মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, কলকাতা
মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, কলকাতা বা কলকাতা মাদ্রাসা (১৭৮০-২০০৮) উপমহাদেশের ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।[১] মাদ্রাসাটি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা নামেই অধিক পরিচিত ছিলো, তবে মাদ্রাসাটির প্রাতিষ্ঠানিক নাম ছিলো কলকাতা মোহামেডান কলেজ।[২][৩] ১৭৮০ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক কলকাতা মোহামেডান কলেজ নামে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়, সাথে সাথে উপমহাদেশে নতুন আধুনিক ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে এই মাদ্রাসার অনুকরণে ভারত ও বাংলাদেশে হাজার হাজার আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।[৪] তবে পরবর্তীতে মাদ্রাসাটি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা নামে পরিচিতি লাভ করে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০৭ অনুযায়ী মাদরাসাটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়।[৫]
পরবর্তী | আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৭ |
---|---|
বিভাজন | মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা ১৯৪৭ |
সক্রিয় | ১৭৮০ | –২০০৭
অবস্থান | , , |
মাদ্রাসাটির শিক্ষা কার্যক্রম তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার পরিচালিত ভারতে রাষ্ট্রীয়-ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হতো। এই মাদ্রাসায় শুরুতে দারসে নিজামিয়া শিক্ষা পদ্ধতি অনুকরণ করে পাঠদান করা হতো। ১৭৮০ থেকে ১৮৫৩ সাল পর্যন্ত পাঠাদানে ফার্সি ভাষার প্রাধান্য ছিলো, এরপরে ধীরে ধীরে ইংরেজির প্রভাব বাড়তে থাকে। পাঠ্য সিলেবাসের মধ্যে কুরআন-হাদিসের সার্বিক বিষয়ের পাশাপাশি ইউক্লিডয় গণিত ও জ্যামিতি, এরিস্টটলের পুরনো দর্শন, যুক্তিবিদ্যা প্রভৃতি পড়ানো হতো।[৬]
ইতিহাস
সম্পাদনা১৭৮০-১৮৫০, প্রাথমিক অবস্থা
সম্পাদনা১৭৮০[৭] মতান্তরে ১৭৮১[৮] সালের অক্টোবর মাসে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করে। কলকাতার শিয়ালদাহের নিকটস্থ বউবাজার অঞ্চলের বৈঠকখানায় এই মাদ্রাসার সূত্রপাত হয়। দীর্ঘ ৪৭ বছর পর, ১৮২৭ সালে মাদ্রাসাটি এর বর্তমান অবস্থান (আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অবস্থান) তালতলার হাজী মোহাম্মদ মুহসিন স্কোয়ারে স্থানান্তর করা হয়। প্রথম দেড় বছর ওয়ারেন হেস্টিংস নিজস্ব ব্যয়ভারে মাদ্রাসার কাজ চলতে থাকে, তবে পরবর্তীতে মাদ্রাসা ফান্ডের অর্থ থেকে এই টাকা ফেরত দেওয়া হয়।[৯] এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পরিচালিত বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি সরকার মাদ্রাসাটি পরিচালনার ভারবহন করে।
প্রতিষ্ঠার শুরুতে এটি মাদ্রাসার প্রথম প্রধান শিক্ষক মোল্লা মাজদুদ্দিনের বাড়িতে স্থাপিত হয়েছিলো।[১০][১১] ১৭৯১ সালে অব্যবস্থাপনা ও ছাত্রদের উচ্ছৃঙ্খলতার অভিযোগ উঠে, ফলে তাকে অপসারণ করে ২৪ পরগণার জেলার কালেক্টর মুহম্মদ ইসমাইলকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। এবং তিন-সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ভার এই কমিটির উপর ন্যস্ত করা হয়।
১৯ শতকের শুরুর দিকে মাদ্রাসার আর্থিক সংকট দেখা দিলে, ১৮১৯ সালে এই সংকট নিরসন করতে ও মাদ্রাসার প্রশাসনিক কর্দমক্ষতা বৃদ্ধি করতে কোম্পানি অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন অ্যায়রনকে মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা কমিটির সচিব নিয়োগ করে। কিন্তু ১৮৪২ সালে এই কমিটি বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয় এবং ১৮৫০ সালে মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ পদের সৃষ্টি করা হয়। এই অধ্যক্ষের পদে প্রথম নিয়োগ দেওয়া হয় এলায়স স্প্রেংগার নামে ইউরোপীয় ব্যক্তিকে। এরপর ১৯২৫ সাল পর্যন্ত মোট ২৬ জন ইউরোপীয় ব্যক্তি অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও ১৮২১ সালে মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মতামত উপেক্ষা করেই মাদ্রাসায় আনুষ্ঠানিক ফরমাল পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করা হয়।
১৮৫০-১৯২৭, অধ্যক্ষের সূচনা
সম্পাদনা১৮৫৩ সালে এই মাদ্রাসার কার্যক্রম ও শিক্ষাব্যবস্থা তদন্ত করার জন্য প্রাক্তন শিক্ষার্থী নবাব আবদুল লতীফকে প্রধান করে একটি কমিটি বানানো হয়। তিনি তদন্ত শেষে সরকারকে একটি ইংরেজি শিক্ষার উচ্চতর বিভাগ খোলার অনুরোধ করেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে ইনস্টিটিউট ইঙ্গ-ফারসি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই ইনস্টিটিউটে উচ্চ ইংরেজি স্কুলের মানের সাথে মিল রেখে ইংরেজি ও ফার্সি ভাষার উপর বিশেষভাবে শিক্ষা প্রদান করা হতো, যাতে করে উচ্চ অভিজাত মুসলিমরা ইংরেজিতে অতি দক্ষ হতে পারে।[৭] একই সালের শেষের দিকে শিক্ষাসংক্রান্ত একটা কমিটির সিদ্ধান্ত পরামর্শ অনুসারে কলকাতা মাদ্রাসাকে প্রস্তাবিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ করার আভাস থাকলেও, সেটা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবে এই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ করে ব্রিটিশ সরকার মাদ্রাসাটি বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা চালায় এবং মাদ্রাসার বিরোধিতা করতে শুরু করে।[১২] ১৮৭১ সালে মাদ্রাসা পরিচালনা করার জন্য স্থানীয় ভারত সরকারের প্রতিনিধি জন প্যাকসটন নরম্যান সভাপতি করে কমিটি গঠন করা হয় এবং মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমে ইংরেজি ভাষার প্রচলন ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।[১৩] ১৮৬৩ সালে মাদ্রাসায় এফএ ক্লাস চালু করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি।
১৯১৪ সালে স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে নিউ স্কীম শিক্ষাধারা ধারণার প্রচলন করা হয়। এই শিক্ষাধারায় ইংরেজি ভাষাকে গুরুত্বারোপ করা হয়েছিলো। ১৯২১ সালে মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ও ইসলামি শিক্ষার সংস্করণের লক্ষ্যে সৈয়দ শামসুল হুদাকে সভাপতি করে ২৩ সদস্যের একটি কমিটি প্রস্তুত করা হয়, যারা ইংরেজি ভাষাকে ঐচ্ছিক রাখার প্রস্তাব করে।[১৪]
১৯২৭-১৯৪৭, মুসলিম অধ্যক্ষের সূচনা
সম্পাদনা১৯২০ সালের পর থেকেই মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ভারতের মুসলিমদের মাদ্রাসার অধ্যক্ষ বানানোর আন্দোলন করে। ১৯২৭ সালে প্রথম মুসলিম অধ্যক্ষ হিসাবে খাজা কামালউদ্দীন আহমদ নিয়োগপ্রাপ্ত হোন। এবং তিনি মাদ্রাসার সিলেবাসে ব্যপক পরিবর্তন নিয়ে আসেন। এই বছরই অন্যান্য মাদ্রাসার সঙ্গে কলকাতা মাদ্রাসাতেও আলিম, ফাজিল, কালিম, মুমতাজুল মুহাদ্দেসিন প্রভৃতি শিক্ষাক্রমের সূচনা ঘটে।
১৯৪৭ বিভাজন
সম্পাদনা১৭৮০ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই মাদ্রাসা ইংরেজদের কোম্পানি পরিচালনা করেছে। এরপর ১৯৪৭ সালে ভারত ইংরেজদের প্রভাব মুক্ত হলে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার একাংশ ঢাকাতে স্থানান্তরিত হয়, এবং ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা পাকিস্তান সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয় এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে এরপর থেকে বাংলাদেশ সরকার পরিচালনা করে আসছে।[১৫]
১৯৪৭-২০০৭, বিভাজন পরবর্তী
সম্পাদনা১৯৪৭ সালে কলকাতা মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, চেয়ার-টেবিল সহ নানা জিনিসপত্র ঢাকায় স্থানান্তর করলে মাদ্রাসা নানা সংকটে কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। মাদ্রাসার বিশাল গ্রন্থাগারের বহু বই হারিয়ে যায়।[১৬] এর দুই বছর পরে কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের চেষ্টায় মাওলানা আবুল কালাম আজাদের উদ্যোগে মাদ্রাসাটি পুনরায় চালু করা হয়।[১৭][১৮] উন্নত শিক্ষার জন্য ১৮৬৩ সালে কলকাতা মাদ্রাসায় এফ এ পর্যায়ের ক্লাস সংযোজিত হয়। ১৯০৭ সালে কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় তিন বছর মেয়াদি মাস্টার্স মানের কামিল কোর্স চালু হয়।[১৯] এই মাদ্রাসায় ১৯৭০ সাল পর্যন্ত দারসে নিজামি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিলো, এরপরে ভারতের সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে মিল করে সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়।[২০]
কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসাটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার আন্দোলন করতে থাকে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালে মাদ্রাসাটিকে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়।
শিক্ষা কার্যক্রম
সম্পাদনাকলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা সম্পর্কে এর প্রতিষ্ঠাতা ওয়ারেন হেস্টিংসের ১৭৮১ সালের ১৭ই এপ্রিলে প্রদত্ত একটি বিবরণীতে বিস্তারিত বিষয়াদি জানা যায়। বিবরণীতে সে উল্লেখ করে:
“ | ১৭৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মুসলমানদের একটি প্রতিনিধিদল আমার সাথে সাক্ষাত করে আমাকে অনুরোধ করে যে, মোল্লা মাজদুদ্দিন নামের জনৈক ব্যক্তিকে কলিকাতায় স্থায়ীভাবে রাখার ব্যাপারে আমি যেন সচেষ্ট হই। যাতে এখানকার মুসলমান ছাত্ররা প্রচলিত ইসলামী বিষয়ে শিক্ষালাভ করতে পারে। এই ব্যক্তি ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগাধ বুৎপত্তিসম্পন্ন। ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্যে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই ব্যক্তি বিশেষ যোগ্যতা রাখেন। তাছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সরকারেরও এমন অসংখ্য অফিসারের প্রয়োজন যাদের প্রচুর যোগ্যতা রয়েছে, এবং ফৌজদারি আদালত ও দেওয়ানী আদালতে এই সময় বিচারক নিয়োগের ব্যাপারে খুবই যোগ্যতাসম্পন্ন ও নির্ভরযোগ্য লোকের প্রয়োজন। আমি এই প্রতিনিধিদলকে এই আশ্বাস দিয়ে বিদায় করেছি যে, যতটুকু সম্ভব আমি এই ব্যাপারে চেষ্টা করব। অতঃপর আমি মোল্লা মাজদুদ্দিনকে ডেকে পাঠাই এবং মুসলমানদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের অনুরোধ জানাই। তিনি আমার কথায় সম্মত হলেন এবং ১৭৮০ সালে প্রস্তাবিত মাদ্রাসার জন্যে কার্যক্রম শুরু করে দিলেন। | ” |
— বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা ও সমাজ জীবনে তার প্রভাব, পৃষ্ঠা ১২০-১২১ |
প্রথম দিকে এই মাদ্রাসায় আইন, জ্যোতির্বিদ্যা, যুক্তিবিজ্ঞান, দর্শন, পাটিগণিত, জ্যামিতি, ছন্দবিজ্ঞান, ব্যাকরণ, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি পড়ানো হত। ১৮২৭ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অধ্যাপক পি ব্রেটন এই কলেজে একটি মেডিক্যাল ক্লাস শুরু করেন। ১৮৩৬ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্লাস শুধু এই মাদ্রাসায়ই নেওয়া হতো।
