সেলিনা পারভীন

বাংলাদেশী সাংবাদিক

সেলিনা পারভীন (৩১ মার্চ ১৯৩১ - ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১) ছিলেন একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক। তিনি সাপ্তাহিক বেগম, সাপ্তাহিক ললনা, ও শিলালিপি পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের অংশ হিসেবে ১৪ ডিসেম্বর আল বদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হওয়ার পর তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় এবং রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়।

সেলিনা পারভীন
জন্ম(১৯৩১-০৩-৩১)৩১ মার্চ ১৯৩১
ছোট কল্যাণনগর, ফেনী
 বাংলাদেশ
মৃত্যুডিসেম্বর ১৪, ১৯৭১(1971-12-14) (বয়স ৪০)
ঢাকা, বাংলাদেশ

সেলিনা পারভীনের জন্ম ফেনীতে ১৯৩১ সালে। তার পিতা মোঃ আবিদুর রহমান শিক্ষকতা করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের ফেনীর বাড়ি দখল হয়ে যায়। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তিনি সাহিত্যের অনুরাগী হয়ে গল্প ও কবিতা লিখা শুরু করেন। গ্রামীণ কুসংস্কারের মারপ্যাঁচে তার পড়ালেখার সাময়িক ইতি ঘটে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার অমতে তখনকার প্রথামত বিয়ে দেয়া হয়। তিনি ঐ বয়সে স্বামীর সাথে থাকার কথা ভাবতে পারেননি। ১০ বছর টিকেছিল সে বিয়ে। পরবর্তীতে তিনি আবার পড়ালেখা শুরু করেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মেট্রিকুলেশনে কৃতকার্য হননি।[]

কর্মজীবন

সম্পাদনা

১৯৪৫ সাল থেকেই তিনি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।[] ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের হল পরিচালক হিসেবে চাকুরি নেন। পরের বছর কর্তৃপক্ষের সাথে মতের অমিল হওয়ায় তিনি চাকুরি ছেড়ে দেন। তিনি পরবর্তীতে একজন রাজনীতিককে বিয়ে করে তার সাথে সংসার শুরু করেন। তিনি ললনা পত্রিকায় কাজ করতেন বিজ্ঞাপন বিভাগে। বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, টাকা তোলাসহ সব কাজ একাই করতেন। পত্রিকা অফিস থেকে বেতন হিসাবে অনেক সময় তেমন কিছুই পেতেন না। ললনায় কাজ করার সময় ১৯৬৯ সালে বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বের করেন শিলালিপি নামে একটি পত্রিকা। তিনি নিজেই এটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন। শিলালিপি ছিল সেলিনার নিজের সন্তানের মত। তবে শিলালিপির প্রকাশিতব্য সংখ্যা নিষিদ্ধ করে দেয় পাকিস্তান সরকার। প্রায় সব বুদ্ধিজীবীদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত শিলালিপি সকলেরই নজর কেড়েছিল। স্বাধীনতার পক্ষের পত্রিকা শিলালিপি। এই সুবাদে ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলে অনেকের সাথেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন তিনি।[]

মুক্তিযুদ্ধে অবদান

সম্পাদনা

১৯৬৯-এর রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ। নিজেও শরিক হন গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলন কর্মকাণ্ডে। ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই বেরিয়ে পড়তেন '৬৯-এর ২১ ফেব্রুয়ারি পল্টনের জনসভায় বা শহিদ মিনার থেকে বের হওয়া নারীদের মিছিলে যোগ দিতে। শরিক হতেন বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদসভাতেও। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখদের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সমাজতন্ত্রের প্রতিও আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। এরই মধ্যে শুরু হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেলিনা পারভীন ঢাকায় ছিলেন। তার বাসায় মাঝে মাঝে রাত হলে কয়েকজন তরুণ আসতেন। এই তরুণদের সকলেই ছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা। খাওয়া-দাওয়া করে চলে যাওয়ার আগে এরা সেলিনা পারভীনের কাছ থেকে সংগৃহীত ঔষধ, কাপড় আর অর্থ নিয়ে যেতেন। শিলালিপির বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়েই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন।

চারিদিকে তখন চলছে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ, প্রতিরোধ। চারপাশে শুধু বুলেটের শব্দ আর বারুদের গন্ধ, চিৎকার, গোঙানি, রক্তস্রোত আর মৃত্যু। এরই মাঝে ললনা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। শিলালিপির উপরও নেমে আসে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর খড়্গ। হাশেম খানের প্রচ্ছদ করা একটি শিলালিপির প্রকাশিতব্য সংখ্যা নিষিদ্ধ করে দেয় পাকিস্তান সরকার। পরে প্রকাশের অনুমতি মিললেও নতুনভাবে সাজানোর শর্ত দেয়া হয়। সেলিনা পারভীন বরাবরের মতো প্রচ্ছদ না নিয়ে তার ভাইয়ের ছেলের ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ করে আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে শিলালিপির সর্বশেষ সংখ্যা বের করেন। কিন্তু এর আগের সংখ্যার জন্যই সেলিনা পারভীন পাকিস্তানি ও তাদের দালালদের নজরে পড়ে যান—যেটাতে ছিল দেশবরেণ্য বুদ্ধীজীবীদের লেখা এবং স্বাধীনতার পক্ষের লেখা। তাই কাল হলো। শিলালিপির আরেকটি সংখ্যা বের করার আগে নিজেই হারিয়ে গেলেন।

১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। দেশ স্বাধীন হতে আর মাত্র তিন দিন বাকি। বেশ কিছু অঞ্চল ইতোমধ্যে মুক্ত হয়ে গেছে। সাংবাদিক সেলিনা পারভীন তখন বাস করতেন সিদ্ধেশ্বরীতে। ১১৫ নং নিউ সার্কুলার রোডে তার বাড়ীতে থাকতো তিনজন মানুষ—তার মা, পুত্র সুমন আর ভাই জনাব উজির। সেদিন শীতের সকালে তারা সকলেই ছিলেন ছাদে। সেলিনা পারভীন সুমনের গায়ে তেল মাখিয়ে দিচ্ছিলেন। সুমন যখন ছাদে খেলাধুলা করছিল তখন সেলিনা পারভীন ছাদে চেয়ার টেনে একটি লেখা লিখছিলেন। শহরে তখন কারফিউ। রাস্তায় মিলিটারি। পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বিমান থেকে চিঠি ফেলা হচ্ছে। হঠাৎ দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ হলো। সেলিনাদের বাড়ির উল্টো দিকে খান আতার বাসার সামনে E.P.R.TC-এর ফিয়াট মাইক্রোবাস ও লরি থামলো। সেই বাসার প্রধান গেইট ভেঙে ভিতরে ঢুকে গেল কিছু আল বদর কর্মী। তাদের সবাই একই রঙের পোশাক পরা ও মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা। একসময় সেলিনাদের ফ্ল্যাটে এসেও কড়া নাড়ে তারা। সেলিনা পারভীন নিজে দরজা খুলে দেন। লোকগুলো তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এবং এ সময় সেলিনা পারভীনের সাথে লোকগুলোর বেশ কিছু কথা হয়। এরপর তারা সেলিনা পারভীনকে তাদের সাথে ধরে নিয়ে যায়। ১৮ ডিসেম্বর সেলিনা পারভীনের গুলিতে-বেয়নেটে ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। খুব শীতকাতুরে সেলিনার পায়ে তখনও পড়া ছিল সাদা মোজা। এটি দেখেই তাকে সনাক্ত করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো পাকিস্তানের দালাল আলবদর বাহিনীর ঘৃণিত নরপশুরা সেখানেই সেলিনা পারভীনকে হত্যা করে। ১৮ ডিসেম্বরেই তাকে আজিমপুর কবরস্থানে শহিদদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে সমাহিত করা হয়।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. স্মৃতি: ১৯৭১, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৮, বাংলা একাডেমী, ISBN = 9-840-73351-6
  2. সমকাল[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  3. স্মৃতি: ১৯৭১, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০০, বাংলা একাডেমী, ISBN = 9-840-73351-6
  • মালেকা বেগম (সম্পাদক রশীদ হায়দার) (২০০৪)। স্মৃতি: ১৯৭১, ৪র্থ খণ্ড। বাংলা একাডেমী। আইএসবিএন 9-840-73351-6 

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা