সূর্যেন্দুবিকাশ করমহাপাত্র
সূর্যেন্দুবিকাশ করমহাপাত্র (১ সেপ্টেম্বর ১৯২৪ – ২৩ মার্চ ২০০৭) ছিলেন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী।[১][২]
সূর্যেন্দুবিকাশ করমহাপাত্র | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ২৩ মার্চ ২০০৭ | (বয়স ৮২)
জাতীয়তা | ভারতীয় |
মাতৃশিক্ষায়তন | মেদিনীপুর কলেজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় |
পরিচিতির কারণ | মাসস্পেকট্রোগ্রাফ আইসোটোপ সেপারেশন |
দাম্পত্য সঙ্গী | শান্তিলতা দেবী |
পুরস্কার | মোয়াট স্বর্ণপদক নরসিংহ দাস পুরস্কার (১৯৮৫) রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৯৯) |
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন | |
কর্মক্ষেত্র | পদার্থবিজ্ঞান |
প্রতিষ্ঠানসমূহ | সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স কলকাতা |
উচ্চশিক্ষায়তনিক উপদেষ্টা | মেঘনাদ সাহা বাসন্তী দুলাল নাগচৌধুরী |
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
সম্পাদনাসূর্যেন্দুবিকাশ করমহাপাত্রের জন্ম ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার মোহনপুর সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম মোহনপুরের জমিদার পরিবারে। পিতা ছিলেন জমিদার কিশোরীরঞ্জন করমহাপাত্র এবং মাতা হিরণ্ময়ী দেবী। সূর্যেন্দুবিকাশ ছিলেন পিতামাতার জ্যেষ্ঠ পুত্র (দ্বিতীয় সন্তান)। তার অনুজ ছিলেন নির্মলেন্দুবিকাশ। শিশুকাল থেকেই সূর্যেন্দু ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। লেখাপড়ার শুরু পিতার কাছেই। প্রাথমিক পাঠ গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে হলেও বাড়ির কাছাকাছি কোন হাইস্কুল না থাকায় ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ পিতার কাছেই নেন। পরে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে বারো বৎসর বয়সে ভর্তি হন বিশ কিলোমিটার দূরবর্তী দাঁতন উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়ে এবং রইলেন বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ইন্টারমিডিয়েট পড়তে আসেন মেদিনীপুর শহরে। বি.এসসি পাশ করেন মেদিনীপুর কলেজ থেকে। বিএসসি পাশের পর ডাক্তারি পড়তে কলকাতায় আসেন। ইতিমধ্যে উদ্ভিদ বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনুপ্রেরণায় সূর্যেন্দুবিকাশের রচিত বিজ্ঞান বিষয়ে কিছু লেখা জ্ঞান বিজ্ঞান -এ প্রকাশিত হয়েছিল। সেসব লেখা অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নজরে আসে। তিনিই সূর্যেন্দুবিকাশকে পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি পড়ার পরামর্শ দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি পাশ করেন।[১]
কর্মজীবন বিজ্ঞান গবেষণায়
সম্পাদনাএমএসসি পাশের পর ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স তৎকালীন ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এর সাইক্লোটন প্রকল্পে গবেষণাজীবন শুরু করেন। প্রথমে ছিলেন অধ্যাপক মেঘনাদ সাহার তত্ত্বাবধানে এবং পরে পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম বিশিষ্ট বিজ্ঞানী বাসন্তীদুলাল নাগচৌধুরীর অধীনে।[২] অধ্যাপক সাহার উৎসাহে তিনি প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তির জন্য থিসিস জমা দেন। পরীক্ষাগারে ছোট মাস-স্পেকট্রোমিটারে আইসোটোপ পৃথকীকরণের সম্ভাবনার মৌলিক উদ্ভাবনের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। Laboratory isotope separators and their application- শীর্ষক প্রবন্ধ ছিল তার গবেষণার বিষয়। তার থিসিসের পরীক্ষক ছিলেন অধ্যাপক শিশির কুমার মিত্র।[১] প্রবন্ধটি পরবর্তীতে Advances of Electronics & Electron-Physics নামক একটি পর্যালোচনা পুস্তকে প্রকাশিত হয়।[২] মূলত সেসময় হালকা আইসোটোপ পৃথক করার কাজ ভারতে কেউই শুরুই করেননি। ড. সূর্যেন্দুবিকাশ করমহাপাত্র সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এ পদার্থবিজ্ঞানের মাস স্পেকট্রোস্কোপি অ্যান্ড আইসোটোপ সেপারেশনের কাজ শুরু করেন নি, তিনি এনিয়েই আজীবন যুক্ত ছিলেন। একাধিক আয়নিত পরমাণুসমষ্টির সংমিশ্রণের বিশ্লেষণের জন্য তডিৎ-চুম্বকীয় পদ্ধতিতে এক বিশেষ ভর-বর্ণালির অভিনব এই যন্ত্র উদ্ভাবনে পরমাণু বিজ্ঞান গবেষণায় বেশ সুবিধা হয়। এতে তিনি দেশ-বিদেশ থেকে প্রশংসা পেয়েছেন। কানাডার অধ্যাপক ও ম্যাসস্পেকট্রোস্কোপিস্ট এইচ ই ডাকওয়ার্থ ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে এসে তাঁর কাজের প্রশংসা করেন এবং তাকে কানাডায় কাজ করার আমন্ত্রণও করেছিলেন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ড: রেনে বার্নাসের আমন্ত্রণে তিনি ফ্রান্সে এক আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগ দেন।[৩] পরে সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এ অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হন এবং ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন।[২] অধ্যাপক সূর্যেন্দুবিকাশের কর্মজীবনে দু-টি ধারা ছিল। একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং অন্যটি জনপ্রিয বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান কলকাতার বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদে যুক্ত থেকে বিজ্ঞানকে জনজীবনে জনপ্রিয় করে তোলা। স্কুল কলেজের ছাত্রজীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা এবং বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখি চলত সমানতালে। তার রচিত গ্রন্থগুলি হল-
- কণাত্বরণ
- ভরের বর্ণালী
- মহাবিশ্বের কথা
- পদার্থ বিকিরণ বিশ্ব
- সৃষ্টির পথ
- মেঘনাদ সাহা জীবন ও সাধনা
- প্রগতি পরিবেশ পরিণাম
- পরমাণু থেকে বোমা ও বিদ্যুৎ
বিজ্ঞান প্রচার ও জনপ্রিয় করতে অবদান
সম্পাদনাবিজ্ঞানের গবেষণা ছাড়া জনপ্রিয় বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান কলকাতার বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সঙ্গে তিনি আজীবন যুক্ত ছিলেন। গবেষণার কাজে ব্যস্ততার মধ্যেও ১৯৮১―১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে দুবার পরিষদের সভাপতিও হয়েছিলেন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের প্রসার ও জনপ্রিয করার জন্য তিনি পূর্বসূরীদের ন্যায় সচেষ্ট ছিলেন। নিজের গবেষণার বিষয়, পরিবেশ নিয়ে, জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে গ্রন্থ, প্রবন্ধাদি লিখেছেন বাংলা ভাষাতেই। গ্রামীণ এলাকার ছেলে-মেয়েদের বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তুলতে বিজ্ঞান মেলার প্রয়োজন অনুভব করেন। সেই সঙ্গে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয করতে, ব্যবহারিক প্রয়োগ প্রদর্শনের জন্য ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজের গ্রামেই গ্রামীণ বিজ্ঞান মেলা চালু করেছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ের মডেল, যন্ত্রপাতি, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতেন তিনি। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে পিতার স্মৃতিতে তৈরী কিশোরীরঞ্জন স্মৃতি পাঠাগার গ্রামীণ পাঠাগারে (বর্তমানে টাউন লাইব্রেরিতে পরিণত) পিতা কিশোরীরঞ্জন ও তার নিজের সংগৃহীত ও রচিত বহু পুস্তক আছে।[৩]
সম্মাননা
সম্পাদনা- গবেষণাগারে মাস-স্পেকট্রোমিটার যন্ত্রটির সফল রূপায়ণের জন্য তিনি 'মোয়াট স্বর্ণপদক' পান।
- ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে পদার্থ বিকিরণ বিশ্ব গ্রন্থটির জন্য দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে 'নরসিংহ দাস পুরস্কার প্রদান করে।
- ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি সৃষ্টির পথ বইটির জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন।
পারিবারিক জীবন ও জীবনাবসান
সম্পাদনাঅধ্যাপক ড. সূর্যেন্দুবিকাশ করমহাপাত্র কলকাতার সল্টলেকে বসবাস করতেন। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ তিনি কলকাতায় প্রয়াত হন। তার স্ত্রী শান্তিলতা দেবী (২০১৬ খ্রিস্টাব্দে মারা যান) এবং দুই পুত্র- জ্যেষ্ঠ ফাল্গুনী কর মহাপাত্র ছিলেন আই আই টি'র আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ার (২০১৮ খ্রিস্টাব্দে মারা যান) এবং কনিষ্ঠ শান্তুনু করমহাপাত্র কলকাতার বিশিষ্ট চিকিৎসক।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ "মেদিনীপুরের পদার্থবিজ্ঞানী সূর্যেন্দুবিকাশ করমহাপাত্র এবং তাঁর 'মাসস্পেকট্রোগ্রাফ' যন্ত্র"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-২৫।
- ↑ ক খ গ ঘ অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯ পৃষ্ঠা ৪৬৭, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬
- ↑ ক খ "যোগ দিলে না বিজ্ঞানী, অভিমানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-২৫। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য)