এই মাদ্রাসায় শুরু থেকেই লখনউইয়ের ফিরিঙ্গি মহল নামক স্থানের আরবি স্কুল দারসে নিজামি পদ্ধতি অনুসরণ করে পাঠদান করা হতো।[২১] এছাড়াও এই মাদ্রাসার অনুকরণে বাংলার অধিকাংশ মাদ্রাসা দরসে নিজামির আদলে পাঠদান করা হতো। এই ব্যবস্থা ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চালু ছিলো। দরসে নিজামি পাঠক্রম অনুযায়ী একজন ছাত্রকে ১৭/১৮ বছর বয়সেই আরবি ও ফার্সি ভাষায় লিখিত নির্বাচিত প্রায় শতাধিক বই অন্তত একবার পড়ার ও অনুধাবনের যোগ্যতা অর্জন করতে হতো। ধর্মীয় পাঠ্যক্রম ছাড়াও চিকিৎসা বিদ্যা, কুটির শিল্প ও কারিগরি প্রশিক্ষণের জন্য দারসে নিজামি শিক্ষাক্রম চালু ছিলো, এই শিক্ষা কার্যক্রমের শিক্ষাকাল ছিলো ৯ বছর।
১৮২১ সালে মাদ্রাসায় আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা ব্যবস্থার চালু করা হয়। মাদ্রাসায় প্রথম থেকেই প্রচলিত ফার্সি ভাষায় অধিক পাঠদান হতো। কিন্তু মাদ্রাসায় ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য বিস্তারের জন্য ১৮২৬ সাল থেকে কোর্সসমূহে ইংরেজি ভাষা সংযুক্তিকরণের চেষ্টা করা হয়, এবং ১৯২৯ সালে ইংরেজি বিভাগ খোলা হয়। ১৮৫৪ সালেই শিক্ষাসংক্রান্ত ‘ডেসপাচ কমিটি' মাদ্রাসাকে প্রস্তাবিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ করার ইঙ্গিত দিলেও, কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন হয়নি।[৭]
সেই সময়ে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার লাইব্রেরিতে ২ লক্ষ ৫০ হাজারের অধিক দুর্লভ ও মূল্যবান বই ছিলো।
অ্যাংলো-পার্সিয়ান বিভাগ
সম্পাদনা১৮৫৪ সালে মাদ্রাসার অভ্যন্তরে একটি পৃথক গবেশনা ইনস্টিটিউট ইঙ্গ-ফারসি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। যা অ্যাংলো-পার্সিয়ান বিভাগ নামে পরিচিত ছিলো। মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে অধ্যক্ষ এলায়স স্প্রেংগারের তত্ত্বাবধায়নে এই বিভাগটি চালু করা হয়। এই বিভাগটি এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো যে, ভারতের ও বাংলাদেশের সকল আলিয়া মাদ্রাসায় এই বিভাগের সিলেবাস অনুসরণ করে নতুন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিলো।[২২] অনেক গুণী ব্যক্তি এই বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।
অন্তর্ভুক্তি
সম্পাদনাবাংলাদেশের ও ভারতের অনন্য আলিয়া মাদ্রাসা মূলত এই কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার আদলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ছিলো সকল মাদ্রাসার কেন্দ্র ও অনুমোদনকারী প্রতিষ্ঠান। উপমহাদেশের সকল আলিয়া মাদ্রাসাতেই এই মাদ্রাসার পাঠ্যসুচী অনুসরণ করা হতো। এইজন্য দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকরন করার জন্য বিভিন্ন সময় কমিটি গঠন করে পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পর, ১৭৯১ সালে মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদ মাদ্রাসা শিক্ষা পাঠ্যসূচি ও সিলেবাসে প্রবর্তন আনে। এ সিলেবাস কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার অধিভুক্ত বাংলা, আসাম, বিহার ও উড়িষ্যার সকল মাদ্রাসায় বাস্তবায়ন করা হয়। এরপর ১৮৬৯ সালে আরেকটি কমিটি মাদ্রাসায় কিছু সংশোধনী আনলে, সেটাও অধিভুক্ত সকল মাদ্রাসার সিলেবাসে বাস্তবায়িত হয়। ১৮৭১ সালে জন প্যাকসটন নরম্যান কমিটি বেঙ্গল মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনে।
কলকাতার এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে পূর্ব বাংলায় প্রতিষ্ঠিত করতে ১৮৭৪ সালে তিনটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়।
- রাজশাহী মাদ্রাসা (বর্তমানে: হাজী মুহম্মদ মুহসীন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, রাজশাহী)
- ঢাকা মাদ্রাসা (বর্তমানে: কবি নজরুল সরকারি কলেজ, ঢাকা ও ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা)
- চট্টগ্রাম মাদ্রাসা (বর্তমানে: সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম ও হাজী মুহাম্মদ মহসিন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম)
অবদান
সম্পাদনাকলকাতায় এই মাদ্রাসা স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিলো, ফারসি ও আরবি ভাষার জ্ঞানে দক্ষ এবং মুসলিম আইন শাস্ত্রে শিক্ষিত ব্যক্তি তৈরি করা, যাদেরকে সরকারি অফিসে ও বিচারালয়ে নিম্নপদ ও উচ্চপদে নিয়োগ করা যাবে। এতে করে উপমহাদেশে শাসন সহজ হবে। এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ফলে মুসলিম অভিজাত সম্প্রদায়ের সন্তানেরা উচ্চ কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়। এই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী-শিক্ষকেরা নানা কৃষক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে।[১৭]
অধ্যক্ষগণের তালিকা
সম্পাদনামাদ্রাসায় প্রথম দিকে প্রধান শিক্ষক ও হেড মাওলানা দিয়ে পরিচালনা কাজ হলেও, ১৮৫০ সালে সর্বপ্রথম অধ্যক্ষের পদ সৃষ্টি হয়। প্রথম ২৬ জন ছিলেন ইউরোপিয়ান খ্রিষ্টান অধ্যক্ষ। এরপরে ৪ জন মুসলিম অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করার পরই, ১৯৪৭ সালে কলকাতা মাদ্রাসার একাংশ সম্পূর্ণ আলাদাভাবে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। অধ্যক্ষের তালিকা:
- এ স্প্রেংগার (এম, এ) - (১৮৫০- ১৮৭০)
- স্যার উইলিয়াম নাসনলীজ (এল, এল, ডি) - (১৮৭০- ১৮৭০)
- জে স্যাটক্লিফ (এম, এ) - (১৮৭০- ১৮৭৩)
- এফ ব্রকম্যান (এম, এ) - (১৮৭৩- ১৮৭৮)
- এ ই গাফ (এম, এ) - (১৮৭৮- ১৮৮১)
- এ এফ আর হোর্নেল (সি, আই, ই), ( পি, এইচ, ডি) - (১৮৮১- ১৮৯০)
- এইচ প্রথেরো (এম, এ) - (১৮৯০- ১৮৯০)
- এ এফ হোর্নেল - (১৮৯০- ১৮৯২)
- এ জে রো - (এম, এ) - (১৮৯২- ১৮৯২)
- এ এফ হোর্নেল - (১৮৯২-১৮৯৫)
- এ জে রো - (১৮৯৫-১৮৯৭)
- এ এফ হোর্নেল - (১৮৯৭- ১৮৯৮)
- এফ জে রো - (১৮৯৮- ১৮৯৯)
- এফ সি হল - (১৮৯৯- ১৮৯৯)
- স্যার অর্যাল স্টেইন - (১৮৯৯- ১৯০০)
- এইচ এ স্টার্ক - (১৯০০- ১৯০০)
- কর্ণেল রেস্কিং - (১৯০০- ১৯০১)
- এইচ এ স্টার্ক - (১৯০১- ১৯০৩)
- এডওয়ার্ড ভেনিসন - (১৯০৩- ১৯০৩)
- এইচ ই স্টেপেল্টন - (১৯০৩-১৯০৪)
- ডেনিসন রাস - (১৯০৪-১৯০৭)
- মিঃ চিফম্যান - (১৯০৭- ১৯০৮)
- এডওয়ার্ড ডেনিসন - (১৯০৮- ১৯১১)
- এ এইচ হারলি - (১৯১১- ১৯২৩)
- জে এম বুটামলি - (১৯২৩- ১৯২৫)
- এ এইচ হারলি - (১৯২৫- ১৯২৭)
- খাজা কামালউদ্দীন আহমদ- (১৯২৭-১৯২৮) (প্রথম মুসলিম অধ্যক্ষ)
- খান বাহাদুর মোহাম্মদ হেদায়াত হোসাইন (১৯২৮- ১৯৩৪)
- খান বাহাদুর মোহাম্মদ মুসা (১৯৩৪- ১৯৪১)
- মোহাম্মদ ইউসুফ (১৯৪২- ১৯৪৩)
- খান বাহাদুর জিয়াউল হক (১৯৪৩- ১৯৪৭)[২৩]
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Suman, Amit Kumar (২০২০)। "Colonial state and indigenous Islamic learning: a case study of Calcutta Madrasa"। Paedagogica Historica। 58 (4): 486। আইএসএসএন 0030-9230।
- ↑ "Mohammedan College of Calcutta, 1848"। PURONOKOLKATA (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৪-০১-০৭। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-১৫।
- ↑ "কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, লিয়াকত আলী খাঁ'র জন্মদিন"। banglanews24.com। ২০১৫-১০-০১। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-১১।
- ↑ "ঢাকা আলিয়া মাদরাসা : ইতিহাস ও ঐতিহ্য"। The Daily Sangram। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-১১।
- ↑ "University Grants Commination"। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ভারত)। সংগ্রহের তারিখ ১৩ মে ২০২২।
- ↑ "আলিয়া মাদ্রাসা - বাংলাপিডিয়া"। bn.banglapedia.org। ২০২২-০৫-১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-১১।
- ↑ ক খ গ "Calcutta Madrasa, The ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৭ অক্টোবর ২০০৮ তারিখে". Banglapedia.com. ২৪ অগাস্ট, ২০০৫
- ↑ Rahman, Fazlur. Islam & Modernity. The University of Chicago Press. United States:1982 আইএসবিএন ০-২২৬-৭০২৮৪-৭, 73-74
- ↑ সাত্তার, আব্দুস (২০০৪)। আলিয়া মাদরাসার ইতিহাস। ইসলামিক ফাউন্ডেশন। পৃষ্ঠা ৩৮। আইএসবিএন 9840609106।
- ↑ Ragib, Hammad (২০১৯-০৮-০৭)। "কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড : একটি পর্যালোচনা"। Fateh24 (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-০৯।
- ↑ "কলকাতা মাদ্রাসা ব্রিটিশ শাসনাধীনে সর্বপ্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান"। শিক্ষক বাতায়ন। ২৭ জুলাই ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ মে ২০২২।
- ↑ আবদুস সাত্তার ২০০৪, পৃ. ১৪১-৪৩।
- ↑ আবদুস সাত্তার ২০০৪, পৃ. ১৪৭।
- ↑ আবদুস সাত্তার ২০০৪, পৃ. ১৯০-৯১।
- ↑ আবদুস সাত্তার ২০০৪, পৃ. ২১৪-১৫।
- ↑ Sengupta, Anwesha (২০২২-০২-১৪)। "Calcutta's Muslims after Partition"। দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-৩০ – This is a shorter version of an article with the same title, published in Tanika Sarkar, Sekhar Bandyopadhyay (Eds) Calcutta: The Stormy Decades (New Delhi, 2015). For references please see the original article-এর মাধ্যমে।
- ↑ ক খ Welle (www.dw.com), Deutsche। "কলকাতা মাদ্রাসা | DW | 14.02.2022"। ডয়চে ভেলে।
- ↑ TwoCircles.net (২০১১-০৫-৩১)। "Aliah University: Past and Present"। TwoCircles.net (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-৩০।
- ↑ রাব্বানি, মহিউদ্দিন। "আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার খন্ডচিত্র"। আওয়ার ইসলাম। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-১৫।
- ↑ Anhad Hundal (১৫ অক্টোবর ২০১৬)। "RBSI - Essay: Getting The Picture - The mystery of an iconic Partition photograph By Anhad Hundal Caravan - 1 September 2016 On 18 August 1947, the American magazine Life carried a photograph of BS Kesavan,"। www.rarebooksocietyofindia.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-৩০।
- ↑ "আলিয়া মাদ্রাসা: শিক্ষাবিস্তারে অবিস্মরণীয় ভূমিকা এবং ইসলাম প্রচারে এর অবদান"। নেত্রকোণা জার্নাল (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২১-০৩-০৯। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-১৫।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "BSI NEWSLETTER" (পিডিএফ)। www.bsi.gov.in/। পৃষ্ঠা 6। সংগ্রহের তারিখ ২১ মে ২০২২।
- ↑ "সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া | GOVT. MADRASAH-E-ALIA"। www.dhkgovmalia.edu.bd। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৬-০২।
গ্রন্থপঞ্জি
সম্পাদনা- আবদুস সাত্তার, ড. মো. (২০০৪)। "বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা ও সমাজ জীবনে তার প্রভাব"। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।