হেনা দাস
হেনা দাস (জন্ম:ফেব্রুয়ারি ১২, ১৯২৪ - মৃত্যু:জুলাই ২০, ২০০৯) হলেন বাংলার নারী জাগরণে যে ক'জন নারী তাদের সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে বিশেষ অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। ব্রিটিশ-বিরোধী-আন্দোলন, ভাষা-আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ বাংলাদেশের সকল ক্রান্তিলগ্নে তিনি সক্রিয় ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশনেরও অন্যতম সদস্য ছিলেন।
হেনা দাস | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | জুলাই ২০, ২০০৯ | (বয়স ৮৫)
নাগরিকত্ব | ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত) পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে) বাংলাদেশ |
পেশা | বাঙ্গালি সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্করক |
পরিচিতির কারণ | সাম্যবাদী আন্দোলনের ব্যক্তি |
উল্লেখযোগ্য কর্ম | চার পুরুষের কাহিনী, স্মৃতিময় দিনগুলো |
রাজনৈতিক দল | বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি |
আন্দোলন | ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম |
সন্তান | দীপা ইসলাম, চম্পা জামান |
পিতা-মাতা |
|
পুরস্কার | রোকেয়া পদক |
জীবনী
সম্পাদনাজন্ম, মৃত্যু এবং পারিবারিক পরিচয়
সম্পাদনা১৯২৪ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি হেনা দাস সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সতীশচন্দ্র দত্ত একজন স্বনামধন্য আইনজীবী এবং মা মনোরমা দত্ত ছিলেন চুনারুঘাট থানার নরপতি গ্রামের জমিদার জগত্চন্দ্র বিশ্বাসের বড়ো মেয়ে। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে হেনা দাস সর্ব কনিষ্ঠ। দীর্ঘ দিন বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি রোববার সকালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্যুবরণ করেন।[১]
শিক্ষা জীবন
সম্পাদনাসিলেট সরকারি বালিকা বিদ্যালয় শিশু শ্রেণীতে ভর্তির মাধ্যমে হেনা দাস প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। ১৯৪০ সালে এ স্কুল থেকেই মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪২ সালে তিনি প্রথম বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর কয়েক বছর রাজনীতির জন্য লেখাপড়া বন্ধ থাকে। নানা রাজনৈতিক প্রতিকূলতা কাটিয়ে দীর্ঘদিন পর তিনি আবার পড়াশোনা শুরু করেন এবং ১৯৪৭ সালে বিএ পাস করেন। শিক্ষকতা করার সময় তিনি ময়মনসিংহ মহিলা ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ১৯৬৫ সালে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এমএ প্রথমপর্ব এবং ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে চতুর্থ হয়ে স্নাতকত্তোর ডিগ্রি লাভ করেন।
বিয়ে ও ছেলেমেয়ে
সম্পাদনাহেনা দাস যখন পুরোপুরি রাজনীতিতে সক্রিয় এবং পার্টির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন; সে সময় তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ অসুস্থ বাবার অনুরোধ রাখতে তিনি বিয়ের জন্য রাজি হন৷ বিয়ে ঠিক হয় পার্টির সক্রিয় কর্মী কমরেড রোহিনী দাসের সাথে৷ তিনি ছিলেন সিলেট জেলা কৃষক আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা৷ রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকায় বর ও কনেকে গোপনে কলকাতায় চলে যেতে হয় এবং ১৯৪৮ সালের ২৮ জুন ঘরোয়াভাবে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়৷ বিয়ের পর পার্টির নির্দেশে হেনা দাস ও রোহিনী দাস অনেকদিন আত্মগোপন করে ছিলেন৷ ১৯৮৭ সালের ৩ জানুয়ারি রোহিনী দাস পরলোকগমন করেন৷
তার দুই মেয়ে৷ বড় মেয়ে দীপা ইসলাম (বুলু) স্বনামধন্য গাইনোকোলোজিস্ট এবং ছোট মেয়ে চম্পা জামান কম্পিউটার সায়েন্সে ডিগ্রি অর্জন করেছেন৷
রাজনীতিতে হেনা দাস
সম্পাদনাসপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই হেনা দাস ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে, সশস্ত্র বিপ্লোবী আন্দোলনে প্রভাবিত হন।[২] ১৯৩৮ এ তিনি ছাত্র ফেডারেশন নামে ছাত্রসংগঠনের যোগ দেন। ১৯৪৮ - ১৯৪৯ এ তিনি নানাকার আন্দোলনে নানাকার মেয়েদের সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকায় শিক্ষকতা শুরু করেন এবং শিক্ষক সমিতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে বহু আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতে চলে যান এবং উদ্বাস্তু শিক্ষকদের সাথে রিলিফের কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৭৮ সাল থেকে পরবর্তী ১৪ বছরে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সহ আরও বিভিন্ন পদে নির্বাচিত হয়ে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ডঃ কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন। হেনাদাস ১৯৮৯ সালে চাকুরি থেকে অবসর নেন। হেনা দাস বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ২০০০ সালের ২২ জানুয়ারি মহিলা পরিষদের সভানেত্রী নির্বাচিত হন।
কর্মজীবন
সম্পাদনাসমাজ সংগ্রামী নারী হেনা দাসের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল প্রথাগত কাজের মাধ্যমে নয়, মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনই ছিল তার প্রধান কাজ। রাজনৈতিক কারণে আত্মগোপন অবস্থায় থেকে তিনি দীর্ঘদিন কোনো পেশায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি। কিন্তু সন্তানের কথা চিন্তা করে তিনি চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেন। অবশেষে ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকার "গেণ্ডারিয়া মনিজা রহমান বালিকা বিদ্যালয়ে" শিক্ষকতার চাকরি নেন। সে সময় তার মাসিক বেতন ছিল ১১৫ টাকা। বিএড ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৬১ সালে তিনি প্রধান শিক্ষিকা পদে "নারায়ণগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয়ে" নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এরপর "মহাখালী ওয়ারলেস স্টেশন স্কুলে"-ও তিনি কিছুদিন প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন। প্রায় তিন যুগ শিক্ষকতার পর হেনা দাস ১৯৮৯ সালে শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
সম্মাননা ও স্বীকৃতি
সম্পাদনারাষ্ট্রীয়ভাবে তিনি 'রোকেয়া পদকে' সম্মানিত হয়েছেন। এছাড়া সুনামগঞ্জ পৌরসভা, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ঢাকেশ্বরী মন্দির, নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট, আহমেদ শরীফ ট্রাস্টসহ তিনি বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননা পেয়েছেন। রাজশাহীর একটি প্রতিষ্ঠান হেনা দাসের ওপর একটি অডিওভিজু্য়াল ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে। নারীপক্ষ ও নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা থেকে প্রকাশিত দুটি বই-এ হেনা দাসের সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি সাহিত্য প্রকাশের মফিদুল হক 'মাতৃমুক্তি পথিকৃৎ' নামে তার জীবনের উপর একটি বই প্রকাশ করেন।
প্রকাশনা
সম্পাদনাহেনা দাস কেবল একজন সাহসী সংগ্রামী ও সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বই নন, তিনি একজন কলম সৈনিকও বটে। ইতোমধ্যে হেনা দাসের অর্ধডজন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।[৩] বইগুলো হলো:
- উজ্জ্বল স্মৃতি'
- শিক্ষা ও শিক্ষকতা জীবন
- স্মৃতিময় দিনগুলো
- নারী আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা
- স্মৃতিময়-'৭১ এবং
- চার পুরুষের কাহিনী
হেনা দাস তার আত্মজীবনী লিখেছেন 'চার পুরুষের কাহিনী' শিরোনামের বইটিতে।
এছাড়া বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে হেনা দাসের লেখা বিভিন্ন কলাম ও প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। এসব লেখা নিয়ে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে 'প্রবন্ধ সংকলন' শিরোনামে আরেকটি বই।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ বাংলাদেশের নারী নেত্রী হেনা দাসের মৃত্যু ডয়চে ভেলে
- ↑ হেনা দাসের আদর্শ আত্মস্থ করতে হবে ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২১ জুন ২০১৭ তারিখে প্রথম আলো
- ↑ জন্মবার্ষিকীতে হেনা দাসের প্রতি শ্রদ্ধা ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে বিডি নিউজ২৪