গোলাহাট গণহত্যা
এই নিবন্ধ অথবা অনুচ্ছেদটি অপারেশন খরচাখাতা নিবন্ধের সাথে একত্রিত করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। (আলোচনা করুন) |
গোলাহাট গণহত্যা ছিল বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১৩ জুন তারিখে সংগঠিত একটি নৃশংস হত্যাযজ্ঞ যাতে ৪৪৭ জন হিন্দু মারোয়াড়ি আবালবৃদ্ধবণিতাকে নির্বিচারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী অবাঙ্গালী বিহারী ও বাঙ্গালি রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনী সম্মিলিতভাবে হত্যা করে।[১][২]
গোলাহাট গণহত্যা | |
---|---|
স্থান | গোলাহাট, সৈয়দপুর, নীলফামারী জেলা,রংপুর বিভাগ, বাংলাদেশ |
স্থানাংক | ২৫°৪৮′২১″ উত্তর ৮৮°৫২′৫৮″ পূর্ব / ২৫.৮০৫৮৩° উত্তর ৮৮.৮৮২৭৮° পূর্ব |
তারিখ | ১৩ জুন ১৯৭১ সকাল ১০ ঘটিকা (ইউটিসি+৬:০০) |
লক্ষ্য | বাঙ্গালী হিন্দু, মারোয়াড়ি হিন্দু |
হামলার ধরন | গণহত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, লুটপাট |
ব্যবহৃত অস্ত্র | রাম দা দিয়ে গর্দান, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে |
নিহত | ৪৪৭ জনের অধিক |
হামলাকারী দল | পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, বিহারী মুসলমান, রাজাকার, আলবদর, আল শামস |
পটভূমি
সম্পাদনারংপুর বিভাগের অধিভুক্ত সৈয়দপুর একটি রেলওয়ে টাউন এবং ব্যবসায়কেন্দ্র। আগে এটি নীলফামারী জেলার অন্তর্গত ছিল। অবিভক্ত ভারতবর্ষে পার্বতীপুর রেলওয়ে জংশনের উত্তরপূর্বাঞ্চলের সাথে যোগাযোগের প্রধান সংযোগস্থল ছিল। ব্যবসায়-বাণিজ্যের সুবিধার জন্য এ অঞ্চল তাই মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভারত বিভাগের পূর্ব থেকেই তারা এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। তারা স্থানীয় মানুষের সাথে বসবাস করে সেখানকার স্থানীয় হয়ে যায় এবং অনেকেই বিভিন্ন জনহিতকর কাজের কারণে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে। যেমনঃ মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী তুলসিরাম আগারওয়াল তুলসিরাম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।[৩] ১৯৪৭ তে ব্রিটিশ ভারত বিভাগের পরে মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ মানুষ ভারতে চলে যেতে বাধ্য হলেও অনেকেই থেকে যায়। যুক্তপ্রদেশ এবং বিহার থেকে আগত উর্দুভাষী মুসলামানেরা সৈয়দপুর শহরে এসে বসবাস শুরু করে। এরা ছিল শহরবাসীর প্রায় ৭৫ শতাংশ।[৪]
ঘটনা
সম্পাদনাবাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উর্দুভাষী মুসলমানরা সরাসরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে। এজন্য সৈয়দপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বড় সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়। ১৯৭১-এর ১২ এপ্রিলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাহিনী পরিকল্পিতভাবে রংপুর সেনানিবাসের অদূরে বিখ্যাত তুলসিরাম আগারওয়াল, যমুনাপ্রসাদ কেরিয়া, রামেশ্বরলাল আগারওয়ালকে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ড মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের মাঝে তীব্র আতঙ্কের সৃষ্টি করে। উর্দুভাষী বিহারীরা মাড়োয়ারিদের বাড়িঘর, দোকান, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান লুটপাট শুরু করে।[৩]
১৯৭১ সালের ১৩ জুন, সকাল ১০টা। সৈয়দপুর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিল একটি ট্রেন। কিছুদিন ধরে সৈয়দপুর শহরে, পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষ থেকে মাইকে বলা হচ্ছিল, শহরে যেসব হিন্দু মাড়োয়ারি আটকা পড়ে আছেন, তাঁদের নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দেওয়া হবে। এ জন্য একটা বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ট্রেনটি সৈয়দপুর রেলস্টেশন থেকে ভারতের শিলিগুড়ির উদ্দেশে ছেড়ে যাবে।
৪৬ বছর পর শ্যামলাল আগরওয়ালার বর্ণনা মতে, মাইকে ঘোষণা শুনে যুদ্ধে লুটতরাজের হাত থেকে তখনও যা কিছু সম্বল বেঁচে গিয়েছিল, তা-ই গোছাতে শুরু করে দেন মাড়োয়ারিরা। ১৩ জুন সকালে তাঁরা সমবেত হতে থাকেন সৈয়দপুর রেলস্টেশনে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো বিশেষ ট্রেনে, গাদাগাদি করে সবাই ট্রেনে উঠেন।
হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী তপন কুমার দাস বর্ণনা মতে, ঠিক সকাল ১০টার দিকে স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় ট্রেনটি। চলছিল ধীরে ধীরে। শহর থেকে বেরিয়ে রেলওয়ে কারখানা পেরিয়েই হঠাৎ থেমে যায় ট্রেন। জায়গাটা স্টেশন থেকে দুই মাইল দূরে। নাম গোলাহাট। ট্রেন থামার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেন তপন। বাইরে সারি সারি পাকিস্তানি হানাদার সেনা। সঙ্গে তাঁদের দোসর বিহারিরা। সেনা সদস্যদের হাতে রাইফেল। আর বিহারিদের হাতে ধারালো রামদা।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী গোবিন্দ চন্দ্র দাসের বর্ণনা মতে, ‘থেমে থাকা ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে ঢুকেই পাকিস্তানি সেনারা চিৎকার করে উর্দুতে বলতে থাকেন, একজন একজন করে নেমে আসো। তোমাদের মারতে এসেছি আমরা। তবে পাকিস্তানের দামি গুলি খরচ করা হবে না। সকলকে এ কোপে বলি দেওয়া হবে।’ সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় বেপরোয়া হত্যাযজ্ঞ। ধারালো রামদা দিয়ে কেটে ফেলা গলা। ওই হত্যাযজ্ঞে শিশু, বৃদ্ধ, নারীরাও রেহাই পাননি। বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়, ওই ট্রেন হত্যাযজ্ঞে ৪৪৮ জনকে একে একে রামদা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
গোলাহাট গণহত্যায় নিহতদের সংখ্যা নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা এবং প্রথম আলো অনুসারে, এই গণহত্যায় ৪৩৭ জন হিন্দু নিহত হয়।[৩] তবে শর্মিলা বসু ৩৩৮ জনের কথা উল্লেখ করেছেন, তিনি সাইদপুরের মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী দ্বারকা প্রসাদ সিংহানিয়ার একটি বর্ণনা থেকে তা উদ্ধৃত করেন।[৫] যারা ট্রেনে উঠেছিল তাদের মধ্যে মাত্র দশজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। তারা দৌড়ে দিনাজপুরের দিকে চলে যায় এবং ভারতে আশ্রয় নেয়।
স্মৃতি স্মারক
সম্পাদনা২০১৪ সালের জুন মাসে গোলাহাটের বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিসৌধ উন্মোচন করা হলেও সেটির কাজ সমাপ্ত হয়নি।[৬][৭] কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তাঁর ট্রেন উপন্যাসে সৈয়দপুরের গোলাহাট বধ্যভূমি ও ট্রেন ট্র্যাজেডির নির্মম বর্ণনা তুলে ধরেছেন।
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ আলম, এম আর (১১ মার্চ ২০১৭)। "সৈয়দপুরে ট্রেন থামিয়ে শত শত মাড়োয়ারি হত্যা"। দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুন ২০২৪।
- ↑ ইসলাম, মামুন (৫ ডিসেম্বর ২০১১)। গোলাহাটের নৃশংসতম গণহত্যা : যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আশায় ৪৩৭ শহীদের স্বজনরা ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১৭-০৯-১৫ তারিখে
- ↑ ক খ গ আলম। অপারেশন খরচাখাতা। প্রথম আলো। ১৮ জুন ২০১০।
- ↑ "Welcome to Saidpur"। saidpurbd.com। ২৮ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১২।
- ↑ Sarmila Bose (২০১১)। Dead Reckoning: Memories of 1971 Bangladesh War (English ভাষায়)। Services Book Club, GHQ, Rawalpindi.। পৃষ্ঠা 138।
- ↑ "সৈয়দপুরে ট্রেন থামিয়ে শত শত মাড়োয়ারি হত্যা"। সংগ্রহের তারিখ ১২ জুন ২০১৭।
- ↑ "গোলাহাটে বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন"। BanglaNews24.com। সংগ্রহের তারিখ ১২ জুন ২০১৭।