সরদার বা সর্দার (ইংরেজি: Sordar, Sardar, আরবি: سردار) মুসলিমদের মধ্যে খুব প্রচলিত এবং সম্ভ্রান্ত একটি পদমর্যাদা। সেরদার বা সরদার ছিলো একটি উপাধি যা উসমানীয় সাম্রাজ্যে একটি সামরিক পদবি এবং মন্টিনিগ্রোসার্বিয়ায় অভিজাত পদবি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মধ্যযুগে সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার ফলে পরবর্তীতে বৃটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমান্তরালে বাঙালির পদবির বিকাশ ঘটেছে বলে মনে করা হয়। ঢাকার নবাব পরিবারে তাদের সরদারি প্রথা বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত এ প্রথায় প্রতিটি মহল্লায় স্থানীয় প্রভাবশালী মুসলমান ব্যক্তিদের থেকে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি করে কমিটি গঠন করা হতো যারা উক্ত মহল্লার ছোটখাটো বিষয়াদি মীমাংসা করতেন। প্রতিটি কমিটির প্রধান সরদার বা সর্দার নামে পরিচিত ছিলেন। ঢাকার নবাব পরিবার পঞ্চায়েত কমিটি অনুমোদন ও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করতেন। কিছু পদবি সম্রাট বা জমিদাররা পেশা বা দায়িত্ব অনুসারে প্রদান করতেন। তার মধ্যে দলনেতা, গোষ্ঠী প্রধানদের সরদার উপাধি দেওয়া হতো।

সরদার শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ Leader, Chief, Guardian, Captain বা Commander হিসাবে পাওয়া যায়। অনেক ইতিহাসবিদ অবশ্য সুলতানি আমলে কর বা রাজস্বকাজে নিযুক্ত দলপতিকে সরদার বলা হতো এমন কথাও বলেন। তাছাড়া ভাষাবিদরা বহুল প্রচলিত পদবি আমীর এর উপমহাদেশীয় মুসলিম রূপ হিসাবে উৎস খুঁজে পান বলে জানান। মির বা মীর শব্দটি এসেছে আরবি থেকে। আরবি শব্দ আমীর’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে মীর। সেই অর্থে মীর অর্থ দলপতি বা নেতা, প্রধান ব্যক্তি, সরদার ইত্যাদি। এখান থেকেও সরদার (সর্দার) উপাধির প্রচলন বলেও অনেকে ধারণা করেন। সেই অর্থে মীর অর্থ দলপতি বা নেতা, প্রধান ব্যক্তি, সরদার ইত্যাদি। জিতে নেয়া বা জয়ী হওয়া অর্থে মীর সরদার শব্দের ব্যবহার হতো। তবে মীর বা সরদার বংশীয় লোককে সম্ভ্রান্ত এবং সৈয়দ বংশীয় পদবিধারী’র একটি শাখা বলে গাবেষকরা মনে করেন। সেই হিসাবে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স. এর বংশের সাথে সরদার বংশের সাদৃশ্যে আছে বলে মনে করেন অনেকে।

তাছাড়া সেরদার, সর্দার বা সরদার ছিলো একটি উপাধি যা উসমানীয় সাম্রাজ্যে একটি সামরিক পদবি এবং মন্টিনিগ্রোসার্বিয়ায় অভিজাত পদবি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সেরদার হলো সরদার-এর তুর্কি ভাষায় একটি বৈকল্পিক বানান। সেরদারগণ বিশেষত উসমানীয় সাম্রাজ্যের সীমান্ত প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তারা তাদের ভূখন্ডের নিরাপত্তার জন্য দায়ী ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, ইয়েনিস হতে আগত বারবারোসের পিতা ইয়াকুপ আগামন্টিনিগ্রো রাজ্য এবং সার্বিয়া রাজ্যে ভোজভোডার অধস্তন সম্মানসূচক অভিজাত পদবি হিসেবে সর্দার (সেরদার) উপাধিটি ব্যবহার হতো(ঊদাহরণস্বরূপ, জানকো ভুকোতিজ নামক মন্টিনিগ্রোর একজন সামরিক নেতা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী সেরদার উপাধিটি বহন করতেন।

