সৈয়দ জামিল আহমেদ
সৈয়দ জামিল আহমেদ ( জন্ম: ৭ এপ্রিল ১৯৫৫)[১] একজন বাংলাদেশী পণ্ডিত, নাট্য পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড মিউজিক বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।[২][৩] তার উল্লেখযোগ্য থিয়েটার প্রযোজনার মধ্যে রয়েছে কমলা রানীর সাগর দীঘি (১৯৯৭), এক হাজার আর এক থি রাত (১৯৯৮), বেহুলার ভাসান (২০০৪), পাহিয়ে (২০০৬) এবং সং ভং চং (২০০৯)।[২] তিনি কলকাতার নান্দীকার ন্যাশনাল থিয়েটার অ্যাওয়ার্ড, ভারতের ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা (এনএসডি)-এর বিভি কারান্থ পুরস্কার এবং বাংলাদেশে শিল্পকলা পদক জিতেছেন।[২] তিনি ২০২৪ সালের ৯ই সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব লাভ করেন।
সৈয়দ জামিল আহমেদ | |
---|---|
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
মাতৃশিক্ষায়তন | ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয় |
পেশা | অধ্যাপনা |
প্রাথমিক জীবন এবং শিক্ষা
সম্পাদনাআহমেদ ১৯৫৫ সালের ৭ এপ্রিল ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন।[৪] ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।[৫] মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে তিনি একদিন ঢাকা শহরের রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন। এ সময় রাস্তার পাশে, পরিত্যক্ত বাড়ীর ভিতরে তিনি বেশ কিছু লাশ দেখতে পান। এরমধ্যে কিছু লাশ পঁচে-গলে গন্ধ ছড়াচ্ছিলো। কিছু লাশ ছিলো পুড়ে বীভৎস হয়ে যাওয়া। সেগুলোর ট্রাউজারের পকেটে পিনখোলা গ্রেনেড আটকে ছিলো। এ সকল দৃশ্য তাকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে তাড়িত করেছে। আহমেদ ১৯৭৪ সালে ‘ঢাকা থিয়েটার’ নামে একটি অপেশাদার নাট্যদলের সংস্পর্শে আসেন এবং থিয়েটারকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করবেন বলে ভাবতে শুরু করেন।[৫] ১৯৭৫ সালে তিনি ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস (ICCR) থেকে একটি বৃত্তি লাভ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (অনার্স) পড়া বাদ দিয়ে নতুন দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামাতে যোগদান করেন।[৫] এখানে তিনি ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত তিন বছর অধ্যয়ন করেন এরপর ইব্রাহিম আলকাজি এবং বিভি কারান্থের অধীনে আরও এক বছর শিক্ষানবিশ ফেলো হিসাবে কাজ করেন। আলকাজি তাকে 'ওয়েস্টার্ন' থিয়েটারের বিষয়ে এবং কারান্থ তাকে দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী থিয়েটারের বিষয়ে সাম্যক জ্ঞান দান করেন।[৬] ১৯৭৮ সালে তিনি ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে বিশেষ যোগ্যতাসহ ড্রামাটিক আর্টসে ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৮৯ সালে, তিনি ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে থিয়েটারে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।[২] "দেশজ ঐতিহ্যবাহী নাট্যকলা" বিষয়ে, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে।[২]
মঞ্চ নকশা এবং প্রয়োগ থিয়েটার
সম্পাদনা১৯৭৯ সালে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসার পর জামিল আহমেদ সেট এবং লাইট ডিজাইনার হিসাবে কাজ শুরু করেন। তিনি কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অচলায়তন, রক্তকরবী এবং চিত্রাঙ্গদা-এর মতো নাটকগুলির জন্য সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করেন।[৭] ১৯৭০-এর দশকে মঞ্চ নাটকে হাতে আঁকা দৃশ্যের যে প্রচলন ছিলো তদস্থলে ১৯৮০-এর দশকে বাস্তববাদী, প্রতীকী এবং পরাবাস্তববাদী মঞ্চ পরিকল্পনা প্রবর্তনে তার ভুমিকা ছিলো অগ্রগন্য।[৮] বাস্তববাদী ডিজাইনে তার ভুমিকার জন্য তিনি ১৯৯৩ সালে ‘মুনীর চৌধুরী সম্মাননা’ লাভ করেন। আট বছর ফ্রি-ল্যান্স থিয়েটার অনুশীলনের পর জামিল আহমেদ ১৯৮৭-৮৮ সালে ইংল্যান্ডের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাইভ বার্কারের অধীনে অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করেন। বার্কার তাকে থিয়েটার-ফর-ডেভেলপমেন্ট (আজকের ফলিত থিয়েটার) এবং ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকান থিয়েটারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।[৯] :xviদেশে ফেরার পর, তিনি বামপন্থী ভূমিহীন কৃষকদের একটি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হন এবং তারপরে বাংলাদেশে কর্মরত আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বেসরকারী সংস্থাসমূহের সাথেও কাজ করেন। ১৯৯২ সালে তিনি অশোকা ফাউন্ডেশন (USA) পক্ষ থেকে অশোকা ফেলোশিপের জন্য নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৯৫ সালের দিকে তার প্রয়োগিক নাট্যকলার মোহভঙ্গ ঘটে।[৯] :১৬, ১৯[১০]
শিক্ষকতা, নির্দেশনা এবং লেখা
সম্পাদনাজামিল আহমেদ ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং পরে ১৯৯৪ সালে ‘নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগ’ প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রচেষ্টায় এই বিভাগটি পরিবেশনা শিল্পের নিরীক্ষা ও উদ্ভাবনের অন্যতম প্রধান একটি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে।[১১] উক্ত বিভাগের বর্তমান নাম ‘থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ’; এবং এর পাঠ্যক্রমে থিয়েটার-ফর-ডেভেলপমেন্ট, থিয়েটার-ইন-এডুকেশন, পারফরম্যান্স স্টাডিজ, থিয়েটারের সমাজবিজ্ঞান এবং থিয়েটারে মনোবিশ্লেষণ যুক্ত করা মূলত তারই অবদান। একাডেমিক কাজে অবদানের জন্য তাকে দুইবার ফুলব্রাইট ফেলোশিপ দেওয়া হয়। প্রথমবার, ১৯৯০ সালে- তাকে অ্যান্টিওক কলেজ, ইয়েলো স্প্রিংস (ওহিও, ইউএসএ) তে একজন স্কলার-ইন-রেসিডেন্স হিসাবে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তিনি ডেনি প্যাট্রিজের সাথে সেলিম আল দীনের ‘চাকা’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন এবং পরিচালনাও করেছিলেন। দ্বিতীয়বার, ২০০৫ সালে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো সিটি কলেজে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়।[১২] ১৯৯২ সালে, তিনি কারবালার কিংবদন্তি এবং মীর মোশাররফ হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে ছয় ঘন্টার একটি মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডি সৃজন করেন।[১৩]
১৯৮৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসমূহে গমন করেন এবং দেশীয় নাট্যের অসংখ্য পরিবেশনা প্রত্যক্ষ করেন।[১৪] ১৯৯৭ সালে "Indigenous Theatrical Performance in Bangladesh: Its History and Practice" বিষয়ক অভিসন্দর্ভের জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পিএইচডি লাভ করেন। তার পিএইচডি গবেষণার অংশ Achinpākhi Infinity: Indigenous Theatre of Bangladesh নামে প্রকাশিত হয়েছে।