কৃত্তিবাসী রামায়ণ
কৃত্তিবাসী রামায়ণ বা শ্রীরাম পাঁচালী হলো চতুর্দশ শতাব্দীর বাঙালি কবি কৃত্তিবাস ওঝা কর্তৃক বাংলা ভাষায় অনূদিত একটি রামায়ণ।[১] কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এটি পাঁচালীর আকারে পয়ার ছন্দে রচিত এবং মূল সংস্কৃত রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ নয়। উপরন্তু কৃত্তিবাস রামায়ণ-বহির্ভূত অনেক গল্প এই অনুবাদে গ্রহণ করেছিলেন। তদুপরি, তিনি বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানা অনুষঙ্গের প্রবেশ ঘটিয়ে তিনি বাল্মীকি-রামায়ণ উপাখ্যানের বঙ্গীয়করণ করেন, যা অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত বাল্মিকী রামায়ণ অপেক্ষা ভিন্ন। যেমন রামায়ণের মূল রচয়িতা বাল্মিকী তাঁর রচনায় রামচন্দ্রকৃত দুর্গাপূজার কথা উল্লেখ করেন নি, এমনকি রামায়ণের অন্য কোনো অনুবাদেও তা দেখা যায় না। কিন্তু কৃত্তিবাস ওঝা তার রামায়ণে এটি কোনো তথ্যসূত্র ছাড়াই উল্লেখ করেন। এছাড়াও তিনি রামায়ণের চরিত্রগুলো তৎকালীন সাধারণ বঙ্গীয় সমাজের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন, যা বাল্মিকী রামায়ণে বর্ণিত একই চরিত্রের সাথে একই রকম নয়।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ | |
---|---|
শ্রীরামপাঁচালী | |
সম্পূর্ণ নাম | শ্রীরামপাঁচালী |
অপর নাম | কৃত্তিবাসী রামায়ণ |
রচয়িতা | কৃত্তিবাস ওঝা |
পৃষ্ঠপোষক | "গৌড়েশ্বর" |
ভাষা | বাংলা |
রচনাকাল | খ্রিস্টীয় ১৪শ-১৫শ শতাব্দী |
রচনাস্থল | ফুলিয়া গ্রাম (অধুনা নদিয়া জেলা, পশ্চিমবঙ্গ) |
পুথি | বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পুথি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুথি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুথি, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পুথি |
প্রধান পুথি | কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুথি (সংখ্যা২০৮) |
প্রথম মুদ্রিত সংস্করণ | ১৮০২ |
বর্গ | মধ্যযুগীয় বাংলা অনুবাদ সাহিত্য, ভাবানুবাদ |
Verse form | পয়ার ও ত্রিপদী |
বিষয় | রামায়ণ |
Setting | প্রাচীন ভারত |
চরিত্র | রাম, লক্ষ্মণ, সীতা, রাবণ, বিভিষন,অঙ্গদ,সুষেন, সুগ্ৰীব,ওহিরাবন,মহিরাবন,ধুম্র,ধুমাষ্ম,অকম্পন,তরনী সেন,প্রহস্থ,দেবান্তক,নরান্তক,এশিরা,অতিকায়,নল,নীল,কুম্ভ,নিকুম্ভ,হনুমান |
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, এই কাব্যে "প্রাচীন বাঙালি সমাজই আপনাকে ব্যক্ত করিয়াছে।" বাঙালি সমাজে এই বইটি ব্যাপক জনপ্রিয় এবং বাংলার ঘরে ঘরে পঠিত। কয়েক শতাব্দী ধরে বইটি নানাভাবে পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে। ১৮০২ সালে উইলিয়াম কেরির প্রচেষ্টায় শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে কৃত্তিবাসী রামায়ণ প্রথম পাঁচ খণ্ডে মুদ্রিত হয়। এরপর ১৮৩০-৩৪ সালে জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় দুখণ্ডে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বর্তমানে কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রাপ্ত মোট ২,২২১ টি হস্তলিখিত পুঁথি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত রয়েছে।[২]
বৈশিষ্ট্য ও অনন্যতা
সম্পাদনাআক্ষরিক অনুবাদ নয় ভাবানুবাদ মাত্র
সম্পাদনামহর্ষি বাল্মিকী রচিত সংস্কৃত "রামায়ণের" একটি অনুবাদ মূলক গ্রন্থ হল কবি কৃত্তিবাস ওঝার "শ্রীরাম পাঁচালী"। তবে এই অনুবাদ হুবহু অনুবাদ ছিল না এটা ছিল মূলত ভাবানুবাদ মাত্র। আর এর উদাহরণ দিতেই কবি লিখেছেন-
"সাত কান্ড রামায়ণ, দেবেরা সৃজিত।
লোক বুঝাইতে কহিলো, কৃত্তিবাস পণ্ডিত।।"
রামচন্দ্র বীর নয় নবরূপী রামায়ণ
সম্পাদনাআসল রামায়ণের বাল্মিকী যেখানে রামচন্দ্রকে সর্বগুণ সম্পন্ন আদর্শ বীর হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু কৃত্তিবাস রামচন্দ্রকে একজন নবরূপী রামায়ণ হিসেবে উপস্থাপন করেছে, যেখানে রামচন্দ্র শুধু ভক্তের ভগবানই নয় সমস্ত বানর সেনার প্রতিও সে সহানুভূতিশীল। তাই কৃত্তিবাস ওঝা সেখানে বলেছেন-
"তুমি ব্রহ্মা তুমি শিব তুমি নারায়ণ।
সৃষ্টি ষ্মিতি প্রলয়ের তুমি যে কারন।।"
ইন্দ্রজিৎ মৃত্যুর পর রাবণের বিলাপ অংশের মৌলিকতা বা অনন্যতা
সম্পাদনাআসল রামায়ণের সেখানে ইন্দ্রজিৎ মারা গেলে রাবণ হতাশায় জর্জরিত হয়ে পড়ে, সেখানে কৃত্তিবাসী রামায়ণে রাবণ প্রথমে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন পরে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন -
"দূতমুখে শুনে ইন্দ্রজিতের মরণ।
সিংহাসন হইতে পড়ে রাজা দশানন।।"
শাক্ত ও বৈষ্ণব ভাবাদর্শের ছায়াপাত
সম্পাদনামূল বাল্মীকি রামায়ণে রাম দেবতা নন — তিনি দেবোপম পুরুষোত্তম, মানুষী শক্তি ও বজ্রকঠোর বীর্যসত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণে রামচন্দ্র সকলের আরাধ্য অবতার, তুলসীচন্দনে লিপ্ত দেববিগ্রহ। তিনি কোমল করের ইঙ্গিতে সৃষ্টি-স্থিতি-সংহার করতে পারেন; বংশীধারী কৃষ্ণের মতই তাঁর চক্ষু প্রেমাশ্রুপূর্ণ। এই কাব্যের পুথিগুলিতে রাম ও রাবণের ভীষণ যুদ্ধস্থলকে গৈরিক-রেণু-রঞ্জিত হরিনাম সংকীর্তনভূমি বলে ভ্রম হয় এবং যুদ্ধের দামামা-রোল মাঝে-মাঝে বৈষ্ণব খোল-করতালের মৃদুতা গ্রহণ করে। এইভাবে সংস্কৃত রামায়ণ পরিবর্তিত হয়ে শাণিত তলোয়ারের চেয়ে বাঙালি ঘরের নয়নাশ্রুর প্রভাবশীল অস্ত্রের উপযোগী হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বস্তুত, কৃত্তিবাসী রামায়ণে বাংলার শাক্ত ও বৈষ্ণব পরম্পরার দ্বন্দ্ব অনন্যভাবে ফুটে উঠেছে; উভয় লিপিকরদলের পরিমার্জনা কাব্যটিকে বিভিন্ন রসে পুষ্ট করেছে। বৈষ্ণব লিপিকরগণ তরণী সেন, বীরবাহু প্রভৃতি রাক্ষসবীরদের দ্বারা বৈষ্ণবীয় ভক্তিতে রামচন্দ্রের স্তবগান করিয়েছেন; অপরদিকে শাক্ত লিপিকরগণ যুদ্ধজয়ের নিমিত্ত (কমলাক্ষ রামের 'কমল-আঁখি'র উৎসর্গ দ্বারা দেবী দুর্গা কর্তৃক লুক্কায়িত নীলপদ্মের স্থল পূর্ণ করে) শ্রীরামকে দিয়ে 'অকাল-বোধন' চণ্ডীপূজা করিয়েছেন। এভাবে মূল-অনুবাদটি বর্তমান আকারে পরিণত হয়েছে।
প্রতিপক্ষের প্রতি যুদ্ধক্ষেত্রে ভূপতিত হয়ে রাক্ষস বীরবাহুর বিনীত "অকিঞ্চনে দয়া কর রাম রঘুবর" এবং রাক্ষসশ্রেষ্ঠ দশানন রাবণের "অপরাধ মার্জ্জনা করহ দয়াময়" উক্তিতে বাংলার কৌপিনসার শিখাযুক্ত বৈষ্ণবভক্তের রূপ প্রতীয়মান হয়। বিভীষণপুত্র তরণীসেন রামনামের অঙ্গশোভা করে বৈরাগীর সাজে যুদ্ধে গমন করেন এবং বিপক্ষ যোদ্ধা রামচন্দ্রের শরীরে ভগবানের বিশ্বরূপ অবলোকন করেন। সমাগত যুদ্ধার্থীর ভক্তিতে রাম-লক্ষ্মণও শ্রীচৈতন্য-নিত্যানন্দের মতো বৈষ্ণবোচিত বিনয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে অশ্রুপাত করতে থাকেন। মনে করা হয়, রামায়ণের এইসব পরিবর্তন তখনকার বঙ্গীয় সমাজজীবনের প্রকৃতি (বৈষ্ণব-নীতি) অনুসারেই সংঘটিত হয়েছিল।
তবে মূল বাল্মীকি রামায়ণের প্রতিধ্বনিও কাব্যটির বিভিন্ন পুথিতে অল্পবিস্তর শ্রুত হয়, যেমন:
সর্ব্ব সুলক্ষণ যার হয় অধিষ্ঠান।
হিংসার ঈষৎ নাই, চন্দ্র সূর্যের সমান।
ইন্দ্র যম বায়ু বরুণ যেই বলবান।
ত্রিভুবনে নাই কেহ তাহার সমান।
রাম ও লক্ষ্মণের সৌহার্দ্য, কৌশল্যার শোকসন্তাপ, ক্ষাত্রতেজ ও ব্রহ্মচর্যের চেয়ে সীতার গৃহবধূর মত লজ্জাবনত মাধুরী — রামায়ণের কৃত্তিবাসী অনুবাদেই অধিকতর সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে।[৩]
বিদেশী উপাখ্যানের সঙ্গে সাদৃশ্য
সম্পাদনাদ্বাদশ শতকে ইউরোপ-এ প্রচলিত অনেক লোকায়ত আখ্যানের সাথে কৃত্তিবাসী রামায়ণের কোনও কোনও কাহিনির মিল পাওয়া যায়, যা বাল্মীকি রামায়ণের মধ্যে দৃষ্ট হয় না।
গেলিক উপাখ্যানের দৈত্য বা অপদেবতা Balor-এর মতই বাংলা রামায়ণের ভস্মলোচন এক চোখ সর্বদা ঠুলি দিয়ে ঢেকে রাখত এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ঠুলি খুলে শত্রুর দিকে তাকিয়ে তাকে ভস্ম করে দিত। আরেক গেলিক কাহিনির King Lludd-এর রাজ্যের এক চোর ছিল, যে কৃত্তিবাসী রামায়ণের মহীরাবণের মতই মন্ত্রবলে সব লোককে নিদ্রাভিভূত করতে পারত।[৪]
প্রভাব
সম্পাদনাষোড়শ শতকে ভক্তকবি তুলসীদাস রচিত হিন্দি রামায়ণ রামচরিতমানস-এর সৃজনে এই কাব্যটির ভক্তিরসাত্মক ব্যঞ্জনা বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছে। তাছাড়া, কৃত্তিবাস ওঝা প্রণীত এই রামকথা পরবর্তীযুগের কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাই মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছিলেন-
"কৃত্তিবাস, কীর্তিবাস কবি এ বঙ্গের অলংকার"
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিতকুমার। "বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত"। পৃষ্ঠা 493–494। সংগ্রহের তারিখ ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪।
- ↑ p.82. Paschimbanga, Gazette of the Information and Cultural Affairs Department, Government of West Bengal, Krittibas Memorial Issue, February 2006
- ↑ দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, প্রথম খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা-১৩, প্রকাশ: ১৯৮৬, পৃষ্ঠা: ১৩৪-১৩৯
- ↑ দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, প্রথম খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা-১৩, প্রকাশ: ১৯৮৬, পৃষ্ঠা: ১৪০