কা ওমকার কাপুর
২০১৯ হিন্দি ঝূঠা কহিন কা ওমকার কাপুর
২০১৯ হিন্দি বালা সৌরভ শুক্লা
২০২০ পাঞ্জাবি জান তো পিয়ারা ডেপুটি রাজা
২০২০ হিন্দি গুলাবো সিতাবো অমিতাভ বচ্চন
২০২৩ হিন্দি শেহজাদা রনিত রায়
২০২৩ পাঞ্জাবি জি ওয়াইফ জি কারমজিৎ অমললাকি ধালিরোশন প্রিন্স
২০২৩ হিন্দি কাঠাল ধীরেন্দ্র কুমার তিওয়ারি
২০২৩ পাঞ্জাবি ক্যারি অন জাট্টা ৩ বিন্নু ঢিল্লন
২০২৩ পাঞ্জাবি কড়ে দাদে দিয়া কড়ে পোটে দিয়া সুখবিন্দর চাহাল
২০২৩ হিন্দি ড্রাই ডে জুনেদ

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Bandyopadhyay, Bandyopadhyay (২০০২)। Bengali Folk Culture: An Introduction. Kolkata। Gyan Publishing House - 2006: Sahitya Akademi। আইএসবিএন 9788121209113 
  2. Sarkar, R. (২০১০)। Women and Society in Bengal: A Historical Perspective। Delhi: Primus Books। আইএসবিএন 978-93-80560-16-9 |আইএসবিএন= এর মান পরীক্ষা করুন: checksum (সাহায্য) 
  3. Dasgupta, R. (২০১৫)। Cultural Practices in Bengal: Gender and Identity। New Delhi: Oxford University Press। আইএসবিএন 978-0-19-946231-0 |আইএসবিএন= এর মান পরীক্ষা করুন: checksum (সাহায্য) 
  4. Platts, John T. (John Thompson) (১৮৮৪)। "A Dictionary of Urdu, Classical Hindi, and English"dsal.uchicago.edu। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-১৬ 
  5. McGregor, R. S. (Ronald Stuart) (১৯৯৩)। "The Oxford Hindi-English dictionary"dsal.uchicago.edu। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-১৬ 
  6. Mayer, Adrian C. (১৯৯৮)। Caste and Kinship in Central India (ইংরেজি ভাষায়)। Psychology Press। পৃষ্ঠা 221–222। আইএসবিএন 9780415175678 
  7. Sengupta, Nirmal (১৯৭৯)। "Destitutes and Development: A Study of the Bauri Community in the Bokaro Region" 
  8. Commissioner, India Census (১৯৩৩)। Census of India, 1931 (ইংরেজি ভাষায়)। Manager of Publications। পৃষ্ঠা 113। 
  9. ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেজে Ghar Jamai: 1935   (ইংরেজি)
  10. Bandyopadhyay, Sudipta (২০০২)। Bengali Folk Culture: An Introduction। Kolkata: Sahitya Akademi। আইএসবিএন 978-81-260-0517-0 |আইএসবিএন= এর মান পরীক্ষা করুন: checksum (সাহায্য) 
  11. "Folk Culture of West Bengal"Institute of Landscape, Ecologh & Ekistics, Kolkata। সংগ্রহের তারিখ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ 
  12. Chatterjee, Partha (২০০৪)। The Nation and Its Fragments: Colonial and Postcolonial Histories। Princeton University Press। আইএসবিএন 978-0-691-11363-0 
  13. Basu, Parveen (২০১১)। Gender and the Politics of Community: Muslim Women in India। New Delhi: Routledge। আইএসবিএন 978-0-415-58483-1 |আইএসবিএন= এর মান পরীক্ষা করুন: checksum (সাহায্য)