সুফি দার্শনিক মতবাদ
সুফি দর্শন' বা সুফি দার্শনিক মতবাদ হলো ইসলামের বিশেষ রহস্যময় অংশ সুফিবাদ এর বিশেষ চিন্তাধারা ও অনুশীলন, যা তাসাউফ দর্শন নামেও পরিচিত।[১] সুফি মতবাদ এবং এর দার্শনিক ঐতিহ্য সুন্নি ও শিয়া ইসলামের বিভিন্ন শাখার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে।[১] সুফি চিন্তাভাবনা মধ্যপ্রাচ্যে ৮ম শতাব্দীতে উদ্ভূত হয়েছিল, তবে বর্তমানে তার অনুসারীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। [২] সুফি মুসলমানদের মতে এটি ইসলামী শিক্ষার একটি অংশ, যা অন্তরের শুদ্ধতা নিয়ে কাজ করে এবং এটি সেই পথ যা ইসলামে স্রষ্টা এবং সৃষ্টি তথা মানবজাতির মধ্যে সকল দুরত্ব অপসারণ করে। প্রায় ১০০০ খ্রিষ্টাব্দে রচিত প্রাথমিক সুফি সাহিত্য, গ্রন্থ, প্রবন্ধ, আলোচনা এবং কবিতার আকারে সুফি চিন্তাভাবনা বর্তমানে সুফি দর্শনের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। সুফি দর্শনও অন্যান্য বিখ্যাত দার্শনিক ঐতিহ্যের মতো বেশ কিছু উপশাখায় বিভক্ত, যার মধ্যে সুফি অধিবিদ্যা ও সুফি কসমোলজি অন্যতম। এই দুই ধারণার মধ্যে বেশ কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে।[১]
ইতিহাস
সম্পাদনাসুফি চিন্তাধারার উদ্ভব সাধারণত সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্যে। মিশর, আরব দেশসমূহ, ইরান ইত্যাদি দেশে এই চিন্তাধারা বিকশিত হয়। পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে এর ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে। দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সুফিবাদ মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। সুফি দার্শনিকতার উপর প্রথম প্রভাবশালী লেখক ছিলেন মুসলিম পণ্ডিত ও দার্শনিক ইমাম গাজ্জালি (১০৫৮–১১১১)। তিনি আত্মা এবং এর দুঃখ ও আনন্দ এর কারণগুলি আলোচনা করেছিলেন। মুসলিম বিশ্বের মধ্যে সুফিবাদ একটি আধ্যাত্মিক,[৩] কিছুটা গোপন ঐতিহ্য হিসেবে সুন্নী ও শিয়া গোষ্ঠীগুলির মধ্যে উদিত এবং বেড়ে ওঠে,[৩] এর কারণ হিসেবে এরিক হ্যানসন ও ক্যারেন আর্মস্ট্রং প্রস্তাব করেন যে, এটি সম্ভবত "উমাইয়া এবং আব্বাসিয় সমাজগুলির বাড়তি দুনিয়াবাদিতা" প্রতিক্রিয়া হিসেবে উদ্ভূত।[৪] সুফিবাদ বিশেষভাবে মুসলিম বিশ্বের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে গ্রহণ করা হয় এবং তারপরে বেড়ে ওঠে,[৩][৫] যেখানে তার ফকির ও দরবেশদের বৈরাগ্য মানুষের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। তারা ইতিপূর্বে হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, ও খ্রিষ্টান ধর্ম এর সাধনামূলক ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত ছিল।[৪][৬][৭] ১৩শ শতাব্দীর শেষের দিকে সুফিবাদ ইসলামী সভ্যতার একটি সুসংহত এবং সুসংজ্ঞায়িত আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি ছিল "ইসলামের স্বর্ণযুগ"। এই সময়ে ইসলামী সভ্যতার কোনো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র সুফিবাদের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল না। এই সময়ে বিভিন্ন তরিকাহ (সুফি তরীকা) প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া আবুল হাসান হানকারি, ইবন আরাবি এবং আবু সাঈদ মুবারক মাখজুমি-এর মতো বিশিষ্ট সুফি দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক এবং ফকিহরা এই যুগে নেতৃত্ব দেন। তাঁরা এমন দার্শনিক এবং প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব তৈরি করেন যাঁদের কাজ আজ বিশ্বব্যাপী অধ্যয়ন করা হয়, যেমন ইবনে সিনা এবং ইমাম গাজ্জালি।[৮] সুফি দর্শনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন রেখে গেছেন আব্দুল কাদির জিলানী। তাঁর ফিকহ এবং সুফি দর্শন সুফি তরীকার সংজ্ঞায়নকে সমৃদ্ধ করেছে।[৯] জিলানী কাদরিয়া তরীকাকে প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরে তাঁর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শাখা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যায়। এই যুগে আরও অনেক সুফি তরীকার জন্ম হয়। ১০ম থেকে ১৯শ শতাব্দীর মধ্যে সুফিরা ইসলাম প্রচারে অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং সফল ছিলেন।[৩] বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, বালকান, ককেশাস, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং পরে মধ্য, পূর্ব, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দূরবর্তী অঞ্চলে ইসলাম ছড়িয়ে দিতে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।[৩] কিছু গবেষক মনে করেন যে ১০ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে তুর্কি জাতিকে এবং ১৩শ থেকে ১৪শ শতাব্দীর মঙ্গোল আক্রমণের সময় মঙ্গোলদের ইসলামে রূপান্তরিত করতে সুফি সাধকদের (যেমন ফকির ও দরবেশ) ভূমিকা পালন করেছিলেন। মূলত সুফি সাধকদের সঙ্গে তুর্কি-মঙ্গোল ধর্মের শামানিজমের মিলের কারণে এটি সম্ভব হয়েছিল।[৫][১০]
সুফি মেটাফিজিক্স
সম্পাদনাসুফি অধিবিদ্যা বা মেটাফিজিক্সের প্রধান ধারণাগুলি সাধারণত 'ওয়াহদাতুল উজুদ' বা "আল্লাহর সাথে ঐক্য" ধারণার সাথে সম্পর্কিত। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দুটি প্রধান সুফি দার্শনিক মতবাদ রয়েছে।
ওয়াহদাত-উল-ওয়ুজুদ (অস্তিত্বের ঐক্য) মূলত বলে যে মহাবিশ্বের একমাত্র সত্য হলেন আল্লাহ এবং সমস্ত কিছু শুধুমাত্র আল্লাহর মধ্যে বিদ্যমান। অন্যদিকে,'ওয়াহদাত-উল-শুহুদ (দৃশ্যমানবাদ বা সাক্ষীর ঐক্য) ধারণা দেয় যে আল্লাহ এবং সৃষ্টির জগতের মধ্যে ঐক্যের যে কোনো অভিজ্ঞতা শুধুমাত্র বিশ্বাসীর মনের মধ্যেই ঘটে। 'এই মতবাদ অনুযায়ী, আল্লাহ এবং তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সম্পূর্ণ আলাদা একটি অবস্থান বিদ্যমান। এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে মানুষ এমন এক বিশেষ অবস্থায় পৌঁছাতে চায় যেখানে বলা যায়, 'আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই'।[১১] সুফি মেটাফিজিক্সের ধারণাগুলি প্রথমে বিস্তারিতভাবে লিখিত আকারে আলোচনা করেছিলেন ইবনে আরাবি।[১২] তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রচনা ফুসুস-উল-হিকাম-এ তিনি ঐক্যের ধারণাটি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।[১৩] এই রচনায় ইবনে আরাবি একটি আয়নার উপমা ব্যবহার করে ঐক্যের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি আল্লাহ এবং তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করার জন্য একটি বস্তু এবং অসংখ্য আয়নার মধ্যে প্রতিফলনের তুলনা করেছেন। এখানে আল্লাহকে বস্তু হিসেবে দেখা হয়েছে এবং মানুষকে আয়না হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। এর অর্থ হলো, যেহেতু মানুষ আল্লাহর প্রতিচ্ছবি মাত্র, তাই তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য বা বিচ্ছেদ থাকতে পারে না। আবার আল্লাহ ছাড়া সৃষ্টিকুলের অস্তিত্বও অসম্ভব। যখন একজন ব্যক্তি উপলব্ধি করেন যে মানুষের সাথে আল্লাহর কোনো বিচ্ছেদ নেই, তখনই তিনি চূড়ান্ত ঐক্যের পথে যাত্রা শুরু করেন।
একটি সুফি উক্তি রয়েছে: "যে ব্যক্তি নিজেকে চিনতে পেরেছে, সে নিঃসন্দেহে তার রব (আল্লাহ)-কে চিনতে পেরেছে।"[১৪]
কসমোলজি
সম্পাদনাসুফি কসমোলজি হলো সুফি দর্শন বা আধ্যাত্মবাদের সাথে সম্পর্কিত বৈশ্বিক তত্ত্বগুলোর একটি সাধারণ পরিভাষা। এটি স্থান, সময় এবং সুফি তরিকার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন রূপ নিতে পারে। তবে সামগ্রিকভাবে এতে বিভিন্ন দর্শনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এর অন্যতম প্রধান ধারণাগুলো কুরআনের দার্শনিক ধারণা থেকে এসেছে, যেখানে আল্লাহ, অদৃশ্য সত্তা, আত্মা, পরকাল, সৃষ্টির শুরু ও শেষ এবং সাত আসমানের বিষয়গুলি তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া নিও প্লেটোনিক কিছু ধারণা জড়িত রয়েছে, যা মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে, যেমন ইবনে সিনা এবং ইবনে আরাবির মধ্যে দেখা যায়। পরবর্তীতে হার্মেটিক-পটোলেমীয় এর গোলাকার পৃথিবীকেন্দ্রিক কিছু মতবাদ মুসলিম দার্শনিকগণ গ্রহণ করেছিলেন। সুফি কসমোলজি সংশ্লিষ্ট তত্ত্বগুলো 'স্তরে স্তরে সৃষ্টির' ব্যাখ্যা দেয়, যা প্লটিনাস এর মতবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।[১৫] ইসলামি সুফি পরিভাষায় কে "তানযালাত-ই-সাত্তা" (৬টি ধাপ) বলা হয়। হুসাইন ইবনে আলীর পর আবু সাঈদ মুবারক মাখযুমী তার আরবি গ্রন্থ তোহফা মুরসালা তে এই স্তরগুলোর বিষদ ব্যাখ্যা দেন।[১৬]
লতাইফ-ই-সাত্তা বা ছয় লতিফা
সম্পাদনাকুরআনের আয়াত থেকে প্রাপ্ত ধারণার উপর ভিত্তি করে প্রায় সকল সুফি লতাইফ-ই-সাত্তা (ছয়টি সূক্ষ্মতা) আলাদা করেছেন। এগুলো হলো: নাফস, কালব, সির, রুহ, খফি এবং আখফা। এই লতাইফ বা লতিফাসমূহ (একবচন: লতিফা) হলো বিভিন্ন মানসিক-আধ্যাত্মিক "অঙ্গ" বা ইন্দ্রিয় ও অতীন্দ্রিয় উপলব্ধির ক্ষমতা। এগুলো আত্মার এমন অংশ হিসেবে বিবেচিত হয় ঠিক যেমন শরীরের গ্রন্থি ও অঙ্গ বিবেচিত হয়।
সূক্ষ্ম আত্মা
সম্পাদনারুহ (আত্মা)
সম্পাদনাকিছু সুফি দার্শনিক রুহ কে "অন্তর্জগৎ" বা "কালব" নামে অভিহিত করেছেন। সুফিরা সাধারণত শক্তিশালী আত্মাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, কারণ এটি তাকে আল্লাহর নৈকট্যে নিয়ে যায়। একজন পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিক গুরুর প্রদত্ত আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ আত্মাকে শক্তিশালী করে। এর মাধ্যমে এক ব্যক্তি ধীরে ধীরে আল্লাহর কাছাকাছি পৌঁছায়।[১৭] এছাড়াও হাদিসে বলা হয়েছে: "যে ব্যক্তি নিজের আত্মাকে চিনেছে, সে নিঃসন্দেহে তার আল্লাহকেও চিনেছে।"[১৪] তাই মৃত্যু কোনো সমাপ্তি নয়; বরং এটি চিরন্তন জীবনের শুরু, যা আত্মার জন্য নির্ধারিত, দেহের জন্য নয়।
নাসমা
সম্পাদনানাসমা হলো সুফি পরিভাষায় সূক্ষ্ম বা জ্যোতির্ময় দেহ। এটি রুহ (আত্মা) থেকে পৃথক একটি ধারণা। কারণ রুহ নাসমা এবং শারীরিক রূপ উভয়ের চেয়ে ভিন্নতর।[১৮]
শারীরিক দেহ
সম্পাদনাসুফিবাদে শারীরিক দেহকে নাসমা থেকে আলাদা হিসেবে বর্ণনা করা হয়। সুফিদের বিশ্বাস অনুযায়ী শারীরিক দেহ হলো আধ্যাত্মিক দেহ বা ‘বাতিন’ বা ‘রুহ’-এর প্রতিফলন। মুহাম্মাদ (স.)-এর একটি হাদিসেও এটি উল্লেখ করা হয়েছে: "সকল কর্ম নিয়তের উপর নির্ভরশীল।"[১৯]
আধ্যাত্মিক অবস্থান
সম্পাদনাহাল
সম্পাদনাহাল (বহুবচন: আহওয়াল) হলো একটি সচেতন অবস্থা যা আধ্যাত্মিক পথচলার সময়ে যিকিরের আনুষ্ঠানিক অনুশীলনের মাধ্যমে বা এর বাইরেও বিভিন্ন ভাবে উদ্ভূত হতে পারে। এ অবস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে আনন্দ, বিস্ময়, এবং অন্যান্য অনুভূতি। এই ক্ষণস্থায়ী অবস্থাগুলোর বৈশিষ্ট্য মাকাম বা আধ্যাত্মিক স্তরের তুলনায় ভিন্ন, কারণ মাকাম হলো আধ্যাত্মিক পথে একটি নির্দিষ্ট স্তর এবং হাল হলো একটা দশা। হাল এবং মাকাম উভয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত উপহার হিসেবে বিবেচিত হয়। এগুলো কোনো বিশেষ কৌশলের মাধ্যমে অর্জিত অভিজ্ঞতা নয়। যদিও এগুলো সৌভাগ্যের চিহ্ন, তবে সালিককে সতর্ক করা হয় যেন এই অবস্থাগুলোর মোহে আটকে না থাকে এবং একমাত্র ভালোবাসা ও জ্ঞানের মাধ্যমে আল্লাহকেই খুঁজতে থাকে।[২০]
মানজিল
সম্পাদনামানজিল শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো গন্তব্য। সুফি পরিভাষায় এটি এক ধরনের চেতনার স্তর। আল্লাহর পথে সাতটি মানজিল রয়েছে। মানজিলগুলো কুরআনের অংশ, যা কালো জাদু থেকে সুরক্ষায় সহায়ক।[২১]
মাকাম
সম্পাদনাএকটি মাকাম হলো একজনের আধ্যাত্মিক স্তর বা উন্নয়ন পর্যায়। এটি হাল বা চেতনার অবস্থা থেকে পৃথক। মাকামকে নিজের প্রচেষ্টার মাধ্যমে আত্ম-পরিবর্তনের ফল হিসেবে দেখা হয়, যেখানে হাল হলো আল্লাহর দান করা একটা অবস্থা।[২২]
গনোসিসের ধারণা
সম্পাদনাফানা
সম্পাদনাফানা হলো সুফিবাদের একটি ধারণা, যার অর্থ "বিলীন হওয়া।" এটি নিজেকে বিলুপ্ত করে আল্লাহর সত্তা উপলব্ধি করার একটি প্রক্রিয়া, যদিও ব্যক্তি শারীরিকভাবে জীবিত থাকে।[২৩] কিছু মত অনুযায়ী, যারা এই অবস্থায় পৌঁছান, তাদের আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো অস্তিত্ব নেই এবং তারা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ। ফানার প্রকৃতি হলো মন্দ কাজ ও দেহের নীচ প্রবৃত্তিগুলো নির্মূল করা। অন্য কথায় ফানা হলো পাপ থেকে বিরত থাকা এবং অন্তর থেকে দিব্য প্রেম ছাড়া অন্য সমস্ত প্রেম, যেমন লোভ, কামনা, আকাঙ্ক্ষা, অহংকার, প্রদর্শনপ্রিয়তা ইত্যাদি দূর করা। ফানার অবস্থায় একমাত্র সত্য সম্পর্কটি মনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তখন বোঝা যায় একমাত্র প্রকৃত সম্পর্কটি শুধুমাত্র আল্লাহর সঙ্গে।
বাক্বা
সম্পাদনাবাক্বা, যার আক্ষরিক অর্থ "স্থায়িত্ব", এটি সুফি দর্শনে একটি বিশেষ অবস্থাকে বর্ণনা করে যা আল্লাহর সাথে জীবনের একটি অবস্থান। এটি ফানা'র (ধ্বংসের) পরবর্তী স্তর বা অবস্থান। ইনায়েত খান বলেন যে, এটি সর্বোচ্চ প্রাপ্তিযোগ্য অবস্থা, যা সাধু এবং পণ্ডিতরা অর্জন করেন।[২৪]
ইয়াকীন
সম্পাদনাইয়াকীন সাধারণত "নিশ্চয়তা" হিসেবে অনুবাদ করা হয় এবং এটি ওয়ালায়া (যাকে "সাধুত্ব"ও বলা হয়) এর মাধ্যমে পথটি সম্পূর্ণ হওয়ার পরবর্তী শীর্ষ অবস্থান হিসেবে বিবেচিত হয়।[২৫]
অন্যান্য ধারণাসমূহ
সম্পাদনাহাকীকা
সম্পাদনাহাকীকা বা হাকীকত হলো সুফি পারিভাষিক শব্দ, যা সর্বোচ্চ সত্য বা পরম বাস্তবতা বোঝায়।[২৬][২৭]
মারিফত
সম্পাদনামারিফত (অথবা 'মারিফাহ') আক্ষরিকভাবে জ্ঞান বা স্বীকৃতি বোঝায়। রহস্যবাদী মতে, মানুষের সৃষ্টির পেছনের সত্য এবং সকল প্রার্থনার সারমর্ম হলো আল্লাহর স্বীকৃতি। এই শব্দটি সুফি মুসলিমদের দ্বারা ব্যবহার করা হয় মরমি অন্তর্দৃষ্টি জ্ঞান বুঝাতে, এটি এমন এক ধরনের জ্ঞান যা আনন্দিত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত হয়। এটি প্রকাশিত বা যৌক্তিকভাবে অর্জিত হয় না।[২৮]
ইহসান
সম্পাদনাইহসান একটি আরবী শব্দ যা "পরিপূর্ণতা" বা "শ্রেষ্ঠতা" বোঝায়। ইহসান হলো সুফি চর্চার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য এবং এটি অর্জিত হয় যখন একজন অনুসারী সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করেন।[২৯][৩০]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ Chaudhry, Hafeez-ur-Rehman (২০১৩)। "Understanding the Philosophy of Spirituality at Shrines in Pakistan"। Bennett, Clinton; Ramsey, Charles M.। South Asian Sufis: Devotion, Deviation, and Destiny (1st সংস্করণ)। London and New York: Bloomsbury Academic। পৃষ্ঠা 43–60। আইএসবিএন 9781441184740। এলসিসিএন 2011036221। ডিওআই:10.5040/9781472548696.ch-003।
- ↑ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ২০০৫
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ Cook, David (মে ২০১৫)। "Mysticism in Sufi Islam"। Oxford Research Encyclopedia of Religion। Oxford: Oxford University Press। আইএসবিএন 9780199340378। ডিওআই:10.1093/acrefore/9780199340378.013.51 । ২৮ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ জানুয়ারি ২০২২।
- ↑ ক খ Hanson, Eric O. (২০০৬)। Religion and Politics in the International System Today। New York: Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 102–104। আইএসবিএন 978-0-521-85245-6। ডিওআই:10.1017/CBO9780511616457।
- ↑ ক খ Findley, Carter V. (২০০৫)। "Islam and Empire from the Seljuks through the Mongols"। The Turks in World History। Oxford and New York: Oxford University Press। পৃষ্ঠা 56–66। আইএসবিএন 9780195177268। ওসিএলসি 54529318।
- ↑ Shahzad Bashir (২০১৩)। Sufi Bodies: Religion and Society in Medieval Islam। Columbia University Press। পৃষ্ঠা 9–11, 58–67। আইএসবিএন 978-0-231-14491-9।
- ↑ Antony Black (২০১১)। The History of Islamic Political Thought: From the Prophet to the Present। Edinburgh University Press। পৃষ্ঠা 241–242। আইএসবিএন 978-0-7486-8878-4।
- ↑ Brague, Rémi (২০০৯-০৪-১৫)। The Legend of the Middle Ages। আইএসবিএন 9780226070803।
- ↑ Biographical encyclopaedia of sufis: central asia and middle east, Vol 2. Hanif N. Sarup and Sons. (2002) আইএসবিএন ৮১-৭৬২৫-২৬৬-২, 9788176252669.
- ↑ Amitai-Preiss, Reuven (জানুয়ারি ১৯৯৯)। "Sufis and Shamans: Some Remarks on the Islamization of the Mongols in the Ilkhanate"। Journal of the Economic and Social History of the Orient। Leiden: Brill Publishers। 42 (1): 27–46। আইএসএসএন 1568-5209। জেস্টোর 3632297। ডিওআই:10.1163/1568520991445605।
- ↑ tauheed pg,442। ডিসেম্বর ৩১, ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ Ibn al-'Arabi, Muhyi al-Din (1164–1240)
- ↑ Chittick, William C. "Ebn al-‘ArabiMohyi-al- Din Abu ‘Abd-Allah Mohammad Ta’IHatemi." Encyclopedia Iranica (1996): Web. 3 Apr 2011. <http://iranica.com/articles/ebn-al-arabi ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১১-০৭-১৯ তারিখে>
- ↑ ক খ "Basics of Islam"।
- ↑ "Sufi Cosmology"। Kheper.net।
- ↑ Tohfa Mursala by Abu Saeed Mubarak Makhzoomi। yanabi.com। ২০১৬-০৫-১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ Ruh or Soul in the light of Sufism। ২০১৫-০৩-১১। আইএসবিএন 9789699795183।
- ↑ "Astral body"।
- ↑ "zahir o batin=physical and spiritual body"। ২০১৫-০৯-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ "ḥāl"।
- ↑ Chittick, William C. (২০১০-০৩-৩১)। Manzil। আইএসবিএন 9780791498989।
- ↑ "maqām"।
- ↑ "Fana in Sufism"। Britannica।
- ↑ Khan, Hazrat Inayat (২০১০-১২-২৩)। A Sufi Message of Spiritual Liberty। আইএসবিএন 9781613100004।
- ↑ Laliwala, J. I. (২০০৫)। stages of yaqeen। আইএসবিএন 9788176254762।
- ↑ "Haqiqah, Aboslute Truth"। ২০১৩-০৩-১৩।
- ↑ John Baldock, The Essence of Suffism (মার্চ ২০০৫)। Haqiqah। আইএসবিএন 9781848584075।
- ↑ The Concept of Marifat। ২০১৫-০৩-১১। আইএসবিএন 9789699795183।
- ↑ M.Fethullah Gulen, Key Concepts in the Practice of Suffism (২০১৪-০৪-১৯)। Ihsan। আইএসবিএন 9781597846448।
- ↑ William C.Chittick, Sufism:A Beginner’s Guide (অক্টোবর ২০০৭)। ihsan। আইএসবিএন 9781780740522।