সরস্বতী মন্দির, উবুদ
সরস্বতী মন্দির, উবুদ স্থানীয় নাম 'পুরা তামন সরস্বতী' বা আনুষ্ঠানিক নাম 'পুরা তামান কেমুদা সরস্বতী' (উবুদ ওয়াটার প্যালেস নামেও পরিচিত) হল ইন্দোনেশিয়ার বালির উবুদ শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বালিনিজ হিন্দু মন্দির। সুদৃশ্য মন্দিরটি বিদ্যা, সঙ্গীত জ্ঞানের দেবী সরস্বতীকে উৎসর্গীকৃত। এই মন্দিরের পদ্মসরোবর ও জল-বাগিচা অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। মন্দিরটি বিদেশী পর্যটকদের কাছে আকর্ষণ তো বটেই, জনপদের ল্যান্ডমার্কও সরস্বতীর এই সুদৃশ্য মন্দিরটি। [১]
সরস্বতী মন্দির, উবুদ পুরা তমন কেমুদা সরস্বতী | |
---|---|
সাধারণ তথ্যাবলী | |
ধরন | ভবন |
স্থাপত্যশৈলী | বালিনিজ |
ঠিকানা | উবুদ, গিয়ানিয়ার রিজেন্সি, বালি |
দেশ | ইন্দোনেশিয়া |
স্থানাঙ্ক | ৮°৩০′২১″ দক্ষিণ ১১৫°১৫′৪১″ পূর্ব / ৮.৫০৫৯৫১° দক্ষিণ ১১৫.২৬১৪৯২° পূর্ব |
নির্মাণ শুরু | ১৯৫১ |
সম্পূর্ণ | ১৯৫২ |
নকশা ও নির্মাণ | |
স্থপতি | আই গুস্টি নিওমান লেম্প্যাড |
ইতিহাস
সম্পাদনাপ্রাচীনকালে ইন্দোনেশিয়ার বালি-সুমাত্রা-জাভা-বালি দ্বীপ সমূহ ভারতবর্ষের অংশ ছিল এবং একসময়ে সেখানে শৈলেন্দ্র রাজবংশের নানা হিন্দু রাজারা রাজত্ব করে গেছেন। তাই এখানকার জনজীবনে হিন্দু সংস্কৃতি স্বাভাবিকভাবেই মিশে ছিল। তাছাড়া হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ ছাড়াও বৌদ্ধ এবং ভারতের কিছু অঞ্চলের জৈন ধর্মাবলম্বী মানুষেরাও সরস্বতী দেবীর আরাধনা করেন। তবে ভারতীয় হিন্দুরাই ইন্দোনেশিয়ায় সরস্বতী পূজার প্রচলন করেন। ইন্দোনেশিয়ার বিখ্যাত ভাস্কর আই গুস্তি নয়োমান লেম্প্যাড (১৮৬২ -১৯৭৮) সরস্বতী মন্দিরের তথা 'পুরা তমন সরস্বতী'র ডিজাইন করেছিলেন। আই গুস্তি নয়োমান লেম্প্যাড ইন্দোনেশিয়ার ব্লাহবাতুহ রাজদরবারে নানা বালিনিজ ভাস্কর্য এবং 'উন্দাগি' (আনুষ্ঠানিক আচারের জন্য বালিনিজ স্থাপত্য যেমন, ক্রিমেসান টাওয়ার এবং কাঠের সারকোফাগি ইত্যাদির) কাজ করতেন, কিন্তু মতবিরোধের জন্য উবুদে চলে আসেন এবং সুকাওয়াতি রাজপরিবারের স্থপতি নিযুক্ত হয়ে উবুদ এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে বেশ কয়েকটি প্রাসাদ এবং মন্দির নির্মাণ করেন। [২]
পুরা তমন সরস্বতীর নির্মাণ ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়েছিল এবং ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে সম্পন্ন হয়েছিল। মন্দিরটির অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর মূর্তিটিও আকর্ষণীয়। শিক্ষা, সাহিত্য এবং জ্ঞানের হিন্দু দেবী সরস্বতীকে উৎসর্গ করা হয়েছে। [২]
মন্দির প্রাঙ্গণ
সম্পাদনাউবুদের সরস্বতী মন্দিরটি যেমন সুন্দর স্থাপত্য, জটিল খোদাইয়ে হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি, অলঙ্কৃত সজ্জায় সুদৃশ্য, মন্দির সংলগ্ন বৃহৎ প্রাঙ্গণটিও অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। পদ্ম সরোবর ও জল-বাগিচা দ্বারা বেষ্টিত মন্দির প্রাঙ্গণ দর্শনার্থীদের আরাম এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ উপভোগ করার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। প্লুমেরিয়া (ফ্রাঙ্গিপানি) তথা কাঠগোলাপ ফুলের গাছে সজ্জিত পদ্ম সরোবর শোভা মনোরম। সেতুর ন্যায় তৈরি প্রবেশপথ হিন্দু পৌরাণিক মূর্তিগুলির প্যারাস (আগ্নেয়গিরির টাফ) ভাস্কর্য দিয়ে সজ্জিত। এই মূর্তিগুলির বেশিরভাগই গুস্তি নয়োমান লেম্প্যাডের তৈরি । মন্দিরের অভ্যন্তরীণ গর্ভগৃহে প্রবেশের জন্য তিনটি লাল ইটের তৈরি কোরি আগুং গেট রয়েছে । কেন্দ্রীয় কোরি আগুং এই দরজাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং দুটি লম্বা প্লুমেরিয়া গাছ দিয়ে ঘেরা। [৩]
অভ্যন্তরীণ প্রাঙ্গণের সোজা পথটি অবশ্য বালির স্থাপত্যমতে ''অ্যালিং-আলিং'' নামক এক প্রাচীর দ্বারা অবরুদ্ধ রাখা হয় যাতে কোন অশুভ আত্মাকে বিভ্রান্ত করা সহজ হয়। এই প্রাচীরটি আসলে ৩ মিটার (৯.৮ ফুট)-উচ্চ জেরো গেদে মেকালিং রাক্ষস মূর্তির পিছনের অংশ। [৪]
আনুষ্ঠানিক পূজার পদ্মাসন মন্দিরের সবচেয়ে পবিত্র, 'কাজা-কাঙ্গিন' (উত্তর-পূর্ব) কোণে অবস্থিত। এই পদ্মাসনটি মহাজাগতিক কচ্ছপের প্যারাস খোদাইয়ের উপর এবং বেশ কয়েকটি নাগ বা সর্প দ্বারা সজ্জিত। পদ্মাসনের উপরের অংশে একটি সোনার খালি সিংহাসন যা সচরাচর বালিনিজ হিন্দুদের সর্বোচ্চ দেবতা অচিন্ত্যের প্রতিমূর্তি দ্বারা সজ্জিত থাকে। [৫]
অভ্যন্তরে তিনটি খালি সিংহাসন সহ একটি মণ্ডপ ( বেল ) ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর তথা শিবের জন্য উৎসর্গীকৃত। বেশ কিছু মেরু টাওয়ারও এই পাশে অবস্থিত। মন্দিরটিতে বেল বারংও রয়েছে, একটি মণ্ডপ যা গ্রামবাসীরা আচার-অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত বারং মূর্তিগুলিকে রাখতে পারে। সাধারণত বেল বারং- এ দুটি বারং মূর্তি থাকে : সিংহের মতো বারোং কেত এবং শুয়োরের মতো বারং পাংকাল)। সেখানে দেবী সরস্বতীর মূর্তিও রয়েছে। [৫]
অন্যান্য
সম্পাদনা- ইন্দোনেশিয়া মুসলিম প্রধান দেশ হলেও তারা হিন্দু ইতিহাসের প্রতি যেমন শ্রদ্ধাশীল এবং তেমনি হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি সংবেদশীল। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু (১৬ ফুট দীর্ঘ) দণ্ডায়মান সরস্বতীর শ্বেতশুভ্র মূর্তি তৈরি করে ইন্দোনেশিয়া দৃষ্টান্তমূলক উপহার হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডি সির এমব্যাসি রো তে তাদের দূতাবাসের সামনে প্রতিষ্ঠা করে। [৬]
- ভারতীয় ভূখণ্ডের প্রাচীনতম পূজিতা দেবী সরস্বতী। তার আরাধনা বৈদিক যুগেই শুরু হয়েছিল। বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী সরস্বতী জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং কলার দেবী। বৌদ্ধ উপাসকেরা ভারতীয় পুরাণের মাতৃযোগ তাদের তন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। বৌদ্ধতন্ত্রানুসারে দেবী হলেন -'প্রজ্ঞাপারমিতা'। ভারতের গণ্ডী ছাড়িয়ে বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। মূলত সেকারণেই ভারতের গণ্ডী ছাড়িয়ে দেবী সরস্বতী ইন্দোনেশিয়া সহ জাপান, চিন, তিব্বত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড কাম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় পূজিতা হন ভিন্ন ভিন্ন রূপে ও পরিচয়ে। [৭]
আরো দেখুন
সম্পাদনা- দেবী সরস্বতী
- বেন্যাইতেন, জাপানের দেবী সরস্বতী
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "Saraswati Temple Ubud"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১১-২২।
- ↑ ক খ Kartajaya 2009, পৃ. 66।
- ↑ DK Travel 2016, পৃ. 94।
- ↑ DK Travel 2016।
- ↑ ক খ Reader ও Ridout 2002।
- ↑ "ট্রাম্পের মুলুকে এক মুসলিম দেশ থেকে 'অভিবাসী' এই সরস্বতী"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১১-২২।
- ↑ "শুধু ভারত নয়, গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়েই পূজিত হন দেবী সরস্বতী"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১১-২২।