তবে একথা সকল ইতিহাসবিদ, বা ভাষাবিদ স্বীকার করে নেন যে, মধ্যযুগে, সুলতানী আমলে বা আব্বাসীয় খিলাফতের সময় দলপতি বা গোত্রপতি বা রাজস্ব কাজে নিযুক্ত একটি বা একাধিক বিভাগের কমান্ডারকে সরদার পদবি দেওয়া হতো। যেটা পরবর্তীতে আত্মমর্যাদাবোধ এবং বংশমর্যাদার প্রতীক হিসাবে গৃহীত হতো। অনেকে অবশ্য সরদার ফারসি মূল থেকে আগত হিসাবেও গণ্য করেন। কারণ বাংলা বা উপমহাদেশীয় ভাষা আরবি ও ফারসি ভাষার প্রাদুর্ভাব খুব দেখা যায়। যার অর্থ প্রভূ, মালিক, ভূস্বামী, শাসনকর্তা, বা রাজামোগল আমলে এদেশের স্থানীয় রাজকর্মচারিদেরও নাকি এ পদবি দেয়া হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা এবং সমাজসেবামূলক কাজে তাদের প্রত্যক্ষ অবদান আছে। নবাবী আমল থেকে সমগ্র বাংলাদেশে সরদার বংশ ছড়িয়ে পড়ে।

পেশাভিত্তিক পদবি যেটা আরও বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়, যেমন, মাওলানা, মুফতী, কাজি, কানুনগো, কারকুন, গাজী, গোলন্দাজ, দেওয়ান, নিয়াজী, খন্দকার, পাটোয়ারী, মলঙ্গী, মল্লিক, মাতব্বর, মুন্সি/মুন্সী, মুহুরী, মৃধা, লস্কর, ব্যাপারী, হাজারী, প্রামাণিক, পোদ্দার, সরদার, হাওলদার, শিকদার, জোয়ার্দার, শেখ, চৌধুরী, ইনামদার ও সরকার।

সরদার বংশের ক্রমবিকাশ

সম্পাদনা

মধ্যযুগে দলপতি বা নেতা হতে সরদার পদবির উৎপত্তি। ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল ও ব্রিটিশ আমলে সরদারদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে নেতৃত্ব দিত বলে ইতিহাস প্রমাণ পাওয়া যায়। নবাবী আমলে বাংলার নবাবদের বিশেষ পদে অধিষ্ঠিত ছিল এ বংশের ব্যক্তিবর্গ। বার ভূঁইয়া সময় বা জমিদার আমলেও সরদারদের নেতৃত্ব জনমানুষমুখী ছিল। নবাব সলিমুল্লাহ আমলে পুরান ঢাকার উন্নয়নমূলক কাজে সরদারদের অবদান অনস্বীকার্য। ঢাকার প্রথম শহীদ মিনার তৈরি করে পিয়ারু সরদার। যুগ যুগ ধরে এ মেলবন্ধন আমাদের মাতৃভাষা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এ ধারা যতদিন থাকবে তার সঙ্গে যে নামটি জড়িয়ে থাকবে সে নামটি পুরনো ঢাকার ১৫, হোসনি দালানের বিখ্যাত সরদার পরিবারের অন্যতম পিয়ারু সরদার। এই সাহসী ভাষা সৈনিক নিজের জীবন বিপন্ন হবে জেনেও ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শহীদদের স্মৃতি চির অম্লান করে রাখতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী দিয়ে সহায়তা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। কবি সুফিয়া কামালের সুযোগ্যা কন্যা সুলতানা কামাল ‘পিয়ারু সরদারের জন্য সামান্য দুটি কথা’ শিরোনামে এক লেখায় বলেছেন, ২০১৪ সালের ২০ মে একেবার হঠাৎ করেই একটা ছোট্ট খোলা জানালার সন্ধান পেলাম আমি। যে জানলা দিয়ে আবার নতুন করে বাংলাদেশের মানুষদের তাদের সত্যিকারের চেহারায় দেখার সুযোগ হলো। চেহারাটা দেখলাম পিয়ারু সরদারের কাহিনির মধ্যে।

ঢাকার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকা নগরীতে মুসলমান পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ব্রিটিশ শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিকাশ লাভ করে, যা সরদারি প্রথা হিসেবে পরিচিত ছিল। ঢাকার নবাবদের মাধ্যমে এই প্রথা গড়ে উঠেছিল, যা সরকারি স্বীকৃতিও পেয়েছিল। এ প্রথা অনুযায়ী ঢাকা নগরীর প্রতিটি মহল্লা বা পঞ্চায়েত পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিষদের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। এবং এই পরিষদের নেতা হিসেবে যিনি নির্বাচিত হতেন, তাকেই সরদার বলে গণ্য করা হতো।

আক্তার সরদার (মৃত্যু ২৬ এপ্রিল ২০১৬) একজন বাংলাদেশি সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ও পুরান ঢাকার সরদার বংশের ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০২০ সালে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে।

জ্ঞান-বিজ্ঞানে এ বাংলায় সরদারদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সরদার ফজলুল করিম (মে ১, ১৯২৫-জুন ১৫, ২০১৪) বাংলাদেশের বিশিষ্ট দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক। প্লেটোর রিপাবলিক (অনুবাদ), রুশোর সোশাল কন্ট্রাক্ট (অনুবাদ), আমি সরদার বলছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ, দর্শনকোষ তার উল্লেখযোগ্য কাজ।

আবদুল মোতালেব সরদার (ইংরেজি: Abdul Motaled Sardar; জন্ম: ১ নভেম্বর ১৯০০ ব্রিটিশ ভারতের শরীয়তপুর জেলার শখিপুর থানাধীন সরদার কান্দি গ্রামে, মৃত্যু: ৯ ডিসেম্বর ১৯৮০ নারায়ণগঞ্জ) একজন ব্রিটিশ ভারতীয় ফুটবলার ও লোকসংগীত শিল্পী ছিলেন। পিতা গফুর আলি সরদার । তিনি কলকাতা মোহামেডান ক্লাবের মিড ফিল্ডার ছিলেন। ফুটবল খেলার পাশাপাশি তিনি গান লেখা, সুর করা ও পরিবেশন করার ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন । তার লেখা অনেক গান সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে। মহাত্মা গান্ধী, পির বাদশা মিয়া আবা খালেদ রশীদ উদ্দিন আহমদ, শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রমুখ নেতাদের সামনে তিনি নিজের লেখা গান গেয়ে শুনিয়েছেন ।

সরদার জয়েনউদ্দীন (১৯১৮ - ২২ ডিসেম্বর, ১৯৮৬) একজন বাংলাদেশী লেখক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও সম্পাদক। তিনি বাংলাদেশে গ্রন্থমেলার (অমর একুশে গ্রন্থমেলা) প্রবর্তক। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও আদমজী সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৯৪ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক-এ ভূষিত হন।

সরদার মোহাম্মদ আবদুল হামিদ বাংলাদেশের চলনবিল অঞ্চলের একজন শিক্ষাবিদ, লেখক এবং সমাজ সংস্কারক।

তাছাড়া ইতিহাস, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ধর্ম, সমাজ সংস্কারসহ বিভিন্ন দেশসেবার কাজে এই মুসলিম বংশের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের সকল জেলায় এবং বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশ যেমন পাকিস্তান, ইরান,ইরাক, আমিরাত, সিরিয়া ও সৌদিতে এখনও সরদার পদবির গোত্র দেখা যায়। তাছাড়া কিছু অন্য ধর্ম দলপতিও গত শতকে সর্দার নাম নিয়ে গোত্র প্রধান হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন, ভারত, বা চীন। সরদার শব্দটি দলপতি বা গোত্রপতি বোঝাতে পবিত্র আল-কুরআন এ অনেকবার আসছে। অনেক বই, কাব্যগ্রন্থ, ধর্মীয় গ্রন্থ, মুভি সরদার নামে দলপতি বা স্বনামধন্য গোত্র বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও সরদারদের সাহস, বীরত্ব এবং নেতৃত্বগুণ প্রশংসনীয়। বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও থেমে নেই এই বংশের নতুন প্রজন্ম।

এ বংশের একটি ক্রমবিন্যাস:

রউফ সরদার

সরদার হাসানুল বান্না

সরদার মোহাম্মদ হোসাইন

আলমগীর সরদার

হারুন সরদার

সরদার মিসবাহ

রমিজ উদ্দিন সরদার

সরদার মোশাররফ হোসেন

সরদার মোহাম্মদ আজিজুর রহমান স্বপন

(সংগ্রহীত)

এটি খুলনা জেলার একটি উল্লেখযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য পরিবার।

সরদার পদবি-যুক্ত বিখ্যাত ব্যক্তি

সম্পাদনা

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা