সবুজ রসায়ন
ক্ষতিকর বর্জ্য উৎপাদনকারী বিক্রিয়ার পরিবর্তে যথাসম্ভব কম ক্ষতিকর এবং পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতি প্রণয়ন করাকে সবুজ রসায়ন বলে।সবুজ রসায়ন হলো রসায়নের একটি শাখা যাতে কম পরিবেশ দূষণ করে এবং ঝুঁকি হ্রাস করে এমন রাসায়নিক প্রক্রিয়া বা উৎপাদন-পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা হয়। কার্যত সবুজ রসায়ন এমন একটি গবেষণাদর্শন, যার উদ্দেশ্য এমন রাসায়নিক পদ্ধতির উদ্ভাবন ও অবলম্বন করা যাতে শিল্পজাত বর্জ্যের পরিমাণ হ্রাস পায়, ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার হ্রাস পায় এবং শক্তির অপচয় হ্রাস পায়।[১][২] এটি রসায়নের একটি নবতর শাখা। এর লক্ষ্য মানবদেহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান বর্জিত পণ্য ও পদ্ধতি আবিষ্কার।[৩] এটি পরিবেশ রসায়ন থেকে ভিন্ন।
সবুজ রসায়নের মূলনীতি
সম্পাদনা১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী পল টি অ্যানাস্তাস এবং জন সি ওয়ারনার সবুজ রসায়নের বিষয়টি প্রস্তাব করেন ৷ এতে সবুজ রসায়নের ১২ টি মূলমন্ত্র রয়েছে ৷ যথা:
১৷ বর্জ্য পদার্থ রোধকরণ
২৷ সর্বোত্তম অ্যাটম ইকনমি
৩৷ ন্যূনতম ঝুঁকির পদ্ধতির ব্যবহার
৪৷ নিরাপদ কেমিক্যাল পরিকল্পনা
৫৷ নিরাপদ দ্রাবক ব্যবহার
৬৷ বিক্রিয়ার শক্তি দক্ষতা পরিকল্পনা
৭৷ নবায়নযোগ্য কাঁচামাল ব্যবহার
৮৷ ন্যূনতম উপজাতক
৯৷ প্রভাবকের প্রয়োগ
১০৷ প্রাকৃতিক রূপান্তর পরিকল্পনা
১১৷ যথাসময়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণ
১২৷ দুর্ঘটনা প্রতিরোধ
সবুজ রসায়নের সুবিধা
সম্পাদনাসবুজ রসায়ন, চলতি রসায়নশাস্ত্রকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। সবুজ রসায়ন এর চাহিদা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর কারণ এবং যুক্তি অনেক। চলতি রসায়নশাস্ত্র মানুষকে সাহায্য করেছে এত রকমের আবিষ্কার এর মাধ্যমে কিন্তু পাশাপাশি তা চারদিকের প্রকৃতিকে অনেকভাবেই দূষিত করে তুলেছে। চারপাশের সুন্দর পরিবেশে ছড়িয়ে পরে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে তৈরি নানা বর্জ্য পদার্থ। এই পদার্থগুলি পশুপাখি থেকে শুরু করে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের জন্যে ভীষণ ক্ষতিকারক। এমন অনেক পদার্থ আছে যেগুলো আজ তৈরি করা থেকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই তালিকায় অ্যাসিটিক অ্যানহাইড্রাইড নামক এক সাঙ্ঘাতিক ক্ষতিকারক বস্তু সরকার থেকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
প্রয়োগ
সম্পাদনাপ্রচলিত পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে জৈব রসায়ন বিজ্ঞান এ অনেক রকমের জৈব পদার্থ তৈরি করা হয়ে এসেছে। বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক যৌগ আজ তৈরি করা হয়েছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন অসুখ থেকে দূরে থাকার জন্য, এমনকি মানুষের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য পুরন করার পিছনেও রসায়ন বিজ্ঞান এর অবদান আছে, যেমন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক বস্তুই পলিমার দিয়ে তৈরি। পলিমার রসায়ন বিজ্ঞানও রসায়ন এর একটি শাখা। কিন্তু বেশীরভাগ প্রচলিত পদ্ধতিতে অনেক বর্জ্য পদার্থ তৈরি হয় বলে আমরা আজ সবুজ রসায়নএর সাহায্য নিয়েছি, কারণ এতে কোন বর্জ্য পদার্থ উত্পন্ন হয়না, বা হলেও তার পরিমাণ ক্ষতিকারক মাত্রার চাইতে কম থাকে। এছাড়া উত্পন্ন আনুষঙ্গিক পদার্থের(Side Product) পরিমাণ অনেক কম হয়, বিক্রিয়ার সময়ও অনেক কমে যায় অনেক ক্ষেত্রে। তা ছাড়াও রাসায়নিক যৌগ এর পরিমাণ অনেক বেশি হয় প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায়।
উদাহরণ
সম্পাদনাসবুজ রসায়ন এর প্রয়োগ কে ব্যাখ্যা করে, এমন কয়েকটি উদাহরণ এখানে আলোচনা করা হচ্ছে। ২০০৫ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় “জৈব রসায়নে মেটাথেসিস মেথড” আবিষ্কারের জন্যে।[৪] এর সাহায্যে অনেক “স্মার্ট” জিনিস তৈরি করা যাবে সবুজ রসায়নএর পদ্ধতি মেনে। হাইড্রাজিন নামক এক পদার্থ এই পদ্ধতিতে তৈরি হয়[৫]
NaOCl + 2 NH3 → H2N-NH2 + NaCl + H2O
কিন্তু সবুজ রসায়নের সাহায্য নিয়ে হাইড্রাজিন নিম্নলিখিত পদ্ধতিতেও তৈরি করা যায়। তা হল
2 NH3 + H2O2 → H2N-NH2 + 2 H2O
দ্বিতীয় পদ্ধতিতে অ্যামোনিয়ার বদলে হাইড্রোজেন পারক্সাইড ব্যবহার করে হাইড্রাজিন তৈরি করা যায় কারণ এতে জল ছাড়া আর কোন আনুষঙ্গিক পদার্থ তৈরি হয় না। এ ছাড়াও পলিস্টাইরিন তৈরি করতে ওজোন (O3) এবং সিএফসি(CFC) লাগত “ব্লোইং এজেন্ট ” হিসেবে। সবুজ রসায়ন এ এর পরিবর্তে সুপারক্রিটিক্যাল কার্বন ডাই অক্সাইড দিয়েও কাজ হচ্ছে।
বর্তমানে সবুজ রসায়ন
সম্পাদনাবহু পরীক্ষাগার এ ব্যাবহ্রিত বর্জ্য পদার্থ আজ সবুজ পদার্থ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। যেমন আজকাল অ্যাসিটিক অ্যানহাইদ্রাইদ, যাইলিন[৬] নামক পদার্থের ব্যবহার কমে যাচ্ছে। কারণ দেখা গেছে যে আজকাল অ্যাসিটিক অ্যানহাইদ্রাইদ এর বদলে জিঙ্ক ওক্সাইদ আর আসেতিক আসিদ ও অনেক সময় একি প্রতিক্রিয়া ঘটায়। বর্তমানে কেবলমাত্র সবুজ পদার্থ ছাড়াও দেখা হচ্ছে যে সবুজ পদার্থ ব্যবহার করার পাশাপাশি যে রাসায়নিক যৌগ তৈরি হচ্ছে তার পরিমাণ ও যেন তুলনায় অনেক বেশিই হয়। এ ছাড়াও রাসায়নিক যৌগ তৈরি করার সময় যাতে কমে যায়, সেই বিষয়েও নজর দেওয়া হচ্ছে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "ক্যানাডার গ্রীণ কেমেস্ট্রি নেটওয়ার্ক তথ্যতীর্থ"। ১৯ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ মে ২০১৪।
- ↑ "ক্যালিফোর্নিয়া সরকারের তথ্যতীর্থ"। ২৩ মে ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ মে ২০১৪।
- ↑ "ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় তথ্যতীর্থ"। ১৪ জুন ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ মে ২০১৪।
- ↑ "The Nobel Prize in Chemistry 2005"। The Nobel Foundation।
- ↑ Jean-Pierre Schirmann; Paul Bourdauducq। "Hydrazine"। Ullmann's Encyclopedia of Industrial Chemistry। ডিওআই:10.1002/14356007.a13_177।
- ↑ Coombs, A. (২০০৯)। "Green at the Bench"। The Scientist। ১০ জুলাই ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ নভেম্বর ২০১৪।