আলী আকবর খাঁ
ওস্তাদ আলী আকবর খান (১৪ এপ্রিল ১৯২২ - ১৯ জুন ২০০৯) ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতের একজন অন্যতম পরিপূর্ণ সঙ্গীতজ্ঞ। সঙ্গীতে তার অসাধারণ সৃষ্টি তাকে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সঙ্গীতে অমর করে রাখবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে তার ভূমিকার জন্য তিনি বাঙালি জাতির কাছে বিশেষভাবে সম্মানিত।
আলী আকবর খান | |
---|---|
প্রাথমিক তথ্য | |
জন্ম | ১৪ এপ্রিল ১৯২২ |
উদ্ভব | কুমিল্লা, পূর্ব বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) |
মৃত্যু | জুন ১৮, ২০০৯ সান আনসেলমো, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র | (বয়স ৮৭)
ধরন | হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত |
পেশা | সুরকার, সরোদীয় |
বাদ্যযন্ত্র | সরোদ |
জন্ম ও শিক্ষা
ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও মাতা মদিনা বেগম। পিতার কর্মস্থাল মাইহার (ভারতের মধ্যপ্রদেশের যুবরাজ শাসিত রাজ্য) পিতার কাছেই তার সঙ্গীত শিক্ষার হাতে খড়ি হয়। তিনি সব ধরনের বাদ্য যন্ত্র ও গায়কীর শিক্ষা নেন। ধীরে ধীরে তিনি সরোদে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেন। ওস্তাদ আলী আকবর খান সাহেবের সঙ্গীতে হাতে খড়ি হয় তিন বছর বয়েস থেকে। কন্ঠ সঙ্গীতের শিক্ষা শুরু হয় তার বাবা আচার্য আলাউদ্দিন খান সাহেবের কাছে এবং তবলা শিখতে শুরু করেন তার চাচা ফকির আফতাবউদ্দিনের কাছে। তাঁর বাবা আরো অনেক বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখিয়েছেন; তবে তিনি সরোদ এবং কন্ঠ সঙ্গীতেই নিবিষ্ঠ হন। এরপর প্রায় ২০ বছর যাবৎ তাঁর শিক্ষা ও চর্চা অব্যাহত থাকে। এসময় তিনি প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা করে রেওয়াজ করতেন। এর পরেও তাঁর বাবা আচার্য আলাউদ্দিন খান সাহেবের ১০০ বছর বয়স পর্যন্ত আলী আকবর খানকে শিখিয়েছেন। এই শিক্ষণ প্রক্রিয়া ওস্তাদ আলী আকবর খান সাহেবের মধ্যে এমন এক সম্পদ সৃষ্টি করেছে যা থেকে তিনি এখনো শিখছেন বলে বোধ করেন। ১৯৭২ সালে তার বাবার মৃত্যুর পর হতে তিনি বাবার চর্চিত সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। এই সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য হচ্ছে ভারতের মাইহার ও রামপুরের শ্রী বাবা আলাউদ্দিন সেনী ঘরানা।
কর্মজীবন
দীর্ঘকাল প্রশিক্ষণ লাভের পর ১৩ বছর বয়সে আলি আকবর খাঁ ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে এলাহাবাদে সর্ব প্রথম এক সঙ্গীত সম্মেলনে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। তিন বছর পরে ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে সেই একই সম্মেলনে তিনি পণ্ডিত রবিশংকরকে সরোদে সঙ্গত করেন; এটাই তাঁদের প্রথম যুগলবন্দী ছিল। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বোম্বে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র সাথে তিনি প্রথম কাজ করেন, এইবার তাঁকে তবলায় সঙ্গত করেছিলেন ঊস্তাদ আল্লা রাখা।১৯৪০ সাল থেকে তিনি লক্ষ্ণৌয়ের AIR-এ প্রতি মাসে যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করা শুরু করেন। অবশেষে পেশাদার সঙ্গীতকার হওয়ার উদ্দেশ্যে রবিশংকরের সাথে তিনিও ১৯৪৪ সালে মাইহার ত্যাগ করেন। রবিশংকর বম্বে চলে যান, আলি আকবর কিছুদিন লক্ষ্ণৌয়ের অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সর্বকনিষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন, রেডিওর জন্য অর্কেষ্ট্রা রচনার দায়িত্বও তার উপরই ছিল।
১৯৪৩ সালে তাঁর বাবার সুপারিশে যোধপুরের মহারাজা হনবন্ত সিংয়ের দরবারে তিনি সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে নিয়োজিত হন।সেখানে সঙ্গীত পরিবেশনের পাশাপাশি তিনি শেখানো ও সুর রচনার কাজও চালিয়ে যান, মহারাজাই তাকে 'উস্তাদ' উপাধিতে ভূষিত করেন।পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সময় যোধপুরে রাজতন্ত্রের সমাপ্তি ও বিমান দূর্ঘটনায় মহারাজার মৃত্যু ঘটলে আলি আকবর বম্বেতে চলে আসেন।
মুম্বইতে চেতন আনন্দের 'আন্ধিয়াঁ' (১৯৫২) সহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে সুরারোপ করবার মধ্য দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করতে থাকেন। এই চলচ্চিত্রটির প্রধান গানটি গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। আলি আকবরকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে গানটি গেয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের 'দেবী' (১৯৬০), তপন সিংহ এর 'ক্ষুধিত পাষাণ' (১৯৬০) এবং মার্চেন্ট আইভরির 'দ্য হাউসহোল্ডার'-এ কাজ করবার জন্য তিনি'বছরের শ্রেষ্ঠ সংগীতকার' হিসেবে পুরষ্কৃত হন। শংকর জয়কিষেণের সঙ্গীত পরিচালনায় 'সীমা' (১৯৫৫) শীর্ষক চলচ্চিত্রের একটি গানেও তিনি সরোদ বাজান। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে বার্নার্দো বার্তোলুচির পরিচালিত 'লিট্ল্ বুদ্ধা' শীর্ষক চলচ্চিত্রের জন্যও তিনি কিছু সুর রচনা করেন।
১৯৪৫ সালে তিনি এইচএমভি স্টুডিওতে ৭৮ আর. পি. এম. এর সিরিজ রেকর্ডকরা শুরু করেন, এই ডিস্কগুলি একেকটি সাকুল্যে তিন মিনিট দৈর্ঘ্যের সুর রেকর্ড করতে পারত। এই রকমই একটি রেকর্ডের জন্য তিনি 'চন্দ্রনন্দন' নামক একটি রাগ রচনা করলেন, রেকর্ডটিও বিশাল সাফল্য পেল। মালকোষ, চন্দ্রকোষ, নন্দকোষ ও কৌশি কানাড়া- এই চারটি রাগের উপর ভিত্তি করে এই নতুন রাগটি তিনি রচনা করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে এই রাগটি ২২ মিনিট দৈর্ঘ্যে পুনরায় রেকর্ড করা হলে সারা পৃথিবী জুড়ে এই রাগটির নিজস্ব শ্রোতা তৈরি হয়।
ভারতে সঙ্গীত পরিবেশনার পাশাপাশি তিনি পশ্চিমের দেশগুলিতেও প্রচুর ঘুরেছেন। ১৯৫৬ সালে হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখানো ও প্রচারের উদ্দেশ্যে কলকাতায় তিনি 'আলি আকবর কলেজ অব মিউজিক' প্রতিষ্ঠা করেন, ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলিতে একই নামে তিনি আরেকটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে সান রাফায়েলে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৬৯ সালে বস্টনে পিবডি ম্যাসন কনসার্ট সিরিজে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেন, তবলা সঙ্গতে ছিলেন পণ্ডিত শংকর ঘোষ। ১৯৮৫ সালে তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানের আরেকটি শাখা খোলেন সুইৎজারল্যান্ডের বাসেলে। তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে লং প্লেয়ার অ্যালবামে রেকর্ড করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের দূরদর্শনে সরোদ পরিবেশন করেন।
রবিশংকর, নিখিল ব্যানার্জী ও এল. সুব্রমনিয়মের সাথে আলি আকবরের অসংখ্যও যুগলবন্দী রয়েছে, যেগুলি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। বিলায়াৎ খানের সাথেও তাঁর কিছু যুগলবন্দী রয়েছে। পাশ্চাত্যের সঙ্গীতকারদের সাথেও তিনি যৌথ কাজ করেছেন। ১৯৭১ সালের অগাষ্ট মাসে আলি আকবর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যার্থে রবিশংকর, আল্লা রাখা, কমলা চক্রবর্তী প্রমুখের সঙ্গে ম্যাডিসন স্ক্যোয়ার গার্ডেনে সঙ্গীত পরিবেশবন করেন। জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, রিঙ্গো স্টারের মত খ্যাতনামা শিল্পীরাও এই কনসার্টে অংশ নিয়েছিলেন। কনসার্টটির একটি লাইভ অ্যালবাম ও একটি চলচ্চিত্র পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান
সম্পাদনাবাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামী জনগণের সাহায্যার্থে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ারে ১৯৭১-এর ১ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয় দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। এ আয়োজনের সঙ্গে যাঁরা সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের অন্যতম ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ। কনসার্টে অনেকের মধ্যে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন জর্জ হ্যারিসন, তার গানের শিরোনাম ‘বাংলাদেশ’। এ গানের জন্য তৈরি হয়েছিল ‘বাংলাদেশ ধুন’ নামক নতুন সুর। ‘বাংলাদেশ ধুন’ যুগলবন্দি বাদনে রবিশঙ্করের সঙ্গে আলী আকবর খাঁ সেদিন অসাধারণ পারঙ্গমতা প্রকাশ করেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-তনয় হিসেবে সঙ্গীত-সাধনায় আত্মমগ্ন আলী আকবর জন্মভূমির দুর্গতি মোচনে সেদিন উদগ্রীব হয়েছিলেন। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে, যে অনুষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছিল। এ কনসার্টের প্রাপ্ত অর্থ বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ইউনিসেফের শরণার্থী ফান্ডে দান করা হয়।
মৃত্যু
সম্পাদনাতিনি ২০০৯ সালের ১৯ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রানসিসকোতে মৃত্যুবরণ করেন। [১]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা