হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ
হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ (মার্চ ২৩, ১৯১৬ – আগস্ট ১ ২০০৮) একজন ভারতীয় কমিউনিস্ট নেতা। ১৯১৬ সনের ২৩ মার্চ পাঞ্জাবের জলন্ধর জেলার রোপোওয়াল গ্রামে এক জাঠ পরিবারে সুরজিৎ-এর জন্ম। তিনি কম্যুনিষ্ট ভাবধারার একজন ভারতীয় রাজনীতিবিদ, যিনি ১৯৬৪ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব (২০০৮ সাল) পর্যন্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-এর পলিটব্যুরোর সদস্য ও ১৯৯২ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।[১]
হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ | |
---|---|
সাধারণ সম্পাদক ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) | |
কাজের মেয়াদ ১৯৯২–২০০৫ | |
পূর্বসূরী | ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ |
উত্তরসূরী | প্রকাশ কারাত |
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | জলন্ধর,পাঞ্জাব, ব্রিটিশ ভারত | ২৩ মার্চ ১৯১৬
মৃত্যু | ১ আগস্ট ২০০৮ নৈডা, উত্তর প্রদেশ, ভারত | (বয়স ৯২)
রাজনৈতিক দল | ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) |
বাসস্থান | নয়া দিল্লী |
ধর্ম | শিখ |
August 01, 2008 অনুযায়ী উৎস: [৪] |
রাজনৈতিক জীবন
সম্পাদনাদলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে সুরজিত ১৯৯২ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-র কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে ২০০৫ সালে ৮৯ বছর বয়সে অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত অধিষ্ঠিত ছিলেন।
সুরজিতের আগে দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ। হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎই ভারতের সেই কমিউনিস্ট নেতা যার জন্য অ-কমিউনিস্ট, এমনকী দক্ষিণপন্থীদেরও অবারিতদ্বার ছিল। একেবারে নিচু তলার কৃষক আন্দোলন থেকে উঠে এসেছিলেন বলেই এই অনভিজাত কমিউনিস্ট অন্যান্য ভারতীয় রাজনীতিকের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য ছিলেন। কৈশোর থেকেই চারপাশে প্রবাহিত স্বাধীনতা সংগ্রামের আচ এসে লাগে, হয়ে পড়েন ভগৎ সিংহের অনুগামী। ১৯৩০ সালে ভগৎ সিংহের ‘নওজওয়ান ভারত সভা’য় যোগ দেন। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে হোসিয়ারপুর জেলা আদালত চত্বরে ভগৎ সিংহের মৃত্যুবার্ষিকীতে তেরঙ্গা ঝাণ্ডা তুলতে যান। গুলিবিদ্ধ হন। গ্রেফতারও। বিচারের জন্য আদালতে হাজির করলে অসীম ঔদ্ধত্যে নিজের নাম জানান— ‘লন্ডন তোড় সিংহ’!১৯৩৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।[১][২]
প্রথম থেকেই কৃষকদের সঙ্গে সুরজিৎ একাত্ম। পঞ্জাব কিসান সভার তিনি সহ-প্রতিষ্ঠাতা। পরে সর্বভারতীয় কিসান সভার সভাপতিও। কৃষি-মজদুর ইউনিয়নেও দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছেন। সে সময় ‘দুখি দুনিয়া’ ও ‘চিঙ্গারি’ নামে দুটি পত্রিকাও প্রকাশ করতে থাকেন। িদ্বতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতেই তিনি গ্রেফতার হন। মুক্তি পেতে পেতে স্বাধীনতা। তখন থেকেই অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির পঞ্জাব শাখার সম্পাদক। বেশ কয়েক বার গ্রেফতার হয়েছেন সুরজিৎ। সব মিলিয়ে বছর দশেক হাজতবাসও করতে হয়েছে, তার মধ্যে দু’বছর স্বাধীন ভারতের জেলে।
১৯৬৪ সনে কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙনের সময় থেকেই তিনি সি পি আই এম। তখন যে ন’জন নেতাকে নিয়ে দলের প্রথম পলিটব্যুরো গড়ে ওঠে, তিনি তাদের একজন। ক্রমে তার আরও উত্থান হয়। ১৯৯২ সালে, চেন্নাই পার্টি কংগ্রেসে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক হন। সে এক ঐতিহাসিক সিন্ধক্ষণ। সুরজিতের অভিষেকের অর্থ ছিল, দলে মতাদর্শের চেয়ে বাস্তববাদের প্রাসঙ্গিকতা। নতুন পলিটব্যুরোর সদস্য হিসাবে তখনই এসেছিলেন প্রকাশ কারাট ও সীতারাম ইয়েচুরি।
মালওয়ালি স্টাইলে ধুতি পড়ে তিনিও ওই পুরনো পার্টি অফিসে ঘুরে বেড়াতেন, কাজ করতেন, প্রবন্ধ লিখতেন, সাংবাদিক বৈঠক করতেন, মতাদর্শ নিয়ে ঝগড়া করতেন। ই এম এসের সঙ্গে জ্যোতি বসুর মতপার্থক্যগত বিরোধ ছিল। সে সময় কেরল লাইন আর বেঙ্গল লাইনের ৈদ্বরথে দল উেদ্বল। প্রকাশ ছিলেন ই এম এসের বিশেষ েস্নহভাজন, মতাদর্শগত অনুগামী।
তেরো বছর দাপটে সাধারণ সম্পাদকের কাজ চালিয়েছেন সুরজিৎ। দলে তাকে ঘিরে অনেক বিতর্ক। তিনি জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন। সাধারণ সম্পাদক হয়েও সে কাজে সফল হতে পারেননি, কিন্তু ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় দলটাকে অনেকটাই বাস্তববাদী করে তুলতে পেরেছিলেন। যে দলের সর্বভারতীয় অিস্তত্ব বিপন্ন, যে দল ত্রিপুরা-পিশ্চমবঙ্গ-কেরলের বাইরে কার্যত নেই বললেই চলে, সেই দলের কংগ্রেস-বিরোধিতার অহঙ্কার তিনি ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন। কংগ্রেসের সঙ্গে দলের সমন্বয় সাধনের কাজে তিনি অনেকটাই সফল।
ত্রয়োদশ পার্টি কংগ্রেসে ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ বলেছিলেন যুগ্ম বিপদের কথা। এক দিকে বিজেপি, অন্য দিকে কংগ্রেস। তিনি বলেছিলেন, বিজেপি ও কংগ্রেস দুই-ই দলের প্রধান শত্রু। সে-সময় এই বক্তব্য নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। পিশ্চমবঙ্গ ইউনিট বিরোধিতা করেছিল, অবশ্য শেষ পর্যন্ত ই এম এস লাইনই গৃহীত হয়েছিল।[১]
রাজীব গাধী যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুটা সিংহ ছিলেন সুরজিতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পার্টি দফতরের ঠিক উেল্টা দিকে বুটা সিংহের বাড়ি। যে কোনও সময় সুরজিৎ কোনও নোটিস না দিয়েই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে হাজির হতেন। দার্জিলিং সমস্যা মেটাতে সুরজিতের বৃহৎ ভূমিকা ছিল। রাজীব গাধীর অফিসে গেলেও তাকে দেখা যেত। আবার নরসিংহ রাও যখন প্রধানমন্ত্রী, তখনও একই ভাবে কর্মোদ্যোগী সুরজিৎ। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেই সময়েই সুরজিতের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।
আর্থিক সংস্কার এবং জ্যোতি বসুর শিল্প নীতির প্রবল সমর্থক ছিলেন সুরজিৎ। বুঝতে পেরেছিলেন, পুজিবাদের সঙ্গে কৌশল করে এগোতে হবে। শুধু সংঘাত নয়, আপসও করতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন আসলে সি পি এমের মতাদর্শে উথাল পাতাল করে দিয়েছিল। যে চতুর্দশ পার্টি কংগ্রেসে সুরজিত সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন, সেই সেম্মলনটাই হয়েছিল এই পতনের প্রেক্ষাপটে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি যে ভুল করেছিল, চিনের পার্টি তা করেনি। আর তাই সে দেশে আমদানি হল সমাজতািন্ত্রক বাজার অর্থনীতি।
জোট-সংস্কৃতিতে সুরজিৎ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন প্রথম থেকেই। মোরারজি-চরণ সিংহের অকংগ্রেসি জমানায় হয়তো ততটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেননি। কিন্তু বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ থেকে চন্দ্রশেখর, দেবগৌড়া থেকে গুজরাল, এই সব অিস্থরতার যুগে সুরজিত অতীব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। নিন্দুকেরা বলতেন ‘ক্ষমতার এজেন্ট’। পার্টি অফিসেও আলোচনা হত, প্রকাশ কারাটের মতো আদর্শবাদী তিনি নন। কিন্তু ভারতবর্ষে অিস্থরতার রাজনীতিতে কমিউনিস্টদের প্রাসঙ্গিক করে তুলতে সুরজিতের ভূমিকা পলিটব্যুরোর প্রতিটি সদস্য স্বীকার করেন। মনমোহন সিংহ ক্ষমতায় আসার পর যখন ইউ পি এ সরকারকে বামেরা সমর্থন করল, তার পর থেকে তাকে আর দেখা যায়নি। তত দিনে অবশ্য তঁার শরীর ভেঙে গেছে, জ্যোতি বসুর মতো তিনিও নেতৃেত্বর গুরুদায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চাইছেন।
কিন্তু সুরজিৎ সুরজিৎ। গত পার্টি কংগ্রেসে তিনি না থেকেও ছিলেন। চার দিকে ছিল তার কাট আউট। ছবি। এক দিকে সুরজিত-জ্যোতি বসু, অন্য দিকে প্রকাশ কারাট-সীতারাম ইয়েচুরি। দলীয় উত্তরাধিকারে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।
শেষ পার্টি কংগ্রেসের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তিন বছর আগে। দিিল্লতে। প্রকাশ কারাটের হাতে দায়িত্ব সপে দিতে। সে ছিল এক নিঃশব্দ ক্ষমতা হস্তান্তর। তার পর থেকে দলের নীতি বা কৌশল রূপায়ণে তিনি অনুপিস্থত। ইউ পি এ থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার সাম্প্রতিক পর্বে তঁার অনুপিস্থতি অনিবার্য ভাবেই আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। এমন কথাও উঠেছে, তিনি থাকলে কি রাজনীতির গতি অন্য রকম হত? পার্টি আর ব্যক্তির তুল্যমূল্য ভূমিকা নিয়ে চিরকালই তর্ক আছে, থাকবে। কিন্তু সমস্যার মধ্যে থেকে যারা পথ খুজে নিতে পারেন, সুরজিৎ তাদের অন্যতম।
জ্যোতি বসুর চেয়ে বয়সে তিনি ছোট। কিন্তু জ্যোতিবাবুর মিস্তষ্ক এখনও সজাগ। সুরজিৎ বেশ কিছু দিন যাবৎ কাউকে চিনতে পারছিলেন না। ২৩ মার্চ তার জন্মদিনে দিিল্লতে তার বাসভবনে গিয়েছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি আর বৃন্দা কারাট।
হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ এবং জ্যোতিবাবুই ছিলেন সি পি আই এমের আদি নবরেত্নর শেষ দুই জীবিত অবশেষ। নাম্বুদিরিপাদ, রণদিভে, বাসবপুন্নাইয়া, প্রমোদ দাশগুপ্ত বা রামমূর্তির তুলনায় এরা দু’জনেই অনেক বেশি নমনীয়। [২]
মৃত্যু
সম্পাদনাস্বাস্থ্যগত কারণে ২০০৮ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত দলের ১৯তম কংগ্রেসে সুরজিত প্রথমবারের মতো পলিটব্যুরোতে অন্তর্ভুক্ত হননি। তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিশেষ আমন্ত্রিত হিসাবে ছিলেন।[১] হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ২০০৮ সালের ১ আগস্ট সুরজিত নয়াদিল্লিতে মৃত্যু বরণ করেন; ৯২ বছর বয়সী সুরজিত ২৫ জুলাই থেকে নয়ডার মেট্রো হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।
উপন্যাস
সম্পাদনাদর্শন সিং নামক সুরজিতের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী পাঞ্জাবী ভাষায় ভাউ (Bhauu) নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন, যেখানে বেনামে সুরজিতের জীবন-কাহিনী বর্ণিত রয়েছে। উপন্যাসটি মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে আসার আগ পর্যন্ত সর্বসাধারণের অগোচরেই ছিলো।[৩] সংবাদপত্রে নিবন্ধ প্রকাশের ফলে রাতারাতি সর্বত্র সাড়া পড়ে যায় এবং ভারতের প্রায় সকল সংবাদপত্রে তা প্রকাশিত হয়।[৪] [৫][৬][৭] যদিও লেখক দর্শন সিং তাঁর উপন্যাসকে "পরাবাস্তব" বলে উল্লেখ করেন ও বলেন যে, উপন্যাসটি সুরজিতের জীবনের উপর ভিত্তি করে লিখিত নয়। তিনি বলেছিলেন, "মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিদের নিয়েও উপন্যাস রচিত হচ্ছে, যেখানে তাঁদের নাম দেয়া থাকে না।" মূল চরিত্রের নাম 'করম সিং কির্তী', পাঞ্জাবী ভাষায় 'কির্তী' অর্থাৎ 'কর্মী' (শ্রমিক) - পাঞ্জাবে বামপন্থীদের জন্য ব্যবহৃত রাজনৈতিক-পরিচিতি সূচক বাক্য। সুরজিতকে নিয়ে উপন্যাস রচিত হওয়ায় তার রাজনৈতিক দল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) বেশ অখুশী ছিলো।[৮]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ Manini Chatterjee. "Nine to none, founders’ era ends in CPM ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩ জুলাই ২০১৮ তারিখে". The Telegraph. 3 April 2008. উদ্ধৃতি ত্রুটি:
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; আলাদা বিষয়বস্তুর সঙ্গে "Nine" নামটি একাধিক বার সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে - ↑ ক খ "শ্রীহরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ", আনন্দবাজার পত্রিকা (কলকাতা), এপ্রিল ৩,২০০৮
- ↑ Novel based on the life of CPM’s Surjeet may kick up a storm Singh, Bajinder Pal, 3 June 2008.
- ↑ [১]
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ১০ জুন ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০১৬।
- ↑ [২]
- ↑ [৩][স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ১২ জুলাই ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০১৬।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- DeshSewak - সুরজিত কর্তৃক প্রকাশিত একটি পাঞ্জাবী সংবাদপত্র।