[১৫] তার নির্দেশিত কমলা রানীর সাগর দীঘি (ঢাকা, ১৯৯৭), এক হাজার অর এক থি রাত (করাচি, ১৯৯৮), বেহুলার ভাসান (ঢাকা, ২০০৪), পাহিয়ে [‘চাকা’র হিন্দি অনুবাদ] (নয়াদিল্লি, ২০০৬), সং ভং চং (ঢাকা, ২০০৯) ইত্যাদি প্রযোজনা সমূহে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতি এবং সমকালীন বিষয়াবলী সাম্যকভাবে বিধৃত হয়েছে। সৈয়দ জামিল আহমেদ ১৯৯৯ সালে কলকাতায় নান্দীকার জাতীয় থিয়েটার পুরস্কার এবং ২০১৬ সালে শিল্পকলা পদক লাভ করেন। তার নির্দেশিত ‘বেহুলার ভাসান’ ভারত রঙ্গ মহোৎসব, নিউ দিল্লি, ২০০৬, এবং লীলা: সাউথ এশিয়ান উইমেনস থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল, কলকাতা এবং নয়াদিল্লি, ২০১০-এ অংশগ্রহণ করেছিল[১৬][১৭]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ শিল্পকলা একাডেমির নতুন মহা পরিচালক জামিল আহমেদ, কালের কণ্ঠ, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ "The World of Syed Jamil Ahmed"। দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৭-০৯-১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৭-১৫।
- ↑ Geoffrey Samuel, "Review of Reading Against the Orientalist Grain: Performance and Politics Entwined with a Buddhist Stain." Religions of South Asia 6.1 (2012), p. 138. Retrieved from 15 July 2014.
- ↑ শিল্পকলা একাডেমির নতুন মহা পরিচালক জামিল আহমেদ, কালের কণ্ঠ, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
- ↑ ক খ গ "Jamil Ahmed"। Everyone a Changemaker (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৭-১৫।
- ↑ বহু দিন পরে মঞ্চ আলোয়। দৈনিক প্রথম আলো। ২০১২-০৭-১৯। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৭-১৫।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ Syed Jamil Ahmed, Who's Who in Contemporary World Theatre (ed. Daniel Meyer-Dinkgrafe), London: Routledge: 2000, p. 5. Baidyanath Mukhopadhyay, Samsad Bangla Natya Abhidhan [Samsad Dictionary of Bengali Theatre], Kolkata: Shishu Sahitya Samsad, 2000, p. 411.
- ↑ Kabir Chowdhury, "Bangladesh", The World Encyclopedia of Contemporary Theatre, Volume 5, Asia-Pacific (ed. Don Rubin), p. 110.
- ↑ ক খ Syed Jamil Ahmed, Applied Theatricks: Essays in Refusal, Kolkata: Anderson, 2013
- ↑ Syed Jamil Ahmed (২০০২)। "Wishing for a World without 'Theatre for Development': demystifying the case of Bangladesh": 207। ডিওআই:10.1080/1356978022000007983।
- ↑ Saymon Zakaria, "Bangladesh", The World of Theatre: 2011 Edition, Dhaka: International Theatre Institute, 2011, p. 26.
- ↑ শিল্প ও শিল্পী » সুদীপের চাকা একটা ঘোরে ফেলে দিয়েছে। www.shilpaoshilpi.com। ২০১৫-০৪-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৭-১৫।
- ↑ Meghna Guhathakurta, "The Representation and Characterization of Women in Contemporary Theatre: The Case of Bishad Sindhu," Infinite Variety: Women and Society and Literature (Firdous Azim and Niaz Zaman eds.), Dhake: University Press Ltd, 1994, p, 289.
- ↑ Syed Jamil Ahmed, Acinpakhi Infinity: Indigenous Theatre of Bangladesh, Dhaka: University Press Ltd, 2000, p. xv.
- ↑ Clive Barker (মে ২০০৩)। "Review of In Praise of Niranjan: Islam Theatre and Bangladesh": 198। ডিওআই:10.1017/S0266464X0327010X।
- ↑ Bajeli, Diwan Singh (২০১০-০৩-২৫)। "A Dhaka delight"। The Hindu (ইংরেজি ভাষায়)। আইএসএসএন 0971-751X। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৭-১৫।
- ↑ "Scenes from the neighbourhood"। The Telegraph (Opinion)। Calcutta। ১৫ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৭-১৫।