সাইজেফ নিয়ম
সাইজেফ নিয়ম বা সেটজেফ নিয়ম বা জেটসেভ নিয়ম (English:Zaitsev's rule or Saytzeff's rule, Saytzev's rule) হল এমন একটি নিয়ম বা সূত্র যা প্রয়োগ করে কোনো অপসারণ বিক্রিয়ায় বিক্রিয়াজাত একাধিক অ্যালকিনের মধ্যে কোনটির আপেক্ষিক পরিমাণ বেশি হবে অর্থাৎ কোন অ্যালকিনটিকে মুখ্য বিক্রিয়াজাত হিসেবে পাওয়া যাবে তা নির্ণয় করা যায়। কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে রাশিয়ার রসায়নবিদ আলেকজান্ডার জেটসেভ অপসারন বিক্রিয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করেন এবং লক্ষ্য করেন, বিক্রিয়াগুলিতে অপনয়নজাত অ্যালকিনের উৎপাদন একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে হচ্ছে। এই নিয়মটিকে শনাক্ত করে জেটসেভ বলেন,"জৈব যৌগের অপনয়ন বিক্রিয়ার দ্বারা উৎপন্ন অধিকতর প্রতিস্থাপিত অ্যালকিনটি অর্থাৎ যেটির মধ্যে β-কার্বনগুলির সঙ্গে স্বল্প সংখ্যক হাইড্রোজেন পরমাণু যুক্ত আছে, সেটি মুখ্য বিক্রিয়াজাত হয়।" (The alkene formed in greatest amount is the one that corresponds to removal of the hydrogen from the β-carbon having the fewest hydrogen substituents)
উদাহরণস্বরূপ : অ্যালকোহলীয় পটাশিয়াম হাইড্রক্সাইডের উপস্থিতিতে 2-আয়োডোবিউটেনের অপনয়ন বিক্রিয়ার ফলে প্রাপ্ত 2-বিউটিন হয় মেজর প্রোডাক্ট বা মুখ্য বিক্রিয়াজাত এবং 1-বিউটিন হয় মাইনর প্রোডাক্ট বা গৌণ বিক্রিয়াজাত।[১]
ইতিহাস
সম্পাদনাবিজ্ঞানী আলেকজান্ডার জেটসেভের আবিষ্কৃত অপনয়ন বিক্রিয়ার ফলাফলসংক্রান্ত এই অভিনব সূত্র সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭৫ সালে জাস্টাস লাইবিগস অ্যানালেন ডার কেমি (Justus Liebigs Annalen der Chemie) পত্রিকায়।[২][৩] এই পত্রিকায় জেটসেভের ছাত্রদের বিভিন্ন গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হত এবং তৎকালীন অন্যান্য বিজ্ঞানীদের গবেষণার সমালোচনা করা হত।[৪] এখানে জেটসেভ প্রাথমিকভাবে অ্যালকিল আয়োডাইডের ডিহাইড্রোহ্যালোজেনেশন বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে এই সূত্রের প্রযোজ্যতা প্রমাণ করলেও পরে দেখা যায় যে সূত্রটি যে-কোনো ধরনের অপনয়ন বিক্রিয়ার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বিংশ শতাব্দীতে জেটসেভের পেপারের আরও নিখুঁতভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় এবং সম্ভবত ১৯৬০ সাল থেকে এই সূত্রটি আবিষ্কারকের নামানুসারে জেটসেভ নিয়ম বা সেটজেফ নিয়ম বা সাইজেফ নিয়ম নামে পরিচিতি পায়।[৩]
যদিও বিজ্ঞানী জেটসেভকে পুরোপুরিভাবে এই নিয়মের প্রণেতা বলা যায় না। জেটসেভের আগেই আলেকজান্ডার নিকোলাইভিচ পপভ ১৮৭২ সালে অপনয়ন বিক্রিয়ার উপর জেটসেভের তত্ত্বের অনুরূপ একটি তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন[৫] এবং ১৮৭৩ সালে কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে নিজের তত্ত্বের পরীক্ষামূলক উপস্থাপনা করেছিলেন। যেহেতু তখন জেটসেভ কাজান বিশ্ববিদ্যালয়েই কর্মরত ছিলেন তাই সম্ভবত তিনি পপভের তত্ত্বটি সম্পর্কেও অবগত ছিলেন। তৎসত্ত্বেও তার লাইবিগস অ্যানালেন-এর প্রবন্ধে বিজ্ঞানী পপভের কাজের কোনো উল্লেখ ছিল না।[৩][৪]
সেটজেফ রুলের ইতিহাস প্রসঙ্গে আরেকজন রুশ বিজ্ঞানী ভ্লাদিমির ভ্যাসিলেভিচ মারকনিকভের কথা বলতেই হয়। জেটসেভ ও মারকনিকভ দুজনেই সমসাময়িক কালে কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আলেকজান্ডার বাটলারভের ছাত্র ছিলেন এবং তাদের মধ্যে যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। ১৮৭০ সালে মারকনিকভ তার বিখ্যাত মারকনিকভের নিয়ম প্রকাশ করেন এবং এর জবাবে জেটসেভ নতুন নিয়মটি আবিষ্কার করে অপসারণ বিক্রিয়ার ফলাফলসংক্রান্ত পুরাতন ধারণাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করেন। মনে করা হয় যে মারকনিকভের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই জেটসেভকে এই সূত্র আবিষ্কারে উদ্বুদ্ধ করেছিল।[৩] তাই ১৮৭১ সালে কম্পটেস রেন্ডাস (Comptes Rendus) জার্নালে তিন কিস্তিতে মারকনিকভের যুত বিক্রিয়া সংক্রান্ত গবেষণা প্রকাশ পাওয়ার পরে পরেই জেটসেভ পালটা তার অপনয়ন বিক্রিয়াসংক্রান্ত গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।[৪]
তাপগতীয় আলোচনা
সম্পাদনাঅ্যালকিনের হাইড্রোজেনেশন (হাইড্রোজেন পরমাণুর সংযোজন) দ্বারা অ্যালকেন উৎপাদনের বিক্রিয়াটি তাপমোচী। কোন্ অ্যালকিনের হাইড্রোজেনেশন বিক্রিয়ায় কতটা তাপশক্তি পরিপার্শ্বে নির্গত হবে তা নির্ভর করে প্রারম্ভিক অ্যালকিনটির সুস্থিতির উপর: প্রারম্ভিক অ্যালকিনটি যত বেশি সুস্থিত হবে নির্গত তাপের পরিমাণও তত কম হবে। পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যালকিন যৌগের হাইড্রোজেনেশন-তাপের পরিমাণ গণনা করে দেখা গিয়েছে যে অধিক প্রতিস্থাপিত অ্যালকিন তুলনামূলক বেশি সুস্থিত হয়।[৬]
জৈব যৌগের নাম | গঠনবিন্যাস | হাইড্রোজেনেশনের মোলার আপেক্ষিক তাপ | প্রতিস্থাপনের প্রকৃতি | |
---|---|---|---|---|
kJ/mol এককে | kcal/mol এককে | |||
ইথিলিন | 137 | 32.8 | অপ্রতিস্থাপিত | |
1-বিউটিন | 127 | 30.3 | এক-প্রতিস্থাপিত | |
ট্রান্স-2-বিউটিন | 116 | 27.6 | দ্বি-প্রতিস্থাপিত | |
2-মিথাইল-2-বিউটিন | 113 | 26.9 | ত্রি-প্রতিস্থাপিত | |
2,3-ডাইমিথাইল-2-বিউটিন | 111 | 26.6 | চতুর্প্রতিস্থাপিত |
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Lehman, John (২০০৯)। Operational Organic Chemistry (4th সংস্করণ)। Upper Saddle River, NJ: Pearson Education। পৃষ্ঠা 182। আইএসবিএন 0136000924।
- ↑ Saytzeff, Alexander (১৮৭৫)। "Zur Kenntniss der Reihenfolge der Analgerung und Ausscheidung der Jodwasserstoffelemente in organischen Verbindungen"। Justus Liebigs Annalen der Chemie। 179 (3): 296–301। ডিওআই:10.1002/jlac.18751790304।
- ↑ ক খ গ ঘ Lewis, D. E. (১৯৯৫)। "Alexander Mikhailovich Zaytsev (1841–1910) Markovnikov's Conservative Contemporary" (পিডিএফ)। Bulletin for the History of Chemistry। 17: 21–30 (27)। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ জুন ২০১৯।
- ↑ ক খ গ Lewis, D. E. (২০১০)। "Feuding Rule Makers: Aleksandr Mikhailovich Zaitsev (1841–1910) and Vladimir Vasil'evich Markovnikov (1838–1904). A Commentary on the Origins of Zaitsev's Rule" (পিডিএফ)। Bulletin for the History of Chemistry। 35 (2): 115–124 (121–122)।
- ↑ Popoff, Aleksandr (১৮৭২)। "Die Oxydation der Ketone als Mittel zur Bestimmung der Constitution der fetten Säuren und der Alkohole"। Justus Liebigs Annalen der Chemie। 162 (1): 151–160। ডিওআই:10.1002/jlac.18721620112।
- ↑ Wade, pp. 292–294.
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- Online course of chemistry
- [১] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৮ অক্টোবর ২০২০ তারিখে English Translation of 1875 German article on 'The order of addition and of elimination of hydrogen and iodine in organic compounds' by Alexander Zaitsev.