সিগারেট
সিগারেট একটি পণ্য যা ধূমপানের জন্য গ্রহণ করা হয়। তামাক পাতা কুচি কুচি করে কেটে পরিশোধন করার পর তার সাথে আনুষঙ্গিক কয়েকটি উপাদান মিশিয়ে কাগজে মোড়ানো সিলিন্ডারের ভিতর পুড়ে সিগারেট তৈরি করা হয়। একটি প্রতিরূপ সিগারেটের সিলিন্ডারের দৈর্ঘ্য ১২০ মিলিমিটার এবং ব্যাস ১০ মিলিমিটার। সিগারেটের এক প্রান্তে আগুন জ্বালিয়ে অন্য প্রান্তে মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে হয়। যে প্রান্তে মুখ দিতে হয় সে প্রান্তে সচরাচর বিশেষ ফিল্টার থাকে। সিগারেট হোল্ডার দিয়েও অনেকে ধূমপান করে থাকেন। সিগারেট বলতে সাধারণত তামাকের তৈরি সিগারেট বোঝানো হলেও বিশেষভাবে এটি যেকোন ধরনের উপাদানকে নির্দেশ করে। যেমন, গাঁজা দিয়েও সিগারেট তৈরি হতে পারে।[১]
আইন
সম্পাদনাবাংলাদেশে প্রচলিত ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ এর ৪ ধারা অনুযায়ী প্রকাশ্যে ধূমপানের ফলে জরিমানা হিসেবে প্রথমবার অনধিক ৳৩০০ (তিন শত) টাকা এবং দ্বিতীয় বা পরবর্তী প্রতিবারের জন্য দ্বিগুন টাকা দিতে হয়। এছাড়া ১০ধারা অনুযায়ী সিগারেট, বিড়ি ইত্যাদি তামাকজাতীয় দ্রব্যের মোড়কে ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিংবা ধূমপান হৃদরোগের কারণ লেখা বাধ্যতামূলক।
গঠন
সম্পাদনাসিগারেট দেখতে সরু ও লম্বা, চওড়া আকৃতির হয়।
যিনি ধূমপান করেন, তিনিই ধূমপায়ী। সিগারেট ঠোঁটে লাগার ফলে ধীরে ধীরে ঠোঁট কালচে আকার ধারণ করে। ফলে মুখের সৌন্দর্য অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে যায়। ঠোঁটের এই কালচে দাগ দুর করার জন্য অনেক সামগ্রী পাওয়া যায়। কেউ কেউ টুথপেষ্ট ব্যবহার করে থাকে।
রাসায়নিক উপাদান
সম্পাদনাসিগারেটে ৫৭টি মারাত্মক রাসায়নিক উপাদানের সন্ধান পাওয়া গেছে যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তেমনি একটি হলো নিকোটিন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে দুটি সিগারেট এ যে পরিমাণ নিকোটিন আছে তা যদি একটি সুস্থ মানুষ এর দেহে ইঞ্জেক্ট করে দেয় তাহলে সে মানুষটি তখনি মারা যাবে।
সিগারেটের ক্ষতিকারক প্রভাব
সম্পাদনানিয়মিত সিগারেট খাওয়া বা ধূমপান করা শরীরের পক্ষে খুবই মারাত্মক। সিগারেটের ভেতরে যে তামাক থাকে তার অন্যতম উপাদান নিকোটিন। নিকোটিন স্নায়ুতন্ত্রের উপর প্রভাব বিস্তার করে, এছাড়া পরোক্ষ ভাবে হৃদযন্ত্র, রক্তনালী ও রক্তের ওপরও এর ক্রিয়া আছে।
মস্তিষ্কের ওপর নিকোটিনের বেশ প্রভাব রয়েছে সেজন্য অনেকেই বলেন, একটু সিগারেট না টানলে মাথাটা খুলছে না। বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, গ্রামের কৃষক সবারই নিত্যদিনের সঙ্গী হয়েছে ধূমপান। ধূমপান ও জলপান যেন একই পর্যায়ে এসে যাচ্ছে। এর মুখ্যত কারণ হচ্ছে মস্তিষ্কের উপর নিকোটিনের প্রভাবে স্নায়বিক উত্তেজনা। এই উত্তেজনার ফলেই রাজনীতিবিদদের বক্তব্য ঝড় ঝড় করে উদ্গিরণ হতে থাকে। সাহিত্যিকের কলমের নিব গরম হয়।
ধূমপানের ফলে হৃদস্পন্দনের হার বেড়ে যায়। মস্তিষ্ক মারফৎ পিটুইটারী গ্রন্থি ও তার পরে বৃক্কের উপর অবস্থিত অ্যাডরেনাল গ্রন্থি উত্তেজিত হয়। অ্যাডরেনাল গ্রন্থি থেকে হরমোন নিঃসৃত হওয়ার জন্যই হৃদস্পন্দনের হার বাড়ে। একটি বা দুটি সিগারেট টানলে মানুষের হৃদস্পন্দন ১৫ থেকে ২৫ বার বেড়ে যায়। সিস্টোলিক রক্তের চাপও বাড়ে। এর পরিমাণ প্রায় ১০ থেকে ২০ মিলিমিটার পারদ চাপের সমান। ধূমপানে হৃদযন্ত্র থেকে রক্ত নিক্ষেপের পরিমাণও কিছুটা বাড়ে। এই সমস্ত কারণে ধূমপায়ীদের হৃদযন্ত্রের উপর একটা চাপের সৃষ্টি হয়। যাঁদের হৃদরোগ আছে তাদের ক্ষেত্রে এই চাপ মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
অতিরিক্ত ধূমপানে রক্তের মধ্যে ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যায়। এছাড়া অণুচক্রিকার পরস্পর যুক্ত হওয়ার প্রবণতা থাকে এমনকি এগুলি রক্তনালীর গায়েও লেগে যেতে পারে। এই সব কারণে রক্তনালীর ভেতরের অংশ সরু হয়ে যায় ফলে যে কোন মুহূর্তে থ্রম্বোসিস অথবা অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস হতে পারে। সমীক্ষায় দেখা গেছে যাঁরা ধূমপান করেন না তাদের চেয়ে ধূমপায়ীদের অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস রোগ বেশি ধরা পড়ে। পরীক্ষায় জানা গেছে একটি সিগারেট টানলে গড় ২.৫ মিলিগ্রাম নিকোটিন শরীরে প্রবেশ করে। এই নিকোটিন খুব সহজেই মুখগহ্বরের মিউকাস পর্দা ও শ্বাস তন্ত্রের মাধ্যমে রক্তে শোষিত হয়ে যায়।
নিকোটিন ছাড়া ধূমপানে বিষাক্ত গ্যাস কার্বন মনোক্সাইড শরীরে প্রবেশ করে। একটি সিগারেট থেকে প্রায় ৩ থেকে ৫ মিলিলিটার কার্বন মনোক্সাইড শরীরে যায়। ধূমপায়ী যত তাড়াতাড়ি ধূমপানে অভ্যস্ত হবেন কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণও সেই অনুপাতে বাড়বে। দেখা গেছে ধূমপানের অব্যবহিত পরেই রক্তে কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়।আমরা জানি শরীরের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য লোহিত রক্ত কণিকার ভেতর হিমোগ্লোবিন নামে এক ধরনের পদার্থ আছে। হিমোগ্লোবিন অক্সিজেনের সাথে যুক্ত হয়ে অক্সিহিমোগ্লোবিন উৎপাদন করে এবং তা রক্ত কর্তৃক বাহিত হয়ে প্রতিটি কলা কোষে পৌঁছায়। দেখা গেছে, হিমোগ্লোবিনের সাথে অক্সিজেন যুক্ত হওয়ার প্রবণতার চাইতে কার্বন মনোক্সাইড যুক্ত হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। তাই স্বভাবতই রক্তে কার্বন মনোক্সাইড বেড়ে গেলে খুব তাড়াতাড়ি অক্সিহিমোগ্লোবিনের বদলে কারবোক্সিহিমোগ্লোবিন উৎপন্ন হয়। ফলে রক্তের অক্সিজেন বহন ক্ষমতা হ্রাস পায়। তাই দেখা গেছে অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীদের রক্ত ৫ থেকে ১% কম অক্সিজেন বহন করে। ফলে প্রতিটি কোষই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। রক্তাল্পতা বা হৃদরোগ আছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কার্বন মনোক্সাইডের প্রভাব মারাত্মক। গর্ভবতী মহিলা যদি ধূমপানে নিয়মিত অভ্যস্ত হন তাহলে গর্ভস্থ শিশুর নানারকম জটিল ব্যধি হতে পারে।
এসব ছাড়াও নিয়মিত ধূমপানে ক্যানসার নামে দূরারোগ্য ব্যধি হওয়ার প্রবণতা যে বাড়ে সে বিষয়ে সমস্ত বিজ্ঞানী একমত। ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট, আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি ইত্যাদি সংস্থা ব্যাপক ভাবে গবেষণা ও সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন ধূমপানে যে ফুসফুসে ক্যানসার ঘটে সেটা একেবারেই নিশ্চিত। দেখা গেছে অধূমপায়ীদের তুলনায় নিয়মিত ধূমপায়ীদের ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আপেক্ষিক ঝুঁকি ২.৪ থেকে ৩৪.১ পর্যন্ত হতে পারে।[২]
আরও দেখুন
সম্পাদনাআরও পড়ুন
সম্পাদনা- Bogden JD, Kemp FW, Buse M; ও অন্যান্য (জানুয়ারি ১৯৮১)। "Composition of tobaccos from countries with high and low incidences of lung cancer. I. Selenium, polonium-210, Alternaria, tar, and nicotine"। J. Natl. Cancer Inst.। 66 (1): 27–31। পিএমআইডি 6935462। * Hecht SS (জুলাই ১৯৯৯)। "Tobacco smoke carcinogens and lung cancer"। J. Natl. Cancer Inst.। 91 (14): 1194–210। ডিওআই:10.1093/jnci/91.14.1194। পিএমআইডি 10413421।
- Zhou, Xun Yu; Gilman, Sander L. (২০০৪)। Smoke: a global history of smoking। London: Reaktion Books। আইএসবিএন 978-1-86189-200-3।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Wigand, J.S. Additives, Cigarette Design and Tobacco Product Regulation, A Report To: World Health Organization, Tobacco Free Initiative, Tobacco Product Regulation Group, Kobe, Japan, 28 June-2 July 2006
- ↑ বই:পরম পরশ, শিরোনাম: ধূমপান না স্বাস্থ্য, লেখক: তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী, প্রকাশক-শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতা,বছর ২০০৯, ISBN 978-93-341-3673 -9
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- US Center for Disease Control - Smoking and Health Database
- GLOBALink
- National Clearinghouse on Tobacco and Health ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৭ মে ২০১৪ তারিখে - Canada
- Society for Research on Nicotine and Tobacco ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৫ আগস্ট ২০১৯ তারিখে
- Bibliography on History of Cigarette Smoking
- Mortality in relation to smoking: 50 years' observations on male British doctors[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- INGCAT - International Non Governmental Coalition Against Tobacco ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৬ মে ২০১৯ তারিখে
- Inquirer.net, Herbal ‘cigarette’ may help smokers quit