অত্রি

ভারতীয় পৌরাণিক দেবর্ষি, সপ্তর্ষির অন্যতম
(ঋষি অত্রি থেকে পুনর্নির্দেশিত)

অত্রি (সংস্কৃত: अत्रि) হলেন একজন বৈদিক ঋষি৷ হিন্দুধর্ম অনুসারে যিনি অগ্নি, ইন্দ্র সহ বৈদিক দেবতার এবং যজ্ঞে আহুতি প্রদান ও বহু বেদমন্ত্রের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি৷ ঋগ্বেদে পুনপুন উল্লেখিত ঋষি অত্রি সপ্তর্ষিমণ্ডলের একজন তারকা তথা ঋষি৷ এবং হিন্দু গ্রন্থ ঋক বেদে অন্যতম প্রধান উল্লিখিত ব্যক্তি৷[]

অত্রি
ঋষি অত্রির কুটীরে রামের আগমন৷ অত্রির সহিত আলাপরত রাম ও তার ভ্রাতা লক্ষ্মণ এবং সীতার সহিত কথোপকথনরত ঋষিপত্নী অনুসূয়া৷
পদবিব্রহ্মর্ষি
পরিবারব্রহ্মা (পিতা)
দাম্পত্য সঙ্গীঅনুসূয়া
সন্তানদুর্বাসা, চন্দ্র, দত্তাত্রেয়

হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদের পঞ্চম মণ্ডলের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি অত্রি এবং তাঁর বংশধরগণ। সেজন্য, এই মণ্ডলের নাম ঋষির সম্মানার্থে "অত্রি মণ্ডল" নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে৷ এই মণ্ডলে সর্বমোট ৮৭টি সূক্ত রয়েছে, যেগুলোর মন্ত্রদ্রষ্টা হলেন ঋষি অত্রি এবং তার উত্তরসূরীগণ।[]

এছাড়াও অত্রি ঋষির উল্লেখ বিভিন্ন পুরাণ এবং হিন্দুদের অন্যতম দুটি মহাকাব্য রামায়ণমহাভারতেও পাওয়া যায়[][]

 
ঋষি অত্রির নিকট মহাবিষ্ণু ব্রহ্মা এবং রুদ্রের আবির্ভাব

সপ্তর্ষি মণ্ডলের সাত জন মহান ঋষি তথা মরীচি, অঙ্গিরা, পুলহ, ক্রতু, পুলস্ত্যবশিষ্ঠ সহ ঋষি অত্রির নামও সমান উল্লেখযোগ্য৷[] বৈদিক যুগের বিভিন্ন গল্প কাহিনী অনুসারে, অত্রি মুনি অনুসূয়া দেবীর সহিত বিবাহ করেন এবং ক্রমে তাদের দুর্বাসা, দত্তাত্রেয় এবং চন্দ্র নামে তিন সন্তান জন্ম নেয়৷[] জ্যোতিষ গণনা অনুসারে সপ্তর্ষিমণ্ডলের নক্ষত্রগুলোর মধ্যে তিনি অন্তিম এবং ব্রহ্মার জিহ্বার অংশ থেকে সৃষ্ট বলে বিশ্বাস করা হয়৷ তার স্ত্রী অনুসূয়া ছিলেন সপ্ত পতিব্রতা নারীর একজন৷ আকাশবাণীর আদেশ অনুসারে যতবারই তিনি প্রায়শ্চিত্তের বিধান পান, নিষ্ঠার সহিত তিনি তা করেন৷ তার নিষ্ঠা ও কঠোর তপস্যার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে হিন্দুধর্মের ত্রিমূর্তি হিসাবে আলোচিত ব্রহ্মা, বিষ্ণুমহেশ্বর একযোগে তার সামনে আবির্ভূত হন এবং তাদের বর দান করেন৷ আশীর্বাদ স্বরূপ তিনি ত্রিদেবকে নিজের পুত্র রূপে পান৷ আবার অপর একটি সংস্করণ অনুসারে ঋষিপত্নী অনুসূয়া তার শুদ্ধতা ও সতীত্বের জোরে ত্রিদেবকে সংকট অবস্থা থেকে রক্ষা করেছিলেন৷ তার ফলস্বরূপ তারা অনুসূয়ার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তার তিন সন্তানরূপে জন্ম নেওয়ার আশ্বাস দেন৷ ব্রহ্মা চন্দ্রদেব রূপে, বিষ্ণু দত্তাত্রেয় রূপে এবং শিবের কিছু অংশ একত্রিত করে জন্ম নেন দুর্বাসা৷ ঋক বেদের একাধিক পংক্তিতে উল্লেখযোগ্যভাবে অত্রির নাম পাওয়া যায়৷ তিনি একাধিক যুগে একাধিক হিন্দু মহাকাব্যে উল্লিখিত হন৷ ত্রেতাযুগে রামায়ণের সময়ে অত্রি ও তার স্ত্রী অনুসূয়াকে দেখা যায় বনবাসকালে রাম-লক্ষ্মণসীতাকে সৎসঙ্গ দিতে৷ শিব পুরাণ অনুসারে অত্রি-অনুসূয়া উভয়েরই উল্লেখ পাওয়া এবং ঘটনাক্রমে গঙ্গাকে পৃথিবীতে আনয়নে তারা যথেষ্ট ভূমিকা নিয়েছিলেন৷[]

ঋগ্বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা

সম্পাদনা

তিনি ঋগ্বেদের পঞ্চম মণ্ডলের অন্যতম দ্রষ্টা৷ অত্রি মুনির বংশজ একাধিক উত্তরসূরীগণ এবং তার বিভিন্ন অনুগামীরা একই পদ্ধতিতে ঋকবেদের সাথে অন্যান্য বৈদিক পুস্তকের সংযোগ স্থাপন করেন৷ ঋগ্বেদের পঞ্চম মণ্ডলে সর্বমোট ৮৭টি সূক্ত রয়েছে, যা মূলত অগ্নি এবং ইন্দ্রদেবকে উদ্দেশ্য করে রচিত৷ এছাড়া বিশ্বেদেবাঃ (একত্রিতভাবে সমস্ত দেবগণ), মরুদ্গণ এবং যুগ্মদেবতা তথা মিত্র দেব-বরুণ দেবঅশ্বিনীকুমার বিষয়েও সূক্তে একাধিক উল্লেখ পাওয়া যায়৷[] ঐ মণ্ডলেই ঊষা দেবী এবং আদিত্য সবিতৃৃকে উদ্দেশ্যে দুটি দুটি করে সূক্ত পাওয়া যায়৷ এই মণ্ডলের অধিকাংশ সূক্তের দ্রষ্টা ঋষি অত্রি এবং তার উত্তরসূরীদের অবদান, তারা "আত্রেয়" নামে পরিচিত৷[] এই সকল মন্ত্র ১৫০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমভাগে রচিত হয়েছিলো বলে অনুমান করা হয়৷[][]

ঋগ্বেদের অত্রি ঋষি দৃষ্ট সূক্তগুলো সুন্দর ছন্দোবদ্ধ রীতি এবং আধ্যাত্মিক ধ্যান ধারণার বুদ্ধিদীপ্ত ধাঁধা সহ শিক্ষনীয় বস্তুর উপস্থিতি বিশেষভাবে গূরুত্বপূর্ণ৷ এই সূক্তগুলোতে সংস্কৃত ভাষার শব্দকোষীয়, বাক্যগঠন সংক্রান্ত, গঠনগত এবং ক্রিয়ার কালের অদ্ভুত ব্যবহার ভাষার নমনীয়তা বর্দ্ধিত করে৷[১০] ঋগ্বেদের অত্রি মণ্ডলের ৫.৪৪ সংযক মন্ত্রটিকে বিখ্যাত পণ্ডিত গেল্ডনার সবচেয়ে গূঢ় ধাঁধাবিশিষ্ট এবং কঠিনতর বলে উল্লেখ করেছেন৷[১১] এছাড়াও ঐ শ্লোকগুলোতে প্রাকৃৃতিক ঘটনাবলীর মার্জিত উপস্থাপন রয়েছে৷ ৫.৮০ নম্বর শ্লোকে চঞ্চল প্রাণবন্ত একটি নারীকে ভোরের আলোর সাথে রূপক হিসাবে তুলনা করা হয়েছে৷[১০]

একাধারে ঋগ্বেদের পঞ্চম মণ্ডলটি ঋষি অত্রি এবং তার বংশানুজ ও অনুগামীদের দ্বারা প্রণীত তেমনি বেদের অন্যান্য একাধিক মণ্ডলে ঋষি অত্রির উল্লেখ রয়েছে৷ দশম মণ্ডলের ১৩৭.৪ নম্বর মন্ত্রপ অত্রির বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায়৷[১২]

রামায়ণে

সম্পাদনা

রামায়ণ অনুসারে বনবাস পালনকালে রাম, তার স্ত্রী সীতাদেবী এবং তার ভ্রাতা লক্ষ্মণের সহিত অত্রি-অনুসূয়ার কুটীরে উপস্থিত হন৷ অত্রির কুটীর চিত্রকূটের নিকট ছিলো বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷[] কুটীরের নিকটে একটি মনোরম সরোবর ছিলো, যেখানে দৈব গান ধ্বনিত হতো এবং সরোবরের জল বিভিন্ন ফুল ও জলজ পাতাসদৃৃশ উদ্ভিদে সজ্জিত ছিলো৷ সারস, মাছরাঙা, কচ্ছপ, পানকৌড়ী, বিভিন্ন প্রজাতির হাসের বাস ছিলো এখানে৷[]

পুরাণে

সম্পাদনা

মধ্যযুগীয় একাধিক পুরাণে অত্রি নামের অনির্দিষ্ট বেশ কিছু ঋষির উল্লেখ পাওয়া যায়৷ এই কারণে পৌরাণিক মূল অত্রি চরিত্রটি ও তার গুরুত্ব হ্রাস পেয়ে বিচিত্র ও অন্তর্সঙ্গতিহীন হয়ে পড়ে৷ ভিন্ন পুরাণে উল্লিখিত প্রতিটি অত্রি মুনিই একই ব্যক্তিত্ব কীনা তা নিয়ে অস্পষ্ট ধারণা থেকেই যায়৷[]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Antonio Rigopoulos (১৯৯৮)। Dattatreya: The Immortal Guru, Yogin, and Avatara। State University of New York Press। পৃষ্ঠা 2–4। আইএসবিএন 978-0-7914-3696-7 
  2. Stephanie W. Jamison; Joel P. Brereton (২০১৪)। The Rigveda। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 659–660। আইএসবিএন 978-0-19-937018-4 
  3. Alf Hiltebeitel (২০১৬)। Nonviolence in the Mahabharata: Siva’s Summa on Rishidharma and the Gleaners of Kurukshetra। Routledge। পৃষ্ঠা 55–56, 129। আইএসবিএন 978-1-317-23877-5 
  4. Roshen Dalal (২০১০)। Hinduism: An Alphabetical Guide। Penguin Books। পৃষ্ঠা 49। আইএসবিএন 978-0-14-341421-6 
  5. Antonio Rigopoulos (১৯৯৮)। Dattatreya: The Immortal Guru, Yogin, and Avatara। State University of New York Press। পৃষ্ঠা 1–3। আইএসবিএন 978-0-7914-3696-7 
  6. Sathyamayananda, Swami। Ancient sages। Mylapore, Chennai: Sri Ramakrishna Math। পৃষ্ঠা 17–20। আইএসবিএন 81-7505-356-9 
  7. Stephanie W. Jamison; Joel P. Brereton (২০১৪)। The Rigveda। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 659–771। আইএসবিএন 978-0-19-937018-4 
  8. Flood 1996, পৃ. 37।
  9. Witzel 1995, পৃ. 4।
  10. Stephanie W. Jamison; Joel P. Brereton (২০১৪)। The Rigveda। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 660। আইএসবিএন 978-0-19-937018-4 
  11. Stephanie W. Jamison; Joel P. Brereton (২০১৪)। The Rigveda। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 660, 714–715। আইএসবিএন 978-0-19-937018-4 
  12. Stephanie W. Jamison; Joel P. Brereton (২০১৪)। The Rigveda। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 1622–1623। আইএসবিএন 978-0-19-937018-4