হরবিজয়
হরবিজয় হল রত্নাকর রচিত একটি সংস্কৃত মহাকাব্য। এই কাব্যের উপজীব্য শিব কর্তৃক অন্ধকাসুর বধ। সেই সঙ্গে এই কাব্যে শিবের মূর্তিবৈশিষ্ট্যগুলির বর্ণনা এবং শৈব দর্শনের একটি ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। হরবিজয় সংস্কৃত ভাষায় এখনও বিদ্যমান দীর্ঘতম মহাকাব্য, যা পঞ্চাশটি সর্গে বিন্যস্ত মোট ৪৩৫১টি শ্লোকে রচিত।
রচয়িতা
সম্পাদনাহরবিজয় কাব্যের প্রশস্তি অংশে, রচয়িতা রত্নাকর নিজেকে গঙ্গাহ্রদের দুর্গাদত্তের বংশধর অমৃতভানুর পুত্র বলে উল্লেখ করেছেন। কলহনের রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থে কথিত হয়েছে, অবন্তীবর্মণের রাজত্বকালে (রাজত্বকাল: ৮৫৫-৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ) রত্নাকর খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু হরবিজয় গ্রন্থের ভণিতাগুলি থেকে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে কাব্যটি ৮২৬ থেকে ৮৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে চিপ্পট জয়াপীড়ের রাজত্বকালের রচিত। কাব্যের বিষয়বস্তু থেকে অনুমান করে নেওয়া যায় যে, রত্নাকর ছিলেন কাশ্মীর শৈবধর্মের অনুগামী। অ্যালেক্সিস স্যান্ডারসন বলেছেন যে, এই কাব্যের ৬ষ্ঠ ও ৪৭শ সর্গে শিব ও পার্বতীর উদ্দেশ্যে রচিত স্ত্রোত্রগুলি কাশ্মীর অঞ্চলে মন্ত্রমার্গীয় শৈবধর্মের উপস্থিতির আদিতম তারিখায়নযোগ্য প্রমাণ।[১] হরবিজয় ছাড়া রত্নাকর বক্রোক্তিপঞ্চাশিকা নামে শিব ও পার্বতীর কথোপকথন-ভিত্তিক পঞ্চাশ শ্লোকের আরেকটি কাব্যও রচনা করেছিলেন। এই কাব্যটিতে তিনি বক্রোক্তি অর্থাৎ "শব্দকৌতুকপূর্ণ কথোপকথন"-এর রীতিটির প্রয়োগ ঘটান।[২] সম্ভবত হরবিজয় ছাড়া তাঁর এই বক্রোক্তিপঞ্চাশিকা-ই একমাত্র সংরক্ষিত অপর রচনা।[৩]
সার-সংক্ষেপ
সম্পাদনাহরবিজয় হল এখনও বিদ্যমান দীর্ঘতম সংস্কৃত মহাকাব্য, এটি পঞ্চাশটি সর্গে বিন্যস্ত মোট ৪৩৫১টি শ্লোকে রচিত।[৪] এই কাব্যের আখ্যানভাগের বিষয় শিব-কর্তৃক অন্ধকাসুর বধ। মহাকাব্যের প্রথাসিদ্ধ রীতি অনুযায়ী, এই কাব্যে প্রকৃতি, ঋতু, প্রেম ও একটি যুদ্ধ সহ জীবনের বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে। সেই সঙ্গে ৬ষ্ঠ সর্গে শিবের মূর্তিবৈশিষ্ট্যের বর্ণনা এবং শৈব দর্শনের একটি ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। হরবিজয় সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যের এক পরবর্তী পর্যায়ে রচিত। এই কাব্যে কবির জ্ঞানের পরিচয় এবং কাব্যকলার উপর তাঁর দক্ষতার দিকটির উপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে। কাব্যের বিভিন্ন দিকের বর্ণনায় কবি বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে ধারণা ও পারিভাষিক শব্দগুলি স্বাধীনভাবে গ্রহণ করেছেন।[৫]
সম্মাননা
সম্পাদনাবিভিন্ন সংস্কৃত সংকলন গ্রন্থ এবং অলংকার শাস্ত্রে হরবিজয় প্রশংসিত হয়েছে।[৬] আধুনিক ভারতীয় সংস্কৃত পণ্ডিতেরাও এই গ্রন্থটিকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে থাকেন। রাজশেখর নিম্নলিখিত শ্লোকে রত্নাকরের প্রশংসা করেছেন:[৭]
মা স্ম সান্তি হি চত্বারঃ প্রায়ো রত্নাকরা ইমে
ইতীব স কৃতো ধাত্রা কবী রত্নাকরো 'পরাঃচার মহাসমুদ্র যথেষ্ট নয় ভেবে,
স্রষ্টা
আরেকটি মহাসমুদ্র সৃষ্টি করেছিলেন,
কবি রত্নাকর।— সূক্তিমুক্তাবলী ৪.৭৭, ডেভিড স্মিথ কৃত ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে
হরবিজয় কাব্যের ১৮৯০ সালের সংস্করণে পণ্ডিত দুর্গাপ্রসাদ ও কাশীনাথ পাণ্ডুরঙ্গ পরব একটি সমসাময়িক মতামত উদ্ধৃত করেছিলেন:[৮]
দুগ্ধাবধীনাং সহস্রং ন কুসুমলসিতং সদ্বসন্তায়ুতং বা
কোটির বা পার্বণানাং সুষমশাশভৃতাং নেষদোষাতনানাম্
সম্পূর্ণং বা সুধাভিঃ পুরটঘটশতং হন্ত ধ্বন্বন্তরেনো
পাণিষ্টং চারু রত্নাকর-সুকবিগিরাং মেরুলক্ষং ন মূল্যমসহস্র দুগ্ধ মহাসমুদ্র নয়,
পুষ্পশোভিত
দশ সহস্র বসন্ত ঋতুও নয়,
শরতের কোটি সুচন্দ্রও নয়,
ধ্বন্বন্তরির হস্তে
অমৃতপূর্ণ একশত সুন্দর সুবর্ণকলসও নয়,
না, শতসহস্র মেরুপর্বতও নয়,
সুকবি রত্নাকরের কাব্যের সমতুল্য।— সদাশিবশঙ্করশাস্ত্রী, ডেভিড স্মিথের ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে
টীকা
সম্পাদনাপিটার পাসেড্যাক হরবিজয় কাব্যের তিনটি টীকার নাম তালিকাভুক্ত করেছেন: অলকের বিষমপদোদ্দ্যোতা, রত্নকণ্ঠের লঘুপঞ্চিকা এবং উৎপলের হরবিজয়সারবিবরণ।[৯]
সংস্করণ
সম্পাদনা১৮৯০ সালে পণ্ডিত দুর্গাপ্রসাদ ও কাশীনাথ পাণ্ডুরঙ্গ পরব কাব্যমালা ধারাবাহিকের জন্য এই গ্রন্থের একটি সংস্করণ প্রস্তুত করেন। এই সংস্করণে ৪৬শ সর্গ পর্যন্ত অলকের টীকা সংযোজিত হয়। ১৮৯২ সালে গঙ্গানাথ ঝা কেন্দ্রীয় সংস্কৃত বিদ্যাপীঠের পাঠ্য ধারাবাহিকের জন্য ড. গোপরাজু রামা দুই খণ্ডে এই গ্রন্থের একটি সংস্করণ প্রস্তুত করেন। এটি ছিল একটি সমালোচনামূলক সংস্করণ, যার ভিত্তি ছিল গুরুত্বপূর্ণ পাঠান্তর সহ ছয়টি পাণ্ডুলিপি এবং এই সংস্করণে কোনও টীকা ছাড়াই রত্নাকর রচিত শ্লোকগুলি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।[১০]
- পণ্ডিত দুর্গাপ্রসাদ; কাশীনাথ পাণ্ডুরঙ্গ পরব, সম্পাদকগণ (১৯৮২)। দ্য হরবিজয় অফ রত্নাকর উইথ দ্য কমেন্টারি অফ রাজানক অলক। চৌখাম্বা সংস্কৃত সংস্থান। অজানা প্যারামিটার
|orig-date=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য) - গোপরাজু রামা, সম্পাদক (১৯৮২)। হরবিজয়ম বাই রাজানক রত্নাকর। রাষ্ট্রীয় সংস্কৃত সংস্থান।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনাতথ্যনির্দেশিকা
সম্পাদনা- ↑ পাসেড্যাক ২০১১, পৃ. ২।
- ↑ স্মিথ ১৯৮৫, পৃ. ২২।
- ↑ পাসেড্যাক ২০১১, পৃ. ২–৩: ধ্বনিগাথাপঞ্জিকা নামে অপর একটি রচনা, ওয়ার্ডারের মতে পরবর্তীকালে অন্য কোনও রত্নাকর রচনা করেছিলেন। স্মিথও এই গ্রন্থের রচয়িতা এবং হরবিজয় গ্রন্থের রত্নাকর এক ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। (মূল উদ্ধৃতি: "Another work called Dhvanigāthāpañjikā, according to [Warder(1988), pp. 157-158], appears to be by some later Ratnākara, also [Smith(1985), p.22] doubts the identy of its author with the one of the Haravijaya.")
- ↑ স্মিথ ১৯৮৫, p. ৩; পাসেড্যাক ২০১৭, p. ৪.
- ↑ পাসেড্যাক ২০১১, পৃ. ৩–৪।
- ↑ পাসেড্যাক ২০১৭, পৃ. ৫: মূল উদ্ধৃতি: "Ratnākara and his work found mention and praise in Sanskrit anthologies and works of alaṃkāraśāstra. [...] See S. K. Sharma 1990, Appendix II for a comprehensive list."
- ↑ পাসেড্যাক ২০১১, পৃ. ৬–৭।
- ↑ স্মিথ ১৯৮৫, পৃ. ৪।
- ↑ পাসেড্যাক ২০১১, পৃ. ৪–৬।
- ↑ পাসেড্যাক ২০১১, পৃ. ৭–৯।
গ্রন্থপঞ্জি
সম্পাদনা- শর্মা, সন্তোষ কুমারী (১৯৯০)। দ্য হরবিজয় অফ রত্নাকর (আ ক্রিটিসিজম)। বাঁকে বিহারী প্রকাশন।
- স্মিথ, ডেভিড (১৯৮৫)। রত্নাকর'স হরবিজয়: অ্যান ইনট্রোডাকশন টু দ্য সংস্কৃত কোর্ট এপিক। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। আইএসবিএন 0195617274।
- পাসেড্যাক, পিটার (২০১১)। দ্য হরবিজয় অফ রত্নাকর অ্যান্ড দ্য কমেন্টারিজ দেয়ারঅন বাই উৎপল অ্যান্ড রত্নকণ্ঠ: সর্গজ ১ অ্যান্ড ২ (পিডিএফ) (গবেষণাপত্র)। হ্যামবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়। সংগ্রহের তারিখ ১ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- পাসেড্যাক, পিটার (২০১৭)। ভগবতস্তুতিবর্ণন অর দ্য ডেসক্রিপশন অফ দ্য প্রেইজ অফ দ্য ডিভাইন: আ ক্রিটিক্যাল এডিশন অফ টেক্সট অ্যান্ড কমেন্টারিজ, অ্যান্ড অ্যানোটেড ট্রান্সলেশন অফ দ্য সিক্সথ ক্যান্টো অফ রত্নাকর'স হরবিজয় (পিডিএফ) (গবেষণাপত্র)। হ্যামবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়। সংগ্রহের তারিখ ১ সেপ্টেম্বর ২০২৪।