সালাহউদ্দিন মমতাজ
শহীদ ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ বীর উত্তম (জন্ম: ১২ জুলাই, ১৯৪৫ - মৃত্যু: ৩১ জুলাই, ১৯৭১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন দুর্ধর্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে 'বীর উত্তম' খেতাবে ভূষিত করে। [১]
শহীদ ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ বীর উত্তম | |
---|---|
জন্ম | ১২ জুলাই, ১৯৪৫ |
মৃত্যু | ৩১ জুলাই, ১৯৭১ ধানুয়া কামালপুর, বকশীগঞ্জ, জামালপুর |
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
নাগরিকত্ব | ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত) পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে) বাংলাদেশ |
পরিচিতির কারণ | শহীদ, বীর উত্তম |
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
সম্পাদনাসালাহউদ্দিন মমতাজের জন্ম ১২ জুলাই ১৯৪৫, ফেনী জেলার সদর উপজেলায় উত্তর চাড়িপুর গ্রামের মুক্তারবাড়িতে। তাঁর পিতার নাম শামসুদ্দিন আহমেদ এবং মায়ের নাম খায়রুন নাহার। তার পিতামহ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন আকিয়াবের শেষ মুসলিম জমিদার। মাতামহ মৌলভী আবদুর রাজ্জাক ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য (এমএলএ)। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ল' গ্র্যাজুয়েট বাবার ওকালতি করার সুবাদে কোলকাতায় সালাহউদ্দিনের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। পরে তিনি বাড়ির কাছে দেবীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি এবং ফেনী সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাস করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে তিনি কিছুকাল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোর দয়াল সিং কলেজে পড়াশোনা করেন। শেষে ফেনী কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। এই কলেজে বিএসসি অধ্যয়নকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।
কর্মজীবন
সম্পাদনাসালাহউদ্দিন মমতাজ ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ফ্লাইট ক্যাডেট হিসাবে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে ২৭শে আগস্ট কাকুলের পাকিস্তানি মিলিটারি একাডেমী থেকে ১২৪ জন ক্যাডেটের মধ্যে তিনি তৃতীয় স্থান দখল করে কমিশন পেয়েছিলেন। এরপর তাঁর পোস্টিং দেয়া হয় ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৬৭ সালের ২৭শে আগস্ট থেকে ১৯৭১ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়োজিত ছিলেন। এরপর পাকিস্তানের মারিতে স্কুল অব মিলিটারি ইনটেলিজেন্সে কোর্স শেষ করার পরে ১৯৭১ এর ৩রা মে ৪৩ বেলুচ রেজিমেন্টে বদলি করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা
সম্পাদনামুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ ছিলেন পাকিস্তানের ৪৩ বেলুচ রেজিমেন্টে কর্মরত। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ খায়রুল আনাম, ক্যাপ্টেন সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান এবং ক্যাপ্টেন আবদুল আজিজ দুর্গম পার্বত্য এলাকা এবং পাকিস্তানের শিয়ালকোটের কাছে মারালা সীমান্তের খরোস্রোতা মুনাওয়ার তায়ী নদী অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। এই নদী অতিক্রম করে সীমান্ত পাড়ি দেয়া ছিল প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিপজ্জনক।
ধরা পড়লেই ফায়ারিং স্কোয়াডে নিশ্চিত মৃত্যু। একপ্রকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে চূড়ান্ত ধোঁকা দিয়ে ভারত সীমান্তের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ভিতর দিয়ে তাঁরা ভারতে প্রবেশ করেন। এসময় ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ সহ বাকিদের সঙ্গে অস্ত্র বলতে ছিল কেবল পিস্তল। সেখান থেকে তাঁরা বিএসএফ ব্যাটেলিয়ন হেড কোয়ার্টার হয়ে দিল্লি এসে এরপর দিল্লি থেকে কলকাতায় পৌঁছালেন। কলকাতায় আসার পর মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী নিজে এই পাঁচজনকে বরণ করে নেন। এর আগে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ পূর্বে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত থাকায় তাঁকে তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়োগ দেয়া হয়। বলা বাহুল্য ১৯৬৭ সালের ২৭শে আগস্ট কমিশন পাওয়ার পরে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজকে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের ২৭শে আগস্ট থেকে তিনি ১৯৭১ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন।
মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে প্রথম তৃতীয় এবং অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে জেড ফোর্স গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিদ্রোহ করা ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিদ্রোহ করা ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং চট্টগ্রামের ষোলশহরে বিদ্রোহ করা ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে একত্রিত করা মেঘালয়ের তেলঢালায়।
মুক্তিযুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধের পর বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করার পর ১ম ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিক সংখ্যা ছিল মাত্র ১৮৮ জন। একমাত্র অফিসার ছিলেন লেফটেন্যান্ট হাফিজউদ্দিন আহমেদ। ব্যাটেলিয়নের মোট সৈন্যের চার ভাগের তিনভাগই ছিলেন গণযোদ্ধা। এই গণযোদ্ধাদের ৬ সপ্তাহের কঠোর পরিশ্রম সমন্বিত অনুশীলন শেষে ৭ জুলাই জেড ফোর্স গঠন করা হয়। গোপনীয়তার স্বার্থে নাম দেয়া হয় ১ আর্টিলারি ব্রিগেড। জেড ফোর্স এক আর্টিলারি ব্রিগেড ১ পদাতিক ব্রিগেড হওয়ায় ১ম ইস্ট বেঙ্গলের গোপন নাম রাখা হয় ১ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি। একই সঙ্গে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের গোপন নাম রাখা হয় ৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি এবং ৮ম ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি।
এই ব্যাটেলিয়ন তিনটির প্রশিক্ষণ শেষে ব্রিগেড কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান যুদ্ধ উপযুক্ততা যাচাইয়ের জন্য কনভেনশনাল ওয়্যার বা প্রচলিত ধারার যুদ্ধ করার পরিকল্পনা করেন। এতোদিন এই ব্যাটেলিয়নগুলো কেবল গেরিলা যুদ্ধই করেছে। ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে দায়িত্ব দেয়া হয় কামালপুর বিওপিতে থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটিটি দখল করার জন্য। এই কামালপুর বিওপির অবস্থান ছিল মেঘালয় সীমান্তবর্তী জামালপুরের বকশীগঞ্জ থানার ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়নে।
১ম ইস্ট বেঙ্গলের রেজিমেন্টের কামালপুর বিওপিতে আক্রমণ ছিল মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রথম কনভেনশনাল যুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সন্দেহাতীতভাবে অপারেশন কামালপুরকে বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বিপজ্জনক ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ। কামালপুর যুদ্ধের সবচেয়ে দুরূহ ও বিপজ্জনক যুদ্ধ ছিলো ৩১শে জুলাইয়ের এই যুদ্ধ।
কামালপুর বিওপি ছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। কারণ একবার কামালপুর যদি অতিক্রম করা যায় তাহলে ঢাকা পৌঁছাতে ব্রহ্মপুত্র নদ ছাড়া কোন বড় বাধা নেই। পাকিস্তান বাহিনী যে করেই হোক চেয়েছিলো বকশিগঞ্জ, জামালপুর ও ময়মনসিংহকে নিজেদের দখলে রাখার। কারণ এতে করে এই সীমান্ত সম্পূর্ণ অর্থে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিজেদের দখল থাকবে এবং মেঘালয় থেকে মুক্তিবাহিনী এখানে ঢুকতে পারবেনা।
কামালপুর বিওপিতে বালুচ রেজিমেন্টের ১ প্লাটুন সেনা, ৭০ উইং রেঞ্জার্স ইউনিটের এক প্লাটুন ও রাজাকারদের এক প্লাটুন সদস্য নিয়োজিত ছিল।
কামালপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিলো প্রচণ্ড সুদৃঢ়। বিশেষ করে কামালপুর বিওপির চারদিকে মোটা গাছের গুঁড়ি ও কংক্রিট দিয়ে আর্টিলারি শেষ প্রতিহত করার জন্য মাটি- টিনের দেয়াল এবং ৬ ইঞ্চি ব্যবধানে লোহার বিমের মোট ৮টি উঁচু বাংকার ছিল আর বাঙ্কারের বাইরের অংশে পুঁতে রাখা ছিল মাইন, কাঁটাতারের বেড়া, বুবি ট্র্যাপ ও বাঁশের কঞ্চি।
অপারেশনের আগে তথ্য সংগ্রহ ও রেকি করার জন্য ২৮শে জুলাই বিকেলে ব্রাভো কোম্পানির কমান্ডার ক্যাপ্টেন হাফিজ , সুবেদার আলী হোসেন, সুবেদার ফয়েজ ও সুবেদার সিদ্দিক কৃষকের ছদ্মবেশে বেশ কাছ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর গতিবিধি , অবস্থান টহল সহ নানা কিছু পর্যবেক্ষণ করে নিরাপদেই ঘাঁটিতে ফিরে আসেন।
একই দিন রাতে ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ ও তাঁর দলের লেফটেন্যান্ট আবদুল মান্নান, সুবেদার হাই, সুবেদার হাসেম ও নায়েক সফিকে নিয়ে কামালপুর বিওপি রেকি করতে যান। কিন্তু রাতের অন্ধকারে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ পাকিস্তানি লিসনিং পোস্টের কাছাকাছি পৌঁছালে একজন পাকিস্তানি সেনা 'হল্ট' বলেই চিৎকার দিয়ে উঠেন। ঐ সময়ে লিসনিং পোস্টে দুই সেনা সদস্য ছিলো। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ তখন এক সৈন্যকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে ফেলে দেন। এসময় সুবেদার হাই গুলি করেন। মুহূর্তেই দুই পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। ঐ দুই সৈন্যকে একপাশে ফেলে তাদের ক্যাপ ও রাইফেল নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসেন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ ও বাকি চারজন।
এদিকে হঠাৎ আক্রমণ ও দুই সেনার নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ণ সতর্ক হয়ে যায়। তারা ভেবেছিলো এটি নিশ্চয়ই ভারতীয় বাহিনীর কাজ। কারণ মুক্তিবাহিনী এধরনের হামলা করবে তা তাদের চিন্তার বাইরে ছিলো। তাও আবার এই প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্যে গুলি করে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া! ভারতীয় বাহিনী ফের আক্রমণ করতে পারে এই ভেবে ঢাকা থেকে বিপুল পরিমাণ সৈন্য পাঠানোর আহ্বান জানায় কামালপুর বিওপি। পরদিন ঘটনা শুনে জরুরীভাবে ঢাকা থেকে কামালপুরে আসেন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী। তার নির্দেশে এবার দ্বিগুণ সৈন্য ও অত্যাধুনিক অস্ত্র পাঠানো হয় কামালপুরে।
২৯ জুলাইয়ের মধ্যে আরো দুই দফা রেকি শেষে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ, ক্যাপ্টেন হাফিজ রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরীকে চূড়ান্ত নির্দেশের জন্য তথ্য উপস্থাপন করেন ওবনফ ৩০শে জুলাই বিকেলে রেজিমেন্ট অধিনায়ক মেজর মঈনুল হোসেণ বালির মডেলের সাহায্যে সামরিক কায়দায় চূড়ান্ত যুদ্ধের নির্দেশ দিলেন। এদিকে বিওপির পূর্ব দিকে ডাকবাংলো ও গুদাম ঘর থাকায় সেদিকে আক্রমণ করতে দুরূহ হবে এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে শত্রুর বাঙ্কার বড় থাকায় উত্তর দিক থেকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়।
এই আক্রমণের সময় নির্ধারণ করা হয় ৩১শে জুলাই রাত সাড়ে তিনটায়। আক্রমণ শুরু হবে কামালপুর বিওপির খোলা মাঠের পাশ থেকে। প্রথম আক্রমণ করবে ক্যাপ্টেন হাফিজ ও মেজর সালাউদ্দিনের ব্রাভো ও ডেল্টা কোম্পানি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেন বকশীগঞ্জের দিকে পালাতে গিয়ে ফের হামলার শিকার হয় সেজন্য কামালপুর বিওপি থেকে ১ মাইল পিছনে উঠানিপাড়ায় আলফা কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয়া হয়। অন্যদিকে ভারতীয় আর্টিলারি ব্যাটারি সাহায্য করবে এই তিনটি কোম্পানিকে।
এফইউপি তথা ফরমিং আপ প্লেসে নিরাপত্তা এবং গাইড প্রদান করবে চার্লি কোম্পানি। এটি ছিলো একটি পাটক্ষেত; সেখানে অবস্থান নিবেন জেড ফোর্স অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান, রেজিমেন্ট অধিনায়ক মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী ও অ্যাডজুট্যান্ট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত আলী খান।
৩০শে জুলাই সূর্যাস্তের আগেই মুক্তিযোদ্ধারা রাতের খাবার খেয়ে ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক সচল করে সূর্যাস্তের পর মিলিত হওয়ার জন্য পার্শ্ববর্তী ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। পথে শুরু হয় মুষলধারে তীব্র বৃষ্টি। মুক্তিযোদ্ধারা সবাই ভিজে গেলেন। মহেন্দ্রগঞ্জে পৌঁছে সবাই পায়ে হেঁটে সবাই সীমান্তের কাছাকাছি একটি ডাক বাংলোতে আশ্রয় নিলেন। সেখানে ভেজা অবস্থাতেই তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা শেষ মুহূর্তের চেকআপ করে, গোলন্দাজ বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে কামালপুরের দিকে যাত্রা শুরু করেন। এর মধ্যে আবার শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি। মুক্তিযোদ্ধাদের চলার গতি কমে যায় ঝুম বৃষ্টি ও অন্ধকারের কারণে। আর তাই এফইউপিতে পৌঁছাতে কিছুটা সময় দেরী হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের।
৩১শে জুলাই দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা পজিশনে যাওয়ার আগেই অতর্কিত ভাবে ভারতীয় মাউন্টেন ব্যাটারি কোন নির্দেশ ছাড়াই গোলাবর্ষণ শুরু করে। এদিকে পরিকল্পনা ছিলো ব্রাভো কোম্পানির কমান্ডার ক্যাপ্টেন হাফিজ এফইউপিতে পৌঁছে নির্দেশ দিলে তবেই ভারতীয় মাউন্টেন ব্যাটারি গোলাবর্ষণ শুরু করবে। কিন্তু ভুলবুঝাবুঝির কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানি বাহিনীকে চমকে দেয়া সম্ভব হলোনা। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান আঁচ করতে পেরে গোলা নিক্ষেপ শুরু করে। সদ্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলো। এদিকে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর একটি গোলাও দুর্ভেদ্য হানাদারদের অবস্থানে পৌঁছাচ্ছে না। এ কারণে ব্রাভো ও ডেল্টা কোম্পানির মধ্যে শত্রুদের অবস্থান লক্ষ্য করে হামলা করা অসাধ্য হয়ে পড়ে। ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে ব্রাভো কোম্পানি কোনভাবে অবস্থান নিয়ে শত্রু বাঙ্কার অভিমুখে আক্রমণ শুরু করলো।
পাকিস্তানি সৈন্যরা তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি দেখতে পাচ্ছে। এক পর্যায়ে হঠাৎ করেই বিকল হয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক। এদিকে সংকেতের কারণে আর্টিলারি ফায়ার বন্ধ ও সম্ভব হচ্ছেনা। আর নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ও বন্ধ হয়ে যায়। তীব্র গলাগুলি ও পাল্টা গোলা বর্ষণের তীব্র আওয়াজে শুধু চিৎকারের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষাও ভয়াবহ কঠিন হয়ে পড়ে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের ডেল্টা কোম্পানি ও ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে ব্রাভো কোম্পানি ও মুক্তিযোদ্ধারা ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে এফিউপিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। এদিকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের ও পাকিস্তানিদের ক্রসফায়ারে আহত হন। সাময়িকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের গতি থেমে যায়। এই অবস্থায় ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ অসামান্য নেতৃত্বের পরিচয় দেন। তিনি ক্ষেপে গিয়ে হাতের কাছের সেনাদের কাউকে ধাক্কা মেরে, কারো গোলা চেপে ধরে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে থাকেন। চরম ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সৈন্যদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে তিনি শত্রুদের লক্ষ্য করে মাইক্রোফোনে উচ্চ কণ্ঠে উর্দুতে বলতে থাকেন 'আভি তাক ওয়াক্ত হ্যায় , শালালোক সারেন্ডার কারো , নেহি তো জিন্দা নেহী ছোড়েঙ্গা।' (এখনই সময়, সবাই সারেন্ডার কর, নয়তো একজনকেও জীবিত ছাড়বো না।) সহযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্য তিনি বলতে থাকেন, 'ইয়াহিয়া খান এখনও এমন বুলেট তৈরি করতে পারেনাই, যা মমতাজকে ভেদ করবে যদি মরতেই হয়, এক পাকসেনাকে সাথে নিয়ে মরো। বাংলার মাটিতে শহীদ হও।'
ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের প্রেরণায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে হারানো মনোবল ফিরে আসে। বিপুল বিক্রমে ঘুরে দাঁড়ায় মুক্তিযোদ্ধারা। সালাউদ্দিন মমতাজের অসীম সাহসিকতায় তাঁর কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণে পাকিস্তানিদের ১ম ডিফেন্স কর্ডন শেল প্রুফ বাংকারে ঢুকে পড়েন। এ সময় সালাউদ্দিন মমতাজ আরও সাহসী হয়ে উঠে ২০-২৫ জনকে নিয়ে বিওপির কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকে যান। তিনি বুঝতে পারেন পাকিস্তানিরা সামনের সারির বাংকার পজিশনগুলো ক্লিয়ার করে পিছিয়ে গিয়ে পুনরায় সেকেন্ড লাইনে কাউন্টার অ্যাটাকের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই তিনি মেগাফোনে সুবেদার হাই এর প্লাটুনকে ডানদিকে যাওয়ার জন্য নির্দেশ করে বলেন ‘হাই প্লাটুন নিয়ে ডানে যাও।’ আক্রমণের শুরুতে সুবেদার হাইয়ের প্লাটুনে মুক্তিযোদ্ধা ছিল ৪০ জন। আর এই পর্যায়ে এসে তাঁর প্লাটুনে মুক্তিযোদ্ধা ১৫ জনের মতো। এদিকে মাইনের আঘাতে নায়েক শফির হাত উড়ে গেছে। অগ্রসরমান মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনকে বারবার পিছু হটার জন্য অনুরোধ করে বলতে থাকেন ‘স্যার পজিশনে যান, স্যার পজিশনে যান। এখানে জায়গাটা প্রচণ্ড বিপজ্জনক।’
সালাউদ্দিন মমতাজ ধমকে উঠে বললেন, ব্যাটা বারবার স্যার স্যার করিস না। পাকিস্তানিরা আমার অবস্থান টের পেয়ে যাবে। চিন্তা করিস না তুই আমার সামনে এসে দাঁড়া। গুলি লাগবে না। ইয়াহিয়া খান আজো আমার জন্য গুলি বানাতে পারেনি। প্রথমবারে সম্ভবত সুবেদার হাই ম্যাগাফোনে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের নির্দেশ শুনতে পান নি, তাই সালাউদ্দিন মমতাজ পুনরায় সুবেদার হাই’কে উদ্দেশ্য করে বলেন ‘হাই’... ঠিক এমন সময় ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের সামনে কয়েকটি গোলা এসে পড়ে বিস্ফোরিত হলো। তাঁর দেহটা প্রথমে বামে, পরে আধা ডানে, এবং শেষে লুটিয়ে পড়ে শেষবারের মতো। এসময় সহযোদ্ধারা তাঁর দিকে এগিয়ে এলে তিনি বললেন, ‘খোদার কসম তোরা কেউ পিছু হটবি না।’
বিড়বিড় করে তিনি বললেন, ‘মরতে হয় পাকিস্তানিদের মেরে মর বাংলাদেশের মাটিতে মর।’ শহীদ হলেন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ বীর উত্তম।
পুরস্কার ও সম্মাননা
সম্পাদনা- বীর উত্তম
- বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঘাটাইলস্থ সেনানিবাসটির নামকরণ করা হয় "শহীদ সালাউদ্দিন সেনানিবাস (ঘাটাইল)"।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "দৈনিক কালের কন্ঠ,ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী "একজন সৈনিকের কাহিনী"| তারিখ: ২৬-০৩-২০১২"। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০১৩।
২ খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: শহীদ ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ, বীর উত্তম
https://www.thedailystar.net/bangla/
- ↑ উদ্ধৃতি ত্রুটি:
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়;:0
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি