আদিগঙ্গা

ভারতের নদী

আদিগঙ্গা (অন্যান্য নাম গোবিন্দপুর খাঁড়ি বা সারম্যানের নালা বা টালির নালা) হল পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাদক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত একটি ছোট নদী। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই নদীটিই ছিল হুগলি নদীর প্রধান ধারা। পরে এই ধারাটি ক্ষীণ হয়ে আসে।[]

আদিগঙ্গা
গোবিন্দপুর খাঁড়ি, সারম্যানের নালা, টালির নালা
কলকাতার টালিগঞ্জে আদিগঙ্গা
অবস্থান
দেশ ভারত
রাজ্যপশ্চিমবঙ্গ
জেলাকলকাতা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য
উৎসহুগলী নদী
 • অবস্থানকলকাতা
 • স্থানাঙ্ক২২°৩২′৫৯″ উত্তর ৮৮°১৯′৩১″ পূর্ব / ২২.৫৪৯৭২২° উত্তর ৮৮.৩২৫২৭৮° পূর্ব / 22.549722; 88.325278
মোহনা 
 • অবস্থান
বঙ্গোপসাগর

ইতিহাস

সম্পাদনা
 
আদিগঙ্গার তীরে কালীঘাট মন্দির, কলকাতা

ভাগীরথী-হুগলী খাতে প্রবাহিত গঙ্গা নদীর নিম্ন প্রবাহটি একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যেমন ছিল, তেমনটি আগে ছিল না। ব্যান্ডেলের কাছে ত্রিবেণীতে এটি তিনটি শাখায় ভাগ হয়ে যেত। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সপ্তগ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যেত সরস্বতী নদী। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বয়ে যেত যমুনা নদী[টীকা ১] মাঝখান দিয়ে বইত হুগলি নদী। এখন যেখানে কলকাতা শহর সেখানে হুগলি বাঁক নিত এবং কালীঘাট, বারুইপুর ও মগরা হয়ে সমুদ্রে গিয়ে মিশত। এই আদি খাতটিকেই বলা হয় আদিগঙ্গা।[]

ষোড়শ শতাব্দীর আগে গঙ্গার মূল স্রোতটি সরস্বতী নদীর খাতে বইত। ষোড়শ শতাব্দী থেকে এটি হুগলির খাতে বইতে শুরু করে। সরস্বতী নদীর উচ্চ প্রবাহটি এখন শুকিয়ে গেছে। হুগলি আদিগঙ্গাকে ত্যাগ করে এখন সরস্বতীর নিম্ন প্রবাহটি ধরে সমুদ্রে মিশছে।[]

বিপ্রদাস পিপলাই তাঁর মনসাবিজয় (মনসামঙ্গল) কাব্যে চাঁদ সদাগরের যাত্রাপথের বর্ণনায় চিৎপুর, বেতড়, কালীঘাট, চূড়াঘাট, বারুইপুর, ছত্রভোগ, বদ্রিকুণ্ড, হাথিয়াগড়, চৌমুখি, সাতামুখি ও সাগরসঙ্গমের (সাগর দ্বীপ) নাম উল্লেখ করেছেন। বিপ্রদাস পিপলাইয়ের বর্ণনার সঙ্গে ভ্যান ডেন ব্রুকের ১৬৬০ সালে আঁকা আদিগঙ্গার মানচিত্রটি হুবহু মিলে যায়।[]

কোনো কোনো মতে, অতীতে আদিগঙ্গার ধারাটি শুকিয়ে যাওয়ায় কৃত্রিম খালের সাহায্যে সরস্বতীর নিম্ন প্রবাহের সঙ্গে সেটিকে যুক্ত করে রাখা হয়েছিল, যাতে সমুদ্রগামী জাহাজগুলি আদিগঙ্গা ধরে সমুদ্রে উপনীত হতে পারে। বাংলার নবাব আলিবর্দী খান এই ব্যাপারে অবহিত ছিলেন বলে জানা যায়।[] অন্য মতে, আদিগঙ্গা যেখানে গঙ্গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে সেখানে গঙ্গা ও সরস্বতীর মোহনার কাছে একটি জোয়ারের জলে পুষ্ট খাঁড়ি ছিল। জনশ্রুতি অনুযায়ী, ওলন্দাজ বণিকরা জাহাজ চলাচলের সুবিধার জন্য এই খাঁড়িটি বিভক্ত করেছিল।[]

অষ্টাদশ শতাব্দীতে আদিগঙ্গা আদি কলকাতার অন্যতম বসতি গোবিন্দপুর গ্রামের দক্ষিণ সীমা নির্দেশ করত। এই জন্য সেই সময় এই নদীর নামকরণ হয় "গোবিন্দপুর খাঁড়ি"। এডওয়ার্ড সারম্যান খননকাজ চালিয়ে এটির সংস্কার করেন বলে কিছুকালের জন্য এর নাম হয় "সারম্যানের নালা"। ১৭১৭ সালের দিল্লিতে কোম্পানি দৌত্যের সময় সারম্যান ছিলেন দূতদলের নেতা। ১৭৭৩ সালে কর্নেল উইলিয়াম টালি নালাটিকে আরও গভীর করে সার্কুলার খালের সঙ্গে যুক্ত করেন। তারপর এর নাম হয় "টালির নালা"।[] ১৭৭৫ সালে কর্নেল টালি আদিগঙ্গার সঙ্গে বিদ্যাধরী নদীর যোগ স্থাপন করেন।[]

কর্নেল টালির সংস্কারের পর আদিগঙ্গা আবার নৌপরিবহন-যোগ্য হয়ে ওঠে। তবে পরবর্তীকালে মানুষের মধ্যে জলপথ ব্যবহারের প্রবণতা কমে যায়। দ্রুত নগরায়ণের ফলে আদিগঙ্গার গভীরতা কমে যায়। শেষ পর্যন্ত এটি দক্ষিণ-পশ্চিম কলকাতার একটি নিকাশী নালায় পরিণত হয়। নগরায়ণের ফলে কিছু কিছু অংশে আদিগঙ্গা প্রায় শুকিয়ে গিয়েছে।[]

বর্তমান অবস্থা

সম্পাদনা
 
আদিগঙ্গা
 
নেতাজি মেট্রো স্টেশন, নীচে আদি গঙ্গার ওপর কংক্রিটের পিলারের সাহায্যে দাঁড়িয়ে আছে

এখন টালিগঞ্জ, আজাদগড়, রানিকুঠি, নেতাজিনগর, আলিপুর, বাঁশদ্রোণী, নাকতলা, রথতলা, বৈষ্ণবঘাটা, গড়িয়া, বোড়াল, মহামায়াতলা, নরেন্দ্রপুর, রাজপুর, হরিনাভি, কোদালিয়া, চাঙারিপোতার (অধুনা সুভাষগ্রাম) মধ্যে দিয়ে আদিগঙ্গা প্রবাহিত। এই পর্যন্ত আদিগঙ্গা "টালির নালা" নামেও পরিচিত। এর পর মাহিনগর ও বারুইপুর (আগে অতিসারা গ্রাম) হয়ে এটি পৌঁছেছে জয়নগর মজিলপুরে। শেষপর্যন্ত আদিগঙ্গা মিশেছে বঙ্গোপসাগরে[]

কলকাতা মেট্রো লাইন ১-এর দমদম থেকে মহানায়ক উত্তমকুমার (টালিগঞ্জ) স্টেশন পর্যন্ত উক্ত দুটি স্টেশন ছাড়া রেলপথের পুরোপুরিই ভূগর্ভস্থ। গড়িয়া পর্যন্ত দক্ষিণে যে ৮.৫ কিলোমিটার (৫.৩ মা) পথ পরে সম্প্রসারিত করা হয়, সেটি পুরোপুরিই উড়াল পথে হয়। এই উড়ালপথটি আদিগঙ্গার পাশে ও আদিগঙ্গার উপরে অবস্থিত। এই সম্প্রসারিত অংশের ছয়টি স্টেশনের মধ্যে পাঁচটিই উড়ালপথে অবস্থিত। এই লাইনটি আদিগঙ্গার উপর থামের উপর অবস্থিত। সমাজকর্মীদের মতে, আদিগঙ্গার উপর এই নির্মাণকাজ আদিগঙ্গার শুকিয়ে যাওয়াকে ত্বরান্বিত করবে।[]

কলকাতার নাগরিকেরা একাধিক উপায়ে আদিগঙ্গার পরিবেশ রক্ষায় তৎপর হয়েছেন। আদিগঙ্গার পুনরুজ্জীবনের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে।[][]

  1. এই নদীটির সঙ্গে উত্তর ভারতের যমুনা নদী বা বাংলাদেশের যমুনা নদীর কোনো সম্পর্ক নেই।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. রায়, নিহাররঞ্জন (২০০৫)। বাঙালীর ইতিহাস, আদি পর্ব। কলকাতা: দেজ পাবলিশিং। পৃষ্ঠা ১২৬। আইএসবিএন 81-7079-270-3 
  2. Majumdar, Dr. R.C., History of Ancient Bengal, First published 1971, Reprint 2005, pp. 2-3, Tulshi Prakashani, Kolkata, আইএসবিএন ৮১-৮৯১১৮-০১-৩.
  3. রায়, নিহাররঞ্জন (২০০৫)। বাঙালীর ইতিহাস, আদি পর্ব। কলকাতা: দেজ পাবলিশিং। পৃষ্ঠা ৭৬। আইএসবিএন 81-7079-270-3 
  4. বন্দ্যোপাধ্যায়, দিলীপ কুমার (২০০২)। ভারতের নদী। কলকাতা: ভারতী বুক স্টল। পৃষ্ঠা ৬৯। 
  5. Chakraborty, Satyesh C.। "The Story of River Port"। Kolkata Port Trust। ২০১১-০৭-২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-১২-১০ 
  6. Cotton, H.E.A., Calcutta Old and New, 1909/1980, pp.35, 226, General Printers and Publishers Pvt. Ltd.
  7. Ray, Mohit। "Save our heritage river: Adi Ganga"Save Adi Ganga। geocities.com। ২০০৮-০২-২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-১২-১০ 
  8. Das, Soumitra (২০০৯-০৭-০৫)। "River of time"The Telegraph। Calcutta, India। ২০১৮-০৩-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-১০-২৬ 
  9. "Citizen's voice for Adi Ganga"An appeal। geocities.com। ২০০৮-১২-০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-১২-১০ 

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা
  •   উইকিমিডিয়া কমন্সে আদিগঙ্গা সম্পর্কিত মিডিয়া দেখুন।