সাম্রাজ্যবাদ
সাম্রাজ্যবাদ হলো পররাজ্যের উপর অধিকার বিস্তারের নীতি।[২] এটিকে প্রায় নঞর্থকভাবে বিবেচনা করা হয়, যেহেতু এতে স্থানীয় জনগণকে শোষণের মাধ্যমে অল্প আয়াসে ধনী হবার উদ্দেশ্য থাকে।
আধুনিককালে এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয় যে উপনিবেশবাদ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের বহিঃপ্রকাশ এবং পরেরটি ছাড়া তার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। বিদ্যমান বৈধ উপনিবেশ ছাড়া "অনানুষ্ঠানিক" সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে ঐতিহাসিকদের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয়।[৩]
শিল্প পুঁজিবাদ থেকে সাম্রাজ্যবাদ
সম্পাদনাবিগত উনিশ শতকে পুঁজিবাদ বিকাশলাভ করে এবং দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে; অবশেষে সারা দুনিয়া দখল করে ফেলে। পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সাথে তার যন্ত্রণাকর দ্বন্দ্বগুলো ক্রমশ বেশি করে প্রকট ও তীব্র হয়ে ওঠে। ঐ সময়ে পুঁজিবাদী বিকাশের অগ্রভাগে ছিলো শিল্পপুঁজি। এই জন্য ঐ যুগটাকে বলা হয় শিল্পপুঁজির বা শিল্পপুঁজিবাদের যুগ। শিল্প পুঁজিবাদের মৌলিক দ্বন্দ্বগুলির বৃদ্ধি ও বিকাশের ফলে পুঁজিবাদের বিকাশে এক নতুন পর্যায় দেখা দিলো যার নাম সাম্রাজ্যবাদ। পুঁজিবাদের বিকাশে এক নতুন ও উচ্চতর পর্যায়রূপে বিংশ শতাব্দীর গোড়াতেই সাম্রাজ্যবাদ দেখা দেয়। পুঁজিবাদের সমস্ত মৌলিক দ্বন্দ্বগুলো সাম্রাজ্যবাদে তীব্র হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যবাদ হলও মরণোন্মুখ পুঁজিবাদ। সাম্রাজ্যবাদে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা সমাজের আরো বিকাশের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।[৪]
সাম্রাজ্যবাদের উৎপত্তির তত্ত্ব
সম্পাদনা১৮৭০ সালের পর সাম্রাজ্যবাদের বিস্ফোরণের জন্য পণ্ডিতেরা নানাবিধ কারণ দেখান। ব্রিটিশ অর্থনৈতিক তাত্ত্বিক জে. এ. হবসন সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। হবসন বলেন যে নব্য সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে কোনো উচ্চতর লক্ষ্য ছিলো না। অর্থনৈতিক লক্ষ্যই ছিলো এই নব্য উপনিবেশবাদের মূল। হবসনের মতে, এই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় পুঁজিবাদীরা মুনাফা ভোগ করে বহু মূলধন জমা করে। এর ফলে মূলধনের পাহাড় জমে যায়। এই মূলধন উপনিবেশে বিনিয়োগ করে আরো মুনাফা বৃদ্ধির জন্য পুঁজিপতিরা তাদের নিজ দেশের সরকারকে উপনিবেশ দখলে বাধ্য করে। উপনিবেশের নতুন শিল্পে মূলধন লগ্নি করে পুঁজিপতি শ্রেণি মুনাফার পাহাড় জমায়। উপনিবেশের কাঁচামাল ও বাজারকে একচেটিয়া দখল করে তারা ফুলে ফেঁপে ওঠে। সুতরাং নব্য সাম্রাজ্যবাদের মূল অর্থনৈতিক শিকড় ছিলো উপনিবেশে লগ্নির জন্য "বাড়তি মূলধনের চাপ"। অর্থাৎ বাড়তি মূলধনের চাপই সাম্রাজ্য বা উপনিবেশ দখলের মূল কারণ।[৫]
বিখ্যাত সাম্যবাদী নেতা ভ্লাদিমির লেনিন, তার সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায় নামক গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাকে আরো বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। তার মতে, পুঁজিবাদের ভেতরেই সাম্রাজ্যবাদের বীজ নিহিত আছে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর বৈদেশিক নীতি পুঁজিবাদের স্বার্থেই পরিচালিত হয়। অধিক মুনাফার আশায় শিল্প মালিকরা দেশের লোকের প্রয়োজন অপেক্ষা বাড়তি পণ্য উৎপাদন করে। এই বাড়তি পণ্য বিক্রয় ও সস্তায় কাঁচামাল পাওয়ার জন্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র উপনিবেশ দখল করে। বিশ্বে উপনিবেশের সংখ্যা সীমিত। পুঁজিবাদী দেশগুলো উপনিবেশ দখলের চেষ্টা করায় বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও যুদ্ধ আরম্ভ হয়। যুদ্ধ হলও পুঁজিবাদী অর্থনীতির চূড়ান্ত পরিণতি। লেনিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে বিভিন্ন পুঁজিবাদী শক্তির উপনিবেশ দখলের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে দায়ী করেন।[৫] সাম্রাজ্যবাদের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ তিনি চালিয়ে যান আরো অনেক রচনায়। বিপুল বাস্তব তথ্য আর তাত্ত্বিক মালমসলার সার্বিকীকরণ করে তিনি অতি গুরুত্বপূর্ণ এই বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে আসেন যে সাম্রাজ্যবাদের যুগে পুঁজিবাদের বিকাশ অসমান এবং উল্লম্ফনধর্মী, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বিজয় লাভ করতে পারে প্রথমে অল্প কয়েকটি, এমনকি পৃথক একটি পুঁজিবাদী দেশেও। বিশ্ব বৈপ্লবিক আন্দোলনের কাছে এ সিদ্ধান্তের গুরুত্ব অসাধারণ বিপুল।[৬]
সাম্রাজ্যবাদের যুগ
সম্পাদনাসাম্রাজ্যবাদ প্রতিদ্বন্দ্বী একচেটিয়া পুঁজিপতিদের এবং রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের তীব্রতা ভয়ংকরভাবে বৃদ্ধি করে এবং এর পরিণতিতেই দেখা দেয় যুদ্ধ। বিংশ শতাব্দীর গোড়াতেই সাম্রাজ্যবাদীরা পৃথিবীকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়ার কাজ সমাপ্ত করেছিল। পৃথিবী অশেষ নয়, আর মানুষ তখনো মহাকাশে পাড়ি জমায়নি। তাই প্রসারের নতুন ক্ষেত্র আর দেখা গেলো না, কাজেই পৃথিবী পুনঃবণ্টনের সংগ্রামের প্রশ্নটিই সামনে এসে দাঁড়াল। নিজেদের মধ্যে দেশ ও বাজার নিয়ে কাড়াকাড়ি ছাড়া বৃহৎ শক্তিগুলোর আর কোনো উপায় থাকল না। তাই দেখা দিলো প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদের যুগে বরাবরই কোনো কোনো সাম্রাজ্য চেষ্টা করতে থাকবে অপরকে জব্দ করে নিজেদের সুবিধামতো পৃথিবী নতুনভাবে ভাগ করে নিতে বিশ্বযুদ্ধ বা মহাযুদ্ধ তাই অনিবার্য এবং এ যুদ্ধ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। প্রথম মহাযদ্ধে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যুদ্ধের এইরূপই দেখা যায়।[৭]
সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্ব
সম্পাদনাঅ্যাংলোফোন একাডেমিকগণ প্রায়শই সাম্রাজ্যবাদকে ব্রিটিশদের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে তাদের সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত তত্ত্বগুলি পাঠ করে। সাম্রাজ্যবাদ শব্দটি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন ডিসরেইলির আগ্রাসী ও সাম্রাজ্যবাদী নীতিকে অভিযুক্ত করতে বিরোধীদের দ্বারা ১৮৭০ এর দশকের শেষের দিকে তার বর্তমান অর্থেই ইংরেজিতে প্রচলিত হয়েছিল। জোসেফ চেম্বারলাইনের মতো "সাম্রাজ্যবাদ" এর সমর্থকরা এই ধারণাটি দ্রুত প্রয়োগ করেছিলেন।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ S. Gertrude Millin, Rhodes, London: 1933, p.138.
- ↑ শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক অভিধান; ঢাকা; ডিসেম্বর, ২০০০; ৩য় সংস্করণ পৃষ্ঠা-১১৪৬
- ↑ Barbara Bush (২০০৬)। Imperialism And Postcolonialism। Pearson Longman। পৃষ্ঠা 46। আইএসবিএন 978-0-582-50583-4। সংগ্রহের তারিখ ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১২।
- ↑ এ. লিয়েনতিয়েভ, মার্কসীয় অর্থনীতি, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, সেপ্টেম্বর, ২০১৪, পৃষ্ঠা-১৬৮।
- ↑ ক খ প্রভাতাংশু মাইতি, ইউরোপের ইতিহাসের রূপরেখা, শ্রীধর প্রকাশনী, কলকাতা, ফেব্রুয়ারি, ২০০৭, পৃষ্ঠা, ৩৯৩-৩৯৫
- ↑ ভ. বুজুয়েভ ও ভ. গরোদনভ, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা-৪৮-৪৯।
- ↑ পার্থ ঘোষ, মার্কসবাদের কথা প্রসঙ্গে, বোধি, ঢাকা, ২০০৮, পৃষ্ঠা-৭৪-৭৫।
আরো পড়ুন
সম্পাদনা- Guy Ankerl, Coexisting Contemporary Civilizations: Arabo-Muslim, Bharatai, Chinese, and Western, Geneva, INU PRESS, 2000, আইএসবিএন ২-৮৮১৫৫-০০৪-৫.
- Robert Bickers/Christian Henriot, New Frontiers: Imperialism's New Communities in East Asia, 1842–1953, Manchester, Manchester University Press, 2000, আইএসবিএন ০-৭১৯০-৫৬০৪-৭
- Leo Blanken, Rational Empires: Institutional Incentives and Imperial Expansion, University Of Chicago Press, 2012
- Barbara Bush, Imperialism and Postcolonialism (History: Concepts,Theories and Practice), Longmans, 2006, আইএসবিএন ০-৫৮২-৫০৫৮৩-৬
- John Darwin (author), After Tamerlane: The Rise and Fall of Global Empires, 1400–2000, Penguin Books, 2008.
- Richard B. Day and Daniel Gaido (ed. and trans.), Discovering Imperialism: Social Democracy to World War I. Chicago: Haymarket Books, 2012.
- Niall Ferguson, Empire: How Britain Made the Modern World, Penguin Books, 2004, আইএসবিএন ০-১৪-১০০৭৫৪-০
- Michael Hardt and Toni Negri, Empire, Harvard University Press, 2000, আইএসবিএন ০-৬৭৪-০০৬৭১-২
- E.J. Hobsbawm, The Age of Empire, 1875–1914, Abacus Books, 1989, আইএসবিএন ০-৩৪৯-১০৫৯৮-৭
- E. J. Hobsbawm, On Empire: America, War, and Global Supremacy, Pantheon Books, 2008, আইএসবিএন ০-৩৭৫-৪২৫৩৭-৩
- J. A. Hobson, Imperialism: A Study, Cosimo Classics, 2005, আইএসবিএন ১-৫৯৬০৫-২৫০-৩
- Michael Hudson, Super Imperialism: The Origin and Fundamentals of U.S. World Dominance, Pluto Press, 2003, আইএসবিএন ০-৭৪৫৩-১৯৮৯-০
- Hodge, Carl Cavanagh. Encyclopedia of the Age of Imperialism, 1800-1914 (2 vol. 2007)
- Page, Melvin E. et al. eds. Colonialism: An International Social, Cultural, and Political Encyclopedia (2 vol 2003)
- Pakenham, Thomas. The Scramble for Africa: White Man's Conquest of the Dark Continent from 1876-1912 (1992)
- Petringa, Maria, Brazza, A Life for Africa, Bloomington, IN: AuthorHouse, 2006. আইএসবিএন ৯৭৮-১-৪২৫৯-১১৯৮-০
- Edward Said, Culture and Imperialism, Vintage Books, 1998, আইএসবিএন ০-০৯-৯৯৬৭৫০-২
- Simon C. Smith, British Imperialism 1750–1970, Cambridge University Press, 1998, আইএসবিএন ০-৫২১-৫৯৯৩০-X
- Benedikt Stuchtey, Colonialism and Imperialism, 1450-1950, European History Online, Mainz: Institute of European History, 2011
প্রাথমিক উৎসসমূহ
সম্পাদনা- ভ্লাদিমির লেনিন, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়, International Publishers, New York, 1997, আইএসবিএন ০-৭১৭৮-০০৯৮-৯
- রোসা লুক্সেমবুর্গ, The Accumulation of Capital: A Contribution to an Economic Explanation of Imperialism
বহিসংযোগ
সম্পাদনা- J.A Hobson, Imperialism a Study 1902.
- The Paradox of Imperialism ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১ মে ২০০৯ তারিখে by Hans-Hermann Hoppe. November 2006.
- Imperialism Quotations
- State, Imperialism and Capitalism by Joseph Schumpeter
- Economic Imperialism by A.J.P.Taylor
- Imperialism Entry in the Columbia Encyclopedia (Bartleby)
- [১] Imperialism by Emile Perreau-Saussine
- Mehmet Akif Okur, Rethinking Empire After 9/11: Towards A New Ontological Image of World Order, Perceptions, Journal of International Affairs, Volume XII, Winter 2007, pp.